By using this site, you agree to our Privacy Policy.

গণ–অভ্যুত্থান: মানসিক ক্ষতি ভোগাবে বেশি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে

গণ–অভ্যুত্থান: মানসিক ক্ষতি ভোগাবে বেশি, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে

বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী পাঁচ শতাধিক মানুষ কোটাবিরোধী আন্দোলন ও সরকারের পদত্যাগের আন্দোলনে নিহত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই ছাত্রছাত্রী, শিশু–কিশোর।

শুরুর দিকে ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ৩২ জন শিশু নিহত হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যাটা বেড়েছে। ১৭ আগস্ট প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন বলছে, সারা দেশে কমপক্ষে ৬৭ জন শিশু–কিশোর নিহত হয়েছে। ১০ জন ছাড়া যাদের সবার শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল।

আন্দোলনের সময় আহত হয়েছে, জেল খেটেছে বা কোন না কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে—এমন ছাত্র–জনতার সংখ্যা অগুনতি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এদের অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবার মতো অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে, যা স্বল্পমেয়াদি থেকে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।

আমরা এটাও জানি, শারীরিক আঘাত চিকিৎসায় একসময় হয়তো সেরে ওঠে, কিন্তু মানসিকভাবে যে ক্ষতিটা হয় তা দীর্ঘদিন থেকে যায় এবং এর প্রভাব অনেক সময় শারীরিক আঘাতের চেয়েও গভীর। এ ক্ষেত্রে সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়।

তীব্র শোক বা মানসিক আঘাত পেলে যে ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে তার মধ্যে অন্যতম ও জটিল একটি রোগ হচ্ছে পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, যেটাকে সংক্ষেপে পিটিএসডি বলা হয়।

এই মানসিক রোগের প্রধান কিছু লক্ষণ হচ্ছে, যে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা ব্যক্তির মনে আঘাত সৃষ্টি করেছে তা বারবার ফিরে আসে। ঘটে যাওয়া ট্রমাটিক ঘটনা কখনো বাস্তব স্মৃতি হয়ে, কখনো কল্পনা বা দুঃস্বপ্নের মধ্যে চলে আসে। ব্যক্তি বারবার সেই স্মৃতিতে আতঙ্কিত বোধ করে, মনে করে তার জীবনে আবারও সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে, ব্যক্তির স্বাভাবিক আবেগের বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, ভয়, আতঙ্ক, রাগ বা অস্থিরতা প্রকাশ করা। পিটিএসডি হয়েছে এমন ব্যক্তিদের মাঝে কিছু কিছু বিষয় আলোচনা, কিছু ঘটনা নিয়ে কথা বলা, কিছু স্থান যেমন বাজার, জনসমাগম হয় এমন স্থান, কিছু জায়গা যা ব্যক্তির ট্রমার স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে পারে, কিছু মানুষ আর কিছু পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার প্রবণতা তৈরি হয়।

এ কারণে অনেক সময়ই তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সামাজিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, কর্মক্ষেত্রে কাজের পারফরম্যান্স খারাপ হয়ে যায়, এমনকি চাকুরি বা ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মতো কাজও করে ফেলে নিজেকে প্রতিরক্ষার জন্য। এর মাঝে অনেকেই কারণ থাকুক বা না থাকুক বিষণ্ণতা বা অবসাদে ভুগতে পারেন, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা শুরু করতে পারেন।

মানসিক ট্রমা আক্রান্ত ব্যক্তির পিটিএসডি না দেখা দিলেও উপরে উল্লেখিত কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি কী ধরনের ট্রমা অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, কতখানি সময় সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকেছেন এবং তার পূর্বের মানসিক অবস্থার ওপর। তবে ওপরে উল্লিখিত লক্ষণগুলো কিছু যদি দেখা যায় তবে অবশ্যই ব্যক্তির জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন হবে। মনে রাখতে হবে, ট্রমা অভিজ্ঞতা সব বয়সের মানুষের, এমনকি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষকেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।

আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে এটা খুবই সম্ভব অসংখ্য মানুষ ভয়াবহ ট্রমা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তীব্র মানসিক আঘাত পেয়েছেন।

এই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যাঁরা অগ্রাধিকার পেতে পারেন— ১. যেসব পরিবারের কোনো সদস্য নিহত হয়েছে, সেই পরিবারের সদস্যদের যাঁরা তীব্র অবসাদে ভুগছেন। ২. যেসব শিশু, কিশোর–কিশোরী আহত হয়েছে, নির্যাতনের শিকার হয়েছে বা জেল খেটেছে। ৩. যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন, হত্যা, গুলিবর্ষণের ঘটনাগুলো দেখেছে এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।

একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে এই মানুষসহ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব মানুষের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার আবেদন জানাচ্ছি।

  • কামাল চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক