By using this site, you agree to our Privacy Policy.

বাংলাদেশ ২.০: কোন পথে যাবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত

বাংলাদেশ ২.০: কোন পথে যাবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত

বাংলাদেশ যেন আবার নতুন করে স্বাধীন হলো। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট উদিত হলো স্বাধীনতার দ্বিতীয় সূর্য, জন্ম হলো বাংলাদেশ ২.০-এর।

বৈষম্যহীন বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির পথচলা কেমন হবে, সেটি নিয়ে সবার ভেতরে একটি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কারণ, এই তথ্যপ্রযুক্তি দিয়েই বিগত সরকার তরুণ প্রজন্মের ভেতর একটি উদ্দীপনা তৈরি করেছিল। সবার মধ্যেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, বর্তমান সরকার কি তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে?

শুরুতেই বলে রাখি, নতুন বাংলাদেশে আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই। তাই আগের সরকার ভালো যেসব কাজ করেছে, সেগুলোকে যেমন অস্বীকার করতে চাই না; তেমনই বর্তমান সরকার ভুল কিছু করলে, সেটার সমালোচনা করা যাবে না, এই নীতিতেও বিশ্বাসী থাকতে চাই না।

সন্দেহ নেই, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য বিগত সরকার বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছিল।  বিশেষত এই সেক্টরের কর অব্যাহতি সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আন্তরিকতা ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা রপ্তানির ওপর নগদ সহায়তা প্রদানে তাদের উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য।
কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে যেটি বিবেচনা করা হয়, ‘দক্ষ মানবসম্পদ’, এর জন্য বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যত সেসব ট্রেনিং প্রোগ্রামের ফল ছিল শূন্য।

বলে রাখা ভালো, বিভিন্ন ট্রেনিং প্রজেক্টের নামে গত ১০-১২ বছরে আইসিটি ডিভিশন থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নেওয়া হয়।  কিন্তু সেসব প্রজেক্ট থেকে ৪০০-৫০০ ও দক্ষ লোক তৈরি হয়েছে কি না সন্দেহ। অভিযোগ আছে, যারা কাজ পেয়েছিল, তাদের অধিকাংশকেই মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়েই কাজ পেতে হতো।

আবার সাবেক প্রতিমন্ত্রী সাহেবের সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ ট্রেনিংয়ের  কাজ পেত না, এমন অভিযোগও অনেক পুরোনো। নতুন সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকবে, প্রতিটি ট্রেনিং প্রজেক্টের আবার অডিট করা। সাধারণ মানুষের করের টাকায় করা এসব ট্রেনিং প্রকল্পে কেন হরিলুট হলো, কেন ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ কোম্পানিগুলো এখনো দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে ভোগে, তার পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।

নতুন সরকারকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে, আর কেউ কখনো যেন ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে না পারে। মহাখালীতে একটি ভবনে আগুন দেওয়ার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে, এমন তথ্য গত সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হলেও পরবর্তী সময় এটি জানা গেছে, সরকারের নির্দেশনাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্বয়ং সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী সাহেবই ইন্টারনেট বন্ধের জন্য ফোন দিয়েছিলেন বলে প্রথম আলোতে গত ১৩ জুলাই প্রতিবেদন বেরিয়েছে। সরকারের একজন দায়িত্বশীল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এভাবে মিথ্যাচার করা জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল বলে সাধারণ মানুষ মনে করে।

১৮ জুলাই থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ইন্টারনেট এবং একই সঙ্গে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ থাকায় এই শিল্পে যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত যেসব কোম্পানি সফটওয়্যার রপ্তানি করে অথবা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে, তাদের ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

অনেক কোম্পানির ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল হয়েছে, অনেক ফ্রিল্যান্সারের চুক্তি বাতিল হয়েছে, ইন্টারনেট না থাকার জন্য নির্ধারিত সময়ে কাজ ডেলিভারি করতে না পারার কারণে মার্কেটপ্লেসে অনেকের রেটিং খারাপ হয়ে গেছে। আইসিটি সেক্টরের প্রধান ক্রেতা মূলত ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। তারা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে বিকল্প হিসেবে ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকছে বলে শোনা যাচ্ছে।

গত কয়েক দশকে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেভাবে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছিল, এই ইন্টারনেট বন্ধ করার কারণে সব অর্জনই নষ্ট হয়ে গেল।  তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হোক, ইন্টারনেট বন্ধ করে আমরা আর হত্যাযজ্ঞ দেখতে চাই না।  তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেট এখন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতোই অতীব প্রয়োজনীয় একটি জিনিস। উল্টো দিকে জনগণের করের টাকায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ফোনে আড়ি পাতার জন্য শতকোটি টাকার যে সফটওয়্যার কেনা হয়েছে, সেগুলোও বন্ধ করা উচিত।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই মুহূর্তে দক্ষ মানবসম্পদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের দেশ এবং আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ব্র্যান্ডিংয়ের। বলে রাখা ভালো, এ মুহূর্তে আমরা এমন একজন মানুষকে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছি, সেই ড. ইউনূসকে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব মানুষই একনামে চেনে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই কালজয়ী অর্থনীতিবিদকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, সেটি হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু তিনি প্রধান উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় যদি আমরা আমাদের দেশ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ইন্ডাস্ট্রির ব্র্যান্ডিংকে অন্য উচ্চতায় না নিতে পারি, সেটি হবে আমাদেরই ব্যর্থতা।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে আমাদের এখন মনোযোগী হতে হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিক, ব্লক চেইন, ইন্টারনেট অব থিংসের মতো প্রযুক্তির দিকেও। ২০১৮ সালে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রপ্তানি আয় ছিল ১ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে এসে এই খাতের আয় এসে দাঁড়িয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত পাঁচ-ছয় বছরে এই সেক্টর থেকে আয় সে রকম আশানুরূপভাবে বাড়েনি। এর একটি বড় কারণ হতে পারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের টেকনোলজিগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগী না হওয়া। তাই আমাদের এখন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে আর ট্রেনিং প্রোগ্রাম ডিজাইন করতে হবে এসব প্রযুক্তিকে সামনে রেখেই।

শুধু বেসরকারি দক্ষ মানবসম্পদ নয়, নজর দিতে হবে সরকারের আইসিটি প্রফেশনালসের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকেও। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/ বিভাগ/ অধিদপ্তর/ দপ্তর/ সংস্থায় বিচ্ছিন্নভাবে নিয়োজিত এসব আইসিটি কর্মকর্তাদের সুনির্দিষ্ট  কোনো দায়িত্ব/ কর্মবণ্টন, পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ বদলি/ পদায়ন/ পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই। সরকারি আইসিটি কর্মকর্তাদের ক্যাডার সার্ভিস গঠন এবং আন্তমন্ত্রণালয় বদলির দাবি দীর্ঘদিনের। জানা গেছে, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেটি আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের সেবা অটোমেশনের ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব আইসিটি উইংয়েরও দক্ষতা বৃদ্ধি ও ক্ষমতায়ন দরকার। আশা করি বর্তমান সরকার তাদের দাবির দিকে সুনজর রাখবে।

সরকারি বিভিন্ন সফটওয়্যার প্রজেক্টে কনসালট্যান্ট হিসেবে দৌরাত্ম্য কমাতে হবে একাডেমিশিয়ানদের। বলে রাখা ভালো, তাঁরা তাত্ত্বিক জ্ঞানে যথেষ্ট দক্ষ হলেও ইন্ডাস্ট্রি সম্বন্ধে বাস্তব জ্ঞান না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের জন্য অনেক প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। বিগত দিনে এ রকম বেশ কিছু ঘটনা আমরা দেখেছি।  বরং মনোযোগী হতে হবে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কলাবোরেশনের দিকে, যেখানে আমাদের শিক্ষক আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবেন।  তৈরি করতে পারবেন সর্বাধুনিক কারিকুলাম।

সরকারি সেবা অটোমেশনের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার। এর আগে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানির নিয়োগের ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হয়, সেটি আমরা দেখেছি।  যদি বিদেশি দাতা সংস্থার কোনো প্রজেক্টে এমন কোনো দিকনির্দেশনা থাকে যে সেই দেশের কোম্পানিকে কাজ দিতে হবে, অন্তত তার সঙ্গে যেন দেশের কোনো কোম্পানি জয়েন্ট ভেঞ্চারে থাকতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সফটওয়্যার ক্রয়ের জন্য আলাদা টেমপ্লেট প্রণয়ন করাও জরুরি, যাতে সফটওয়্যার ক্রয়ের ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিত হয়। বলে রাখা ভালো, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বেসিস থেকে সফটওয়্যারে ক্রয়ের প্রস্তাবনা ২০২১ সালে সিপিটিউকে(সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি।

সবশেষ বলতে চাই, আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, যে নতুন শক্তিশালী অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছি, সেখানে পোশাকশিল্পের পাশাপাশি আরও অনেক শিল্প নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি বিশেষত রপ্তানি খাত বলতে গেলে পুরাটাই পোশাকশিল্প-নির্ভর। কোনো একটি বিশেষ খাতের ওপর একটি দেশের অর্থনীতি নির্ভর হয়ে থাকা যে কতটা ভয়ের ব্যাপার, এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ মুহূর্তে প্রয়োজন, অর্থনীতির আরও অনেক স্তম্ভ তৈরি করা আর সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ হতে পারে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত।  প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া এবং দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া সেক্টরটি একদিকে যেমন হতে পারে অর্থনীতির জন্য গেম চেঞ্জার, তেমনই অটোমেশনের ফলে দুর্নীতিও কমবে বহুলাংশে। তাই এই সেক্টরের আগামী ১৫-২০ বছরের রোডম্যাপ তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই তৈরি হোক, সেই প্রত্যাশাই থাকল।

  • রাশাদ কবির সাবেক পরিচালক বেসিস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ড্রিম৭১ বাংলাদেশ লিমিটেড।