১৫ বছরে আওয়ামী সরকার ঋণ করেছে সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি

এ সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার

ইমামূল হাছান আদনান ও মেহেদী হাসান রাহাত

ছবি : বণিক বার্তা

১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ রেখে দেশ থেকে পালিয়েছেন সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গত দেড় দশকে সরকারের অস্বাভাবিক ঋণ বৃদ্ধির এ চিত্র উঠে এসেছে।

ঘোষিত বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে এ ঋণ নেয়া হয়েছে। যদিও শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বেশুমার অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। জনগণের লুণ্ঠিত এসব অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্তও দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর সময় দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনিয়ম-দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব ছিল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটির। যদিও খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তারাই বলছেন, ব্যাংক খাত লুণ্ঠনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহযোগীর ভূমিকা পালনে বাধ্য করা হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নরও স্বীকার করে বলেছেন, ‘দায়িত্ব পালনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে অর্পিত দায়িত্ব আমরা পালন করতে পারিনি।’ গতকাল গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে যাননি। 

গত কয়েক বছরে পুনঃতফসিল, অবলোপনসহ বিভিন্ন নীতিমালার উদারীকরণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। আবার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ‘মালিকানায়’ থাকা ব্যাংকগুলোকে অবাধে অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ দেয়া হয়েছে। ওই ব্যাংকগুলোয় যথাযথভাবে নিরীক্ষাও করা হয়নি। ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেয়া বেনামি ঋণ, পুনঃতফসিলকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণসহ আদায় হবে না এমন ঋণের পরিমাণ অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া এ ঋণের বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। 

আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার রাস্তা, ব্রিজ, মেট্রোরেলের মতো কিছু অবকাঠামো তৈরি করেছে। কিন্তু তার বিপরীতে অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে পঙ্গু করে দিয়েছেন। দেশের আর্থিক খাতসহ প্রতিটি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছেন। জরুরি ভিত্তিতে অর্থনীতিকে টেনে তোলার ও কার্যকর সংস্কার করা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত দেড় দশকে দেশের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, সেটির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ দেশের কোনো পরিসংখ্যানই ঠিক নেই। কয়েক বছর ধরে সরকার ক্রমাগতভাবে তথ্য গোপন করেছে। অর্থনীতির ক্ষতি নিরূপণ করার জন্য ত্বরিত গতিতে একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করতে হবে। সে কমিশন অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে একটি শ্বেতপত্র তৈরি করবে। এরপর অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সঠিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে হবে।’

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি জঞ্জালে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা আগে বলতাম অর্থনীতি খাদের কিনারায়। কিন্তু এখন অর্থনীতি পুরোপুরি খাদের মধ্যে পড়ে গেছে। এখান থেকে টেনে তুলতে হলে কঠোর পরিশ্রম, উদ্যোগ ও মনোযোগ দরকার। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার পাশাপাশি নতুন সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হবে অর্থনীতিকে গর্ত থেকে টেনে তোলা।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশী উৎস থেকে নেয়া হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার ২০ কোটি টাকার ঋণ। বাকি ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকার ঋণ ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাত থেকে এ পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়।

আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদ তথা ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সরকারের ঋণ বৃদ্ধির হার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে এ সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠন, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারির মতো বেশকিছু বড় লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো লুণ্ঠনের শিকার হলেও তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল বেসরকারি খাতের ব্যাংক। ২০১৪ সালে বিরোধী দলের বর্জনের মুখে একতরফা নির্বাচনে আবারো ক্ষমতাসীন হয় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে ১৫৪টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরপরই দেশের ব্যাংক খাতে নতুন উদ্যমে লুণ্ঠন শুরু হয়। এ সময়ে লুণ্ঠন ও মালিকানার পরিবর্তন হয় দেশের বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংক। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক থেকেই মূল উদ্যোক্তারা ছিটকে পড়েন। একই সময়ে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। বিপরীতে কমতে শুরু করে জিডিপির অনুপাতে সরকারের রাজস্ব আহরণ। ফলে বেহাল দশায় পড়ে দেশের অর্থনীতি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি যাওয়ার মতো পৃথিবী কাঁপানো সাইবার অপরাধও সংঘটিত হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল—এ পাঁচ বছরেই ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে তা ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ব্যাংক খাতে সরকারকে ঋণ দিতে ব্যর্থ হলে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়। এতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার। সরকারের ঋণের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এর সুদহারও দ্বিগুণ-তিন গুণ বেড়ে গেছে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার এখন ১২ থেকে ১৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও দুই বছর আগে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার ছিল ১ থেকে ৬ শতাংশ।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা বলে গত দেড় দশকে বিদেশী উৎস থেকেও অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিয়েছে সরকার। ২০১০ সালেও বিদেশী উৎস থেকে নেয়া সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে এ ঋণের স্থিতি ৫৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ সালের মার্চ শেষে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশী ঋণের স্থিতি ৭৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ডলার ১১৮ টাকা হারে) বাংলাদেশী মুদ্রায় সরকারের ঋণের স্থিতি ৯ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

গত দেড় দশকে দেশের অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধঃপতন ঘটেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে অধঃপতন হয়েছে, সেখান থেকে টেনে তোলার জন্য সৎ, যোগ্য, দক্ষ অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর দরকার। দেশের ছাত্র-জনতা যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, সেটি অবিস্মরণীয়। কিন্তু এ বিপ্লব যাতে কোনোভাবেই বেহাত বা ব্যর্থ না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এ মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা, রিজার্ভ সংকটসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এসব চ্যালেঞ্জ দ্রুতই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে সেটি ঠিক করতে অনেক সময় লাগবে। যে ছাত্রদের হাত ধরে দেশে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তাদের দাবি ছিল রাষ্ট্রের সংস্কার। রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোরও সংস্কার করতে হবে।’

বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি বা ৯০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এ গড় বেড়ে ৮২৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের পর দেশ থেকে অর্থ পাচার আরো বেড়ে যায়। তবে ২০১৪-২০১৮ সময়ের গড়কে বিবেচনা করা হলে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৪ হাজার ১৩৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। সে হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।

আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর মধ্যে ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ করস্বর্গ খ্যাত কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থ পাচারের গন্তব্যে পরিবর্তন আসে। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের মতো দেশগুলোকে অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছে বাংলাদেশী পাচারকারীরা। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশসহ সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান-পরিচালক, ঊর্ধ্বতন ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাও দেশ থেকে অর্থ পাচার করছেন। 

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে দেশটিতে বাংলাদেশীদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। এটিই ছিল দেশটিতে বাংলাদেশীদের জমানো সবচেয়ে বেশি অর্থ। এর পর থেকে আমানতের পরিমাণ কমতে থাকে। ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ এবং ২০২৩ সাল শেষে এটি নেমে এসেছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই সুইস ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশী পাচারকারীরা অর্থ অন্য গন্তব্যে সরিয়ে নেয়।

গত এক যুগে যুক্তরাজ্যের গোটা প্রপার্টি বাজারেই বাংলাদেশীদের উপস্থিতি বেশ জোরালো হয়। এ তালিকায় অফশোর প্রপার্টি হিসেবে বেনামে নিবন্ধিত সম্পত্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের ঠিকানায় নিবন্ধনকৃত প্রপার্টিও রয়েছে অনেক। ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারিতেও যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তি মালিকের বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ছয় বছরের মাথায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২-তে। এর পাঁচ বছর পরে ২০২১ সালের আগস্টে এ সংখ্যা বেড়ে ১০৭-এ দাঁড়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছে লন্ডনভিত্তিক অ্যাস্টনস। সংস্থাটির তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশীরা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রপার্টি কেনেন ৪৫৯ বাংলাদেশী। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের প্রপার্টি ক্রয়ের প্রবণতা আরো ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন বাংলাদেশীরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করে গেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের গোপনে কেনা প্রপার্টির অর্থমূল্য এখন কম করে হলেও ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম বড় হাব সিঙ্গাপুর। বৈশ্বিক আর্থিক গোপনীয়তার সূচকে দেশটির অবস্থান এখন তৃতীয়। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এ আর্থিক ও বাণিজ্যিক হাবের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সেখানে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মূলত আমদানি-রফতানি বাণিজ্যই সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। বস্ত্র ও পোশাক খাতের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খাতটির অনেক ব্যবসায়ীকে নিয়মিতভাবেই সেখানে আসা-যাওয়া করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের অনেকে সেখানে অর্থ স্থানান্তর করছেন।

মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশীরা। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন বলে গত মার্চে জানিয়েছেন দেশটির শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী টিয়ং কিং সিং।

বারবুডা, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের তথ্য শুনতে পাওয়া যায়। অতীতেও পানামা পেপার্স ও প্যান্ডোরা পেপার্স নথিতে অফশোর বিনিয়োগে সহায়তা কোম্পানির সহযোগিতায় এমন কিছু দেশে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশীর তথ্য উঠে এসেছিল। এছাড়া সিঙ্গাপুর ও কানাডায়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। কানাডার বেগমপাড়ায় বাংলাদেশীদের অর্থ পাচার করে সম্পদ কেনার বিষয়টি বেশ আলোড়ন তুলেছে। এ নিয়ে স্থানীয় বাংলাদেশী অভিবাসীদের বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এছাড়া দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ বর্তমানে তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া ইত্যাদির মতো পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশেও সরিয়ে আনা হচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাওয়া গেছে। 

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তার সঙ্গে পালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানাও। কয়েকদিন ধরেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সংসদ, প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, সরকার ঘনিষ্ঠ বড় ব্যবসায়ী, ক্ষমতাসীন দলের বহু নেতা দেশ থেকে পালিয়েছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব রাজনৈতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীর বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ আছে। সম্পদের মোহের কারণেই তারা সাধারণ নেতাকর্মীদের ছেড়ে এত সহজে বিদেশ পালাতে উৎসাহিত হয়েছেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, মেট্রেরেলের মতো অবকাঠামো তৈরি করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশনসহ কোনো প্রতিষ্ঠানই বেঁচে নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে জীবিত করতে দেশের বহু বছর সময় লাগবে। এসব ক্ষতির কোনো মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররা রাষ্ট্রের খেলোয়াড়ের বদল চায়নি, তারা খেলার বদল চেয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক কাঠামো থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন


প্রথম পাতা

সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় কেন সাংঘর্ষিক নয়: হাইকোর্ট

প্রিন্ট করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগস্ট ২০, ২০২৪

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা পঞ্চদশ সংশোধনীকে কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ রুল দেন।

জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন। এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ হয় একই বছরের ৩ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ ও বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার স্বীকৃতি দেয়াসহ কয়েকটি বিষয়ে পরিবর্তন আনা হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। তারা হলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফয়েজ আহমেদ।

শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে এক মামলায় আপিল বিভাগ বলেছিলেন, পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। কিন্তু দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিধান পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। কাজেই এটি আপিল বিভাগের আদেশের পরিপন্থী।’

তিনি বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে বেশকিছু আইনি ও সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। এসব বিষয় যেন আদালত দেখেন, সেজন্য আমরা একটি রুল চেয়েছি; কোর্ট রুল দিয়েছেন। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দুজন তরুণ ভোটারও আমাদের সঙ্গে পিটিশনার হিসেবে আছেন।’ 

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনী সাংঘর্ষিক—এ অভিযোগ এনে রিট হয়েছে। সেটিতে রুল ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর ওপর তারা স্টে চেয়েছে; সেটিতে আমাদের আপত্তি রয়েছে। তাই স্টে করা হয়নি।’

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৫০। সংবিধানে পুনর্বহাল করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সংযোজন করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি।


প্রথম পাতা

কূটনীতিকদের ড. ইউনূস

দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার

প্রিন্ট করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগস্ট ১৯, ২০২৪

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল রাজধানীতে কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন ছবি: পিআইডি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমি একটি দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যেটা অনেক দিন ধরেই সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল ছিল। ক্ষমতায় থাকার চেষ্টায় শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার।’

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে কূটনীতিকদের উদ্দেশে দেয়া এক ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। ‘‍মিট অ্যান্ড গ্রিট উইথ দ্য ডিপ্লোমেটিক কর্পস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ আয়োজনে বিদেশী বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার অন্তত ৬৭ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। ব্রিফিংয়ের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধান উপদেষ্টা বিদেশী কূটনীতিকদের শতভাগ সমর্থন প্রত্যাশা করেছেন।

ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে। ভোটাধিকার প্রয়োগ না করেই বড় হয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুণ্ঠন হয়েছে ক্ষমতা অপব্যবহার করে।’ গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নবযাত্রায় বাংলাদেশের বন্ধু, অংশীদার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাশে থাকবে আশাবাদ ব্যক্ত করে লিখিত বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্ধুদের মধ্যে থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল লাখো বীর ছাত্র-জনতা। কিন্তু তার (শেখ হাসিনা) দলের ছাত্র সংগঠন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের স্বাধীনতার পর ভয়াবহতম বেসামরিক গণহত্যা চালানোর পর তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছাড়েন।’

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি সেই সমস্ত বীর ছাত্র এবং নিরীহ মানুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, যারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। আমাদের সাম্প্রতিক স্মৃতিতে অন্য কোনো দেশের ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য এত মূল্য দিতে হয়নি।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশ নিয়ে ছাত্রদের একটি স্বপ্ন আমাদের মুগ্ধ করেছে, যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। ছাত্ররা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে মানুষ রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা।’ 

প্রধান উপদেষ্টা জানান, শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক শক্তির সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাবে। সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।

দেশে সাম্প্রতিক আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্তের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। তদন্তে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার সহায়তা দেবে।’

৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. ইউনূস। এরপর কূটনীতিকদের সঙ্গে এটাই তার প্রথম ব্রিফিং। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ যতগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে, সেগুলোর সবই সরকার বাস্তবায়ন করবে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য দায়িত্ব পালন করব। এরপর আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করব। জাতীয় ঐকমত্য বৃদ্ধির জন্যও আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাব।’

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নতুন যাত্রার এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সাহসী ছাত্র ও জনগণের জন্য আমাদের জাতির স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের এ যাত্রা কঠিন। তরুণদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের পূরণ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হয়, ততই ভালো। আমরা বিশ্বাস করি, একটি নতুন গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের যাত্রাপথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব বন্ধু ও অংশীদার আমাদের সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়াবে।’


প্রথম পাতা

সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৬২৬ এখন আছেন ৭ জন —আইএসপিআর

প্রিন্ট করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আগস্ট ১৯, ২০২৪

ছবি : সংগৃহীত

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রাণ রক্ষার্থে রাজনৈতিক নেতা, বিচারক, পুলিশ সদস্যসহ ৬২৬ নাগরিক বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছেড়েছেন। চারজনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এখন আছেন সাতজন। গতকাল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। এ সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতাসহ নাগরিকরা সেনানিবাসে আশ্রয় চান।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ, জীবন রক্ষা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জীবন বিপন্ন রাজনৈতিক দলের ২৪ জন নেতা, ৫ জন বিচারক, প্রশাসনের ১৯ জন কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা, পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৮৭ জন সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার-পরিজনসহ (স্ত্রী ও শিশু) মোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেয়া হয়।

আইএসপিআর জানায়, পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছেড়েছেন। আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে আশ্রয় পাওয়া তিনজন ও তাদের পরিবারের চারজন সদস্যসহ মোট সাতজন সেনানিবাসে অবস্থান করছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।