হিন্দুরা কেন দেশ ছাড়বে?
সময়টা বড় অস্থির। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন। না, এটা কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নয়। ছাত্রদের হাত ধরে দেশে এক নয়া আন্দোলনের সফল। যে কোনো অস্থিতিশীল পরিবেশে সব সময় সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আসে। এটা ইতিহাস থেকে জানা যায়। স্বাধীনতা সময়কাল থেকে শুরু করে এ দেশে যতবার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে প্রত্যেকবারেই সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়েছে। এটা যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়েছে এমনটি নয়। সময় এবং দেশ ভেদে এই নির্যাতিত হয়ে আসছে। এক দেশে যে সম্প্রদায় সংখ্যালঘু, অন্য দেশে সেই সম্প্রদায় সংখ্যাগুরু। কখনো ধর্মভিত্তিক হয়ে থাকে, কখনো বর্ণ ভিক্তিক হয়ে থাকে কখনো বা লিঙ্গভিত্তিক হয়ে থাকে। সব দেশে সব সময় সংখ্যালঘু ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
১৯৪৭ সালে অখন্ড ভারত শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। এ সময় প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুৎ হয়েছিল। প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রান হারিয়েছিল। এই বছরই প্রথম তৎকালিন পূর্ব বাংলার হিন্দুরা নিজের বাস্তু-ভিটা ফেলে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে চলে যায়। নিজের চৌদ্দপুরুষের ভিটে-মাটি ফেলে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। তবে কথা থেকে যায়, সবাইকি চলে গিয়েছিল? না, সাবই যায়নি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে কিছু মানুষ থাকে যারা কখনো সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে না। তারা সমস্যাকে ভয় পায়। শত্রুকে প্রতিহত করতে ভয় পাওয়া কিছু মানুষ তখন পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী হয়ে যায়। এরা অচেনা দেশে নিজের শেকড় গাঢ়তে শুরু করে। কিন্তু আসল শেকড় রয়ে যায় পূর্ববাংলায়। কারো ভাই, কারো বোন কারো আত্মীয়-স্বজন রয়ে যায় পূর্ববাংলায়। সময়ের প্রয়োজনে ক্ষত শুকিয়ে যায় পূর্ববাংলার মানুষের। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় নতুন শেকড় গজানোর অপেক্ষারত পরিবারগুলোর ক্ষত শুকোয় না। তারা একবুক হাহাকার নিয়ে পূর্ব বাংলার সৌন্দর্য্য আর সুখে কাটানো স্মৃতি রোমন্থন করে কেবলই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আরো একবার পূর্ব বাংলার হিন্দুরা ঘর বাড়ি ফেলে দেশ ছাড়ে। এবারও গন্তব্য পশ্চিমবাংলা। পূর্বে চলে যাওয়া মানুষগুলোর কাছেপিঠে আশ্রয় হয় এসময়ে ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর। দীর্ঘশ্বাসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের আদি জনবসতি অর্থাৎ হিন্দুস্থানী বা ঘটিদের কাছে এরা কেবলই বাঙাল হিসেবে গালি খেতে থাকে। কারণ সদ্য উদ্বাস্তু বাঙালদের তখন অভাবে দিন কাটে। এছাড়া ঘটি এবং বাঙালদের জীবন প্রণালীতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি সবেতেই রয়েছে পার্থক্য।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ববাংলা থেকে প্রায় ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। যুদ্ধচলাকালীন ৯ মাস তারা সেখানে আশ্রয় নেয়। তবে ভারত সরকারের আহ্বানে অনেকেই তখন সে দেশে স্থায়ীভাবে রয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরদিন থেকে অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। শুধু তা-ই নয়। প্রত্যেক নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে এ দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হিন্দুরা দেশ ছেড়েছে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে হিন্দুদের একটা কথাই বলেছে, তা হলো মুসলিমদের অত্যাচার। এ দেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা হিন্দু ভোটগুলো নিয়ে সবসময় হিসাব কষে। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তীতে এ দেশে বসবাসরত প্রায় সকল হিন্দু জন্মগত আওয়ামীলীগ করে। এটা অবশ্য এদেশে বসবাসরত মুসলমানদের ধারণা। সুকৌশলে এই ধারণা সকলের মনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যার কারণে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসলে ধারণা করা হতো, তারা কোনো হিন্দুদের ভোট পায়নি। বিএনপি আসলেও ধারণা করতো তারা ভোট পায়নি। সুতরাং প্রত্যেক বারেই নির্যাতিত হয়েছে হিন্দুরা। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দুদের। তাদের উপর নির্যাতন করে দোষ চাপানো হয়েছে অন্য দলগুলোর উপর।
বিজ্ঞাপন
গত ৫ আগস্টের পর দেশের প্রথম পরিবর্তন আনা হয়েছে হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাঙা, আগুন দেয়া, লুট করা দিয়ে। মসজিদে মাইকিং করে হুজুররা এলাকার সকলকে আহ্বান জানিয়েছে সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে। তারা গ্রুপে গ্রুপে পাহারাও দিয়েছে। তাহলে হিন্দুদের উপর নির্যাতন করলো কারা, এমন প্রশ্ন থেকে যায়।
ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য আপনাদের ভাবতে হবে না। এ দেশে বসবাস করা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ দেশের বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। এদেশে শান্তিতে বসবাস করা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। এটা তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা। কোথাও থেকে উড়ে আসেনি। আর কেউ বললেই দেশ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে চলেও যাবে না।
বাংলাদেশে বসবাস করা অনেক হিন্দু পরিবার আছে, যারা মুসলমানদের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করছে। তাদের অনেকের ঘটনা থেকে জেনেছি বা দেখেছি, ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, অথবা শরীকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকার কারণে শত্রুতার জের ধরে নিজের বসতবাড়ি চুপি চুপি মুসলমানদের কাছে বিক্রি করেছে। ওই পরিবার চলে যাবার পরদিন মুসলমান পরিবার তার জিনিসপত্র নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে হিন্দু পরিবারটির পাশের ঘরে বসবাস করার জন্য। এখানে দোষটা কার?
আমার এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত। এখানে কোনো মুসলমানের বসবাস নেই। কিন্তু যতবার বাড়ি যাই, প্রত্যেক বারেই শুনি কোনো না কোনো পরিবার ভারতে চলে গিয়েছে। কারণ জানতে চাইলে বলে, এদেশে থাকা যাবে না। আমি জানতে চাইলাম, অন্যান্য এলকায় তো মুসলমান থাকে বলেই তাদের অত্যাচারে হিন্দুরা দেশ ছাড়ে। কিন্তু তোমরা কেন ছাড়ছো। এখানে কোন স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, হাট, বাজার কোথাও মুসলমান নেই। তাহলে কিসের ভয়ে, কার অত্যাচারে তোমরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছো?
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একবার একজনের বাড়িতে গিয়েছি। গিয়ে দেখি তার পাশের ঘরটি এক মুসলমান পরিবারের। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশ থেকে মুসলমানের ভয়ে চলে আসলে। কিন্তু এখানে এসে তো পাশাপাশি ঘরে বাস করছো। এখন ভয় করে না?
প্রত্যেকবার কোলকাতা গেলে যার সাথে দেখা হয়, প্রথমেই জিজ্ঞেস করে ওদেশের অবস্থা কি? আমি সবসময়ই বলি আমরা ভালো আছি। তোমাদের মতো অন্তত বাঙাল হিসেবে গালি খেতে হয় না। এই যে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করার অর্থ হলো বাংলাদেশের হিন্দুরা কেউ ভালো নেই। এসব অতি দরদী পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বলতে চাই, আপনারা নিজের সুখের কথা চিন্তা করে এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা যারা এদেশে নির্যাতিহ বা উল্লাসে যেভাবেই হোক না কেন, আছি তো! দেশকে ভুলে অন্যদেশে চলে যাইনি। আপনাদের মতো অতটা স্বার্থপর আমরা নই। দেশের দুর্দিনে দেশকে ফেলে, দেশের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন ফেলে নিজের সুখের কথা চিন্তা করে চলে যাইনি।
প্রত্যেক দেশেই সমস্যা আছে। পাকিস্তানে এখনো হিন্দুদের বসবাস আছে। তাদের সঙ্গেও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তাই বলে তারা বাংলাদেশে বা ভারতে চলে যায় না। আবার ভারতে সংখ্যালঘু মুসলামান। তাদের ওপরেও অনেক ধরনের নির্যাতন হয়। তারাও কখনো বলে না দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তবে বাংলদেশ ব্যতিক্রম। এর কারণ হিসেবে আমি অনেক গবেষণা করেছি। যা পেলাম তা হলো, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকরা পূর্বপুরুষদের অতি দরদ।
বাংলাদেশের হিন্দুদের যদি কথায় কথায় পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবার সুযোগ না থাকতো, তাহলে তারা যেতো না। আর এদেশের মুসলমানরাও তাদের কথায় কথায় বলতো না ভারতে চলে যাও। বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারত প্রীতির কারণে এ দেশের মুসলমানদের মনে এখনো ঠিক মতো পোক্ত হয়নি, হিন্দুরা এ দেশেরই নাগরিক। আর হিন্দুরাও নিজেদের রক্ষা করতে শেখেনি। ভারতে স্থায়ী হবার রাস্তা যদি না থাকতো, তাহলে এ দেশে হিন্দুশূন্য হতো না। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দুদের কারণে আমরা এ দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হয়েছি।
ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্য আপনাদের ভাবতে হবে না। এ দেশে বসবাস করা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ দেশের বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। এদেশে শান্তিতে বসবাস করা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। এটা তাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটা। কোথাও থেকে উড়ে আসেনি। আর কেউ বললেই দেশ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে চলেও যাবে না। তাই এদেশে বসবাস করা হিন্দুদের বলছি, চলে যাবার অপশন আজ থেকে বন্ধ করুন। এ দেশটাকে নিজের করে ভাবতে শিখুন। মনে রাখবেন এ দেশ আমার-আপনার-আমাদের সকলের। এ দেশে প্রতিবেশির সুখ-শান্তি এবং সুরক্ষা বজায় রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার।
এইচআর/জেআইএম
বিজ্ঞাপন
সবার আগে জননিরাপত্তা
সবকিছু ঠিক থাকলে আজ ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গতকাল বুধবার (৭ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৬টার দিকে সেনাসদরে বিফ্রিংয়ে এ তথ্য জানান। সেনাপ্রধান বলেন, ‘ড. ইউনূস আগামীকাল দেশে আসবেন। আমি তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করবো। আশা করি আগামীকাল (৮ আগস্ট) রাত ৮টায় অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হবে।’
এসময় সেনাবাহিনী নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হচ্ছে দাবি করে গুজবে কান না দিতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের সঙ্গে আছে এবং থাকবে।
পুলিশ সক্রিয় হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেও জানান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
ইতিমধ্যেই নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সমন্বয়করা তার নাম প্রস্তাব করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও তাতে সায় দেন।
মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে নতুন সরকারের জন্য। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দেশে কার্যত কোনো সরকার নেই। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হয়। ভেঙে দেয়া হয় সংসদ। মহামান্য রাষ্ট্রপতিই নির্বাহী দায়িত্ব পালন করছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলার নিদারুণ অবনতি হয়েছে। রাজধানীর থানাগুলো পুলিশ শূন্য। সেখানে পাহারা দিচ্ছে আনসাররা।মানুষজন নিরাত্তাহীনতায়।সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা হচ্ছে। গতরাতে রাজধানীতে গণডাকাতি হয়েছে। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ছাত্ররা।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পুলিশ ও র্যাবে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি)হয়েছেন মো. ময়নুল ইসলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ ঘিরে পুলিশের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। এই আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ–সহিংসতায় যেসব ছাত্র, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তার প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে আইনে অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে পুলিশকে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আইজিপি বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব মেট্রোপলিটন, জেলা, নৌ, রেলওয়ে ও হাইওয়ে থানার কর্মকর্তা ও ফোর্সকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনসে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে গত ১৬ জুলাই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে দেশে দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। এরপর কোটার দাবি পূরণ হলেও ছাত্র–জনতা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরকার পতনের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের নেতৃত্বে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে গত রোববার (৫ আগস্ট) আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর দেশের নানা জায়গায় থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা দেশের প্রায় সব থানাসহ অন্যান্য কার্যালয় থেকে পুলিশ সদস্যরা চলে যান। এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনাটা এই মুহূর্তের জরুরি কর্তব্য।
এদিকে দেশের পথে রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার (৭ আগস্ট) চার্লস দ্য গল বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় পৌঁছাবেন। ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে এক বিবৃতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তি বজায় রাখার কথা বলেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা নতুন বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করবো। কোনো ভুলে যেন আমাদের এ বিজয় হাতছাড়া না হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি সাহসী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই, যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবস বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে যারা ছাত্রদের এ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা ও স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করছি। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেশটি আমাদের রক্ষা করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নেওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন বিশ্ব বিনির্মাণে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত। অকারণে সহিংসতা করে এ সুযোগটি হারাতে পারি না। সহিংসতা আমাদের সবার শত্রু। অনুগ্রহ করে সবাই শান্ত থাকুন এবং দেশ পুনর্গঠনে এগিয়ে আসুন।
এদিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে অনুষ্ঠিত এক দলীয় সমাবেশে ভিডিও বক্তৃতায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান।দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিশোধ পরায়ণ না হয়ে শান্ত থাকার কথা বলেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা বলছেন। জনপ্রত্যাশাও সেটি। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সংস্কারে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এরমধ্যে থাকবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী নানা পদক্ষেপ। তবে এই মুহূর্তে সবার আগে যেটি করতে হবে সেটি হচ্ছে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ধর্ম-বর্ণ, দলীয়, নির্দলীয় নির্বিশেষে সব মানুষ যেন নিশ্চিন্তে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারেন।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর , জাগো নিউজ।
drharun.press@gmail.com
এইচআর/এএসএম
অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সাত পরামর্শ
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হবার পর এখন চলছে আলোচনা- একটি অন্তর্বর্তী( ইনটেরিম) সরকার গঠনের লক্ষ্যে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা শিক্ষার্থীদের ‘বৈষম্যহীন কোটা সংস্কার’ আন্দোলনে সঙ্গে জড়িত বা সমর্থন দিয়ে রাজপথে এসেছিলেন, তাদের ডাকা হয়েছে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বসে এর কাঠামো গড়ে তোলার আলোচনায়। ওই বৈঠকে ৬ সমন্বয়কারীকেও ডেকেছেন রাষ্ট্রপতি। মাঝখানে আছেন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানগণ।তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শেখ হাসিনার দাম্ভিক আচরণের সর্বশেষ কাজ পদত্যাগ যেমন হয়েছে তেমনি তারা তাকে সেইফ ইক্সজিটও দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন পারিবারিক স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে।তিনি ও তার পারিবারিক স্টেকহোল্ডারগণ (পারিবারিক অংশীজন, যারা হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার ও লুটের ভাগিদার) এখন ভারতের একটি জায়গায় অপেক্ষা করছেন, কোন দেশ তাদের আশ্রয় দেবে সেই জন্য। ইতোমধ্যেই তাদের আশ্রয়ের আবেদন ব্রিটিশ সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। টিভির নিউজের স্ক্রলে সেই খবর আমরা দেখলাম।
একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী। গণঅভ্যুত্থানকে রক্তপাতহীন করতে তাদের সামরিক শক্তির ভূমিকা বিশেষ অবদান রেখেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন যে, সামরিক শাসন জারি হবে এবং তারাই ক্ষমতায় আসবে। অতীত অভিজ্ঞতা সেই কথাই আমাদের শুনিয়েছে। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী ওই দখলের মধ্যে না গিয়ে জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং দেশপ্রেমিক ও সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এই সংস্কার কেবল সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হলেও এর ভেতরে ছিলো এবং আছে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘুণে খাওয়া অংশগুলোর সংস্কার চেতনা ও প্রত্যাশা। ওই প্রত্যাশাই যাতে রাষ্ট্রসংস্কারকে অর্থবহ ও সংস্কৃত করে তোলা যায়, যা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও ভেতরে ভেতরে লালন করছিলেন, তারই বহির্প্রকাশ পেলো তাদের পদক্ষেপে। চাইলে সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন চাপিয়ে দিতে পারতো। এ-রকমটাই আমরা গত ৫৩ বছর ধরে দেখে আসছি। কিন্তু আজকের সেনাবাহিনী সেই রিগেসি গ্রহণ না করে জনগণের প্রতি তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্ব কর্তব্য পালনে দৃঢ়তা দেখালো। সামরিক আইন জারি না করেও যে ছাত্র-জনতার দাবি আদায়ে অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ নেয়া যায়, বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকারউজ্জামান সেটা প্রমাণ করেছেন।
এখন, কোনো সরকার নেই বললেই চলে। সব অফিস আদালত খুলে দেয়ায় জনমনেও একটা স্বস্তি এসেছে। সেই স্বস্তি আর রাজনৈতিক অস্তস্তির \ফোকড় গলিয়ে কিছু খারাপ লোক নানা গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলা করবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সচিবালয়ে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেহেতু তারা বিগত হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, ফলে তাদের ওপর কিছু মানুষের রোষ চেপেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আবেদন হচ্ছে কোনো রকম প্রতিশোধ নয়, কোনো রকম হিংস্রতা নয় ভালোবাসা দিয়েই তাদের বিগত কাজগুলোকে ঢেকে দিতে হবে। কোনো রকম ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ নয়, প্রতিহিসাংত্মক আচরণ নয়, গণঅভ্যুত্থাণে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করতে তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোতা দিতে হবে। আর সেটা হচ্ছে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে বহুদলীয়, বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন ন্যায় ও কল্যাণবোধের উদ্ধোধন। ছাত্রজনতা, রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মহীরূহগণকে একটি প্লাটফর্মে এনে জাতীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো গড়ে তালাই হবে যুক্তিযুক্ত। আমরা বিবেচনা করি, সামরিক বাহিনী যখন ক্ষমতা দখল না করে একটি স্বাভাবিক গণপরিবেশজাত কাঠামো গড়ে তোলার আয়োজনে ভূমিকা রাখছে, তাই তাদেরকেও এই অন্তর্বর্তী সরকারে রাখলে ভালো কিছু অর্জিত হবে। কারণ তারা কেবল শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতই নন, তাদের রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার পরিশীলিত ও সামরিক চেতনার সমন্বিত রূপ। তারা আমাদেরই ভাই-বন্ধু বা সন্তান। তারা আমাদেরই সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তারা আমাদের গণতান্ত্রিকতার মূল্য উপলব্ধি করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতটা না মিল-মহব্বত আছে, তার চেয়ে আছে দ্বিমত নিজেদের সামনে তুলে আনার একগুঁয়েমিও। এই ধরনের গোয়ার্তুমি পরিহার করে, সবাই মিলে যদি অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে রাজনীতকগণ নতুন প্রেরণা পাবেন। আমি ছোট করে এই কাঠামোর একটি রূপ বলতে চাই।
ছয়জন সমন্বয়কসহ গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি সুপ্রিম অথোরিটি কমিটি বা কাউন্সিল সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঠামো গঠন করা যেতে পারে। সরকারের যারা থাকবেন তারা যে সব বড় কাজের সিদ্ধান্ত নেবেন, তা সুপ্রিম অথোরিটির অনুমোদন পেলেই তা বাস্তবায়িত হবে। সুপ্রিম অথোরিটির সদস্য সংখ্যা বেজোড় সংখ্যায় রাখা যেতে পারে।সুপ্রিম অথোরিটির সদস্যগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
দুই. জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েই ওই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে হবে।
তিন.নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
চার.তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা যেতে পারে।
পাচ. নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রসংস্কারসহ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পরিপূর্ণ করবেন।
ছয়. নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার আইনি ব্যবস্থা করতে হবে, যা কখনোই বাতিল করা যাবে না। কেবল খাতা কলমে নয়, নির্বাচনকে রিগিংমুক্ত করতে হলে আইনের ব্যবহার করা জরুরি। জনবিরোধী ও দেশের ক্ষতি হয় এমন আইন ও মানবাধিকার কর্ব বা লঙ্ঘন হয় এমন আইন বা কাজ করা যাবে না।
সাত. গণমানুষের প্রতি ন্যায় ও সমমযর্দা রক্ষা ও কায়েমের জন্য পুলিশের নৈতিক উন্নতির চর্চা এবং তাদের মানসিক চেতনার বিকাশ অতি জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারের অন্যায় ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। বর্ডার গার্ডকে ভিন্ন মত দমনে রাজধানীসহ কোনো শহরেই আনা যাবে না।
সামাজিক ন্যায় কায়েম করতে হলে প্রশাসনের গলদ ও মানসিকতারও পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কারণ, আমরা দেখেছি রাজনৈতিক সরকার দলীয় পেটোয়া প্রশাসন গড়ে তুলে অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দেশ ও জনগণের ক্ষতি করছেন।
এছাড়াও বহু স্পর্শকাতর বিষয় অনুল্লেখ রাখা হলো যা দুর্নীতিকে পল্লবিত করতে সহায়ক। সেগুলোর মূল উপড়ে ফেলতে হবে।
০৮/০৬/২৪
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস
অবশেষে অবিরাম রক্তহোলির যবনিকাপাত

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের উন্নতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। শহুরে মানুষের বহুতল ভবনের কাঁচের জানালা ভেদ করে রাতের রঙীন আলো দেখা যায় বহুদুর থেকে। বাসায়, মার্কেটে, সরকারী -বেসরকারী অফিসে-ভবনের নিচের পার্কিংয়ে দাঁড়ানো দামী গাড়িগুলোকে রাজকীয় গেইটের ফাঁক দিয়ে দেখে ভিখারীরা যখন ইশারায় ভিক্ষার জন্য দারোয়ানকে ডাকে তখন দারোয়ান তাদের অনেককে উচ্চস্বরে তাড়িয়ে দেয়। সেসব মানুষ অজপাড়াগাঁ থেকে নদীভাঙ্গন অথবা নানা ধরনের অভাবের তাড়নায় শহরে এসেছে বেঁচে থাকার আশায়। রিক্সা চালিয়ে অথবা দিনমজুরি করে যদি পেরে ভাত যোগাড় করে কোনরকমে জীবন বাঁচানো যায় সেই আশায়। কিন্তু শহরগুলোতে উঁচু উঁচু রাস্তা হয়েছে। সেগুলোতে রেল দৌড়ায়, পিচ্চি গাড়িগুলো সাৎ সাঃ করে চলে যায়। আজকাল শহরের মানুষগুলো তাদের রিক্সায় উঠে না। দীর্ঘসময় অবরোধ, সাট ডাউন হওয়ায় কাজের সন্ধানে রাস্তার মোড়ে রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের কাজ নেই। বাঁচার উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরে এসছিল যে আশাকে বুকে বেঁধে, সেটা এখন গুঁড়েবালির মতো মনে হচ্ছে।
অজপাড়াগাঁয় বিদ্দুৎ লাইন গেছে কিন্তু সেসব আসমানীদের সম্বল ছোট্ট ভিটার ভাঙ্গা ঘরে সংযোগ নেয়া যায়নি। পেটের ভাত যোগাড় করাই দায়, বিদ্দুৎ বিল দেবে কিভাবে? একটা বাল্বের মাধ্যমে পাশের বাড়ি থেকে সংযোগ নিলেও দুইশত টাকা দিতে হয়- সেটাই বা যোগাড় করবে কিভাবে? অনেক কাঁকুতি-মিনতি করেও তারা নদী পাড়ের সরকারী আশ্রায়ণে ঘর বরাদ্দ পায়নি। সেখানে তালিকায় নাম লিখেছিল। পরে চাহিদা মতো ঘুস দিতে পারেনি বলে নাম কেটে আরেকজনকে দিয়েছে। গ্রামে তাদের উপার্জন করার মতো কোন উপায় নেই। তাই শহরে গিয়ে ভালভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরিবার নিয়ে ভাসতে ভাসতে এখন অসুখে পড়ে হয়ে গেছে পথের ভিক্ষুক। রাস্তার মোড়ে বসে ভিক্ষা করতে হলে চাঁদা দিতে হয় সেখানকার মাস্তানকে। বাসাবাড়িতে গিয়ে ভিক্ষা করার উপায় দিনে দিনে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু শহরের বড়লোকেরা ভীষণ কঞ্জুস! তারা সাহায্য অথবা দান করার জন্য দরজা খোলে না। শুক্রবারেও বাড়ির দরজা খুলতে চান না তারা। কেউ কেউ আমাদের চিল্লাচিল্লি শুনে পাঁচ দশটাকা ছুঁড়ে মারেন উপরের তলাগুলো থেকে। এসব ভিতরের কথা অনেকগুলো শহুরে ভাসমান মানুষের। যা আজকাল বিত্তশালীরা অনেকেই পাত্তা দিতে চান না। কিন্তু এটাই চরম বাস্তবতা।
তারাও শিক্ষার্থীদের ডাকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে শরীক হয়ে মাঠে নেমে গেছে। জুলাই তিন তারিখের বিকেলে রাজধানীর শহীদ মিনার চত্ত¡রে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমাগম হয়েছে। হয়েছে অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ সমাবেশ। যা হয়তো কেউ কখনোই দেখেননি। ছাত্রাবস্থায় একুশের রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রোভার স্কাউটের দায়িত্ব পালন করেছি বহুবার। সেখানে মানুষ লাইন ধরে ফুল দিতে আসে। কিন্তু আজ যেন এই জনতার কি হয়েছে!
মানুষের সারি মিশতে মিশতে একাকার হয়ে জনসমুদ্র গেছে। শহীদ মিনারে আসার সব পথ মানুষের মাথায় গিজ গিজ করছে। ড্রোন দিয়ে ভিডিও করে টিভি-তে সরাসরি দেখানো হচ্ছে। শুধু মানুষ আর মানুষ। তাদের একটাই দাবী। সরকারের পদত্যাগ চাই। মানুষের মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত সব ক্ষোভ, সব অভিমান, রাগ, উষ্মা, জমানো অভিযোগ একাকার হয়ে একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত বাক্যে রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অবিলম্বে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চাই।
দেশের শিক্ষার্থী, অবিভাবক, শ্রমিক, সাঁইত্রিশটি পেশাজীবি সংগঠন তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। রিক্সাওয়ালারা পশের পাশে রিক্সা থামিয়ে তার উপরে দাঁড়িয়ে কোরাস গাচ্ছে। গায়ক সমাজ নিজেদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দ্রোহের গান গাচ্ছে। সবার সাথে ভিখারিণীকেও শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় নাচতে দেখে মনে হচ্ছে নব্বই-এর গণ আন্দোলনের চেয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তেজ বহু বহুগুণ বেশী জোড়ালো হয়ে জনগণের প্রাণের দাবীতে রূপ নিয়ে ফেলেছে।
সরকারী কর্তৃপক্ষ এতদিনে গণজাগরণের সম্বিত ফিরে পেয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের সাথে আলাচনার জন্য বসতে চেয়ে আহবান জানিয়েছেন। নব্বই-এর সামরিক সরকারের শেষ সময়ে একই ধরনের আর্জি বা আঁকুতি প্রচারিত হতে দেখা গিয়েছিল বিটিভি-তে। আজ ২০২৪ সালে এসে কিছু পোষা টিভিতে একই ধরনের আঁকুতি শোনা যাচ্ছে। নিজেদের বিবেক বন্দক রেখে গুটিকয়েক টিভি তথা গণমাধ্যম সরকারের অনেক অন্যায় কাজকে ভাল বলে প্রচার করছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনে জুলাইয়ে নিহতদের সঠিক সংখ্যা প্রচারে কপটতা প্রদর্শণ করায় তারা বিদেশী গণমাধ্যম ও দেশের জনগণের নিকট ধরা খেয়ে গেছে।
দেশের বর্তমান অচলাবস্থার জন্য সরকার বিচলিত হলেও এই ধরনের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হীনতায় দেশের কর্ণধারকে অন্ধকারে রেখে প্রকৃত চিত্র আড়াল করার জন্য আজকের এই দুর্বিসহ অবস্থা তৈরী হয়েছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।
কারণ, তারা অনেকে চোরের থাপইত কেউ কেউ চোরের সাগরেদ হিসেবে হিসেবে কাজ করেছেন। চোরের সাগরেদরা যতদিন মধু পেতে থাকে ততদিন থাপইতদের সাথে বিচরণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখলেই সটকে পড়ে। চোরে থাপইত, সাগরেদ বাটপাদের রাজত্ব কায়েম হবার পলে দেশের সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। আমাদের দেশে কার্যত: সেটাই ঘটেছে।
যার ফলে বেনজির, মতিউর, শিকদার, হালদার ইত্যাদি মেগা-দুনীতিবাজ, মেগা-চোর ও ভয়ংকর ক্ষমতালোভী ডাকাতদের ব্যাপক উথ্থান হয়েছে। যাদের পদ ও দুর্নীতি এই দুয়ের সমন্বয়ে দ্বৈত ক্ষমতায়নের সুবাদে সাধারণ মানুষ কোন সেবা পায়নি। শুধু নির্যাতিত হয়েছে। তারা বড় বড় ব্যবসায়ীদের করের টাকা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়ে ঘুসের বিনিময়ে নিজেদের সম্পদ বনিয়েছে। তারা মানুষের জমি, সম্পদ দখল করে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, বিদেশে ৩০০ বড়ি, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করলে তাদের ভয়েও জনগণের কেউ টুঁ-শব্দ করার উপায় খুঁজে পায়নি। তাদের দ্বৈত পেশাদারী দুর্নীতির ভূমিকা পালনে সহায়তা করেছে নমিনেশন কিনে ক্ষমতা বাগানো কিছু চরম অসৎ রাজনীতিক।
তাদের দাপটে, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নীতিবানরা কেউ টু-শব্দ না করলেও ছাগল কান্ডের মতো ন্যাচারাল টু-শব্দে গোমর ফাঁক হতে শুরু করলে সরকার সহ ওরা সবাই বিব্রত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তারা এতদিন জনগণকে বঞ্চিত করলেও প্রকৃতি এবার তাদের বোকা বানিয়ে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর আন্দোলনের প্রেক্ষিত তৈরি করে দিয়েছে বলে অনেক গুণীজন মনে করছেন। এটা আঁচ করতে পারলে দুর্নীতিবাজরা পলায়ন করতে থাকে এবং থাপইতরা গা বাঁচানোর জন্য মিথ্যে প্রচারণা শুরু করে দেয়।
এসব চোরদের দুর্নীতিতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আজকের আন্দোলন। যেটাকে সাধারণ মানুষ তাদের মনের কথা প্রকাশ করার মোক্ষম উপায় মনে করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলকে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ একবার প্রতিবাদের সুযোগ পেলে তারা জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রতিবাদে শামিল হয়। সম্প্রতি শত শত কঁচি প্রাণের মৃত্যু এটাই প্রমাণ করে।
কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা তাদের বক্ত্যবে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর কোনো আলোচনায় বসার পরিকল্পনা নেই তাদের। তাদের একটাই দাবি এখন। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ চাই।
আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা বলছে, পদের লেবাসে চুরি করা, আইনের লেবাসে চুরি-ডাকাতি করতে সহায়তা করে বিপুল সম্পদ অর্জন ও আরো বড় পদ বাগানো একই সূত্রে গাঁথা। আইনের লেবাসে চুরি করে ফুলে ফেঁপে উঠায় পানি গড়িয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতা সব জায়গায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্র হারিয়েছে রাজস্ব, দরিদ্র মানুষ হয়েছে আরো দরিদ্র। সর্বপোরি তাদের ব্যর্থতায় সামান্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের গতিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত হবার সুযোগ দিয়ে এতগুলো মূল্যবান প্রাণহানি হয়েছে। জুলাই ২০২৪ ম্যাসাকারে শত শত হত্যকান্ডের পর আগষ্টের চার তারিখে সন্ধ্যে নাগাদ একদিনেই ৭২ আন্দোলনকারী ও সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে ১৩ পুলিশ সদস্যও প্রাণ হারিয়েছে। এত রক্তপাতের শেষ কোথায় তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত। এই অবিরাম রক্তহোলির শেষ কোথায়, কবে? আশ্চর্যের বিষয় হলো এই লেখাটি লিখে শেষ করার আগেই (আজ ০৫ জুলাই সোমবার দুপুর আড়াইটায়) টিভিতে দেখলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গদত্যাগ করেছেন। তিনি ছোট বোনসহ হেলিকপ্টার যোগে দেশ ছেড়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শহর ত্রিপুরার আগরতলায় চলে গেছেন।
কিন্তু দেশের সম্পদ ধ্বংস হবার পাশাপাশি অনেক তার বিচক্ষণতাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের শোকে, দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে গোটা জাতি। কোনো আশ্চর্য ওষুধে এই জনশোক প্রশমন করার উপায় নেই। আন্দোলনকারীরা কারফিউ প্রত্যাখ্যান করে রাস্তা দখল করে উল্লাস করছে, তারা বাকি দাবিগুলো আদায়ে অনড় রয়েছে। এরপরও এত রক্তপাতের হোলিখেলায় যারা উন্মত্ত হয়ে পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন তাদের শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্য দিনক্ষণ বেঁধে দেয়া নেই। তাদের বিচারের অপেক্ষার পালা দ্রুত শেষ হবে কি?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএস