ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আবরার ফাহাদ হত্যা: শিবির স্টাইলে ছাত্রলীগের রাজনীতি

আনিস আলমগীর | প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০১৯

ফেসবুক নিউজ ফিডে খবরটি প্রথম চোখে পড়ে। হেডলাইন পড়ে মনে হয়েছিল বাইরের কাউকে হলে ডেকে নিয়ে বাদানুবাদের ঘটনায় বুয়েটের ছেলেরা মেরেছে। পুরো খবর পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। আবরার ফাহাদ নামের একজন সহপাঠী কিংবা তাদের বুয়েটেরই ছোট ভাইকে দলে বলে সবাই পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলল! তাও শুধুমাত্র ছেলেটির ফেসবুক স্ট্যাটাস, চিন্তাধারা তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়েছে বলে। মৃত্যুতো সহজ জানতাম, সেকেন্ডের ভরসা নেই, কিন্তু এবার জানলাম মানুষ মারাও সামান্য ব্যাপার! একজন সহপাঠীকে তার ফেসবুক স্ট্যাটাস পছন্দ হয়নি বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়! বাহ! কী অবাধ ক্ষমতা। কী অফার শক্তি। যেন কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করে বিরক্ত করছিল কোনও মশা। এক থাপ্পড়ে মারার মতোই সহজ।

স্যোশাল মিডিয়ায় কারও প্রতি বিরক্ত হলে তাকে শেষ করে দেওয়ার তরিকা আছে। ব্লক করে দাও। ‘হারামজাদাকে’ দেখতে হল না। কিন্তু আবরারতো শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই, তাদের চোখের সামনেও আছে। তাকে যেহেতু হাতের কাছে গো বেচারা হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, বাস্তবে ব্লক করে দিতে সমস্যা কোথায়! শুধু সোশ্যাল মিডিয়া না, দুনিয়াতেই চোখের সামনে পড়তে পারবে না সে। হাসতে হাসতে, মারতে মারতে শেষ করে দিয়েছে তারা একটি মেধাবী ছেলের জীবন প্রদীপ। যেই সেই প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের সেরা বিদ্যাপিঠ বুয়েটে পড়তো সে। তারাও সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। ৬ অক্টোবর রাতে রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে তারা বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। রাত ৩টার দিকে শেরে বাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আবরারের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তার বাবা বরকত উল্লাহ একজন এনজিওকর্মী, মা রোকেয়া বেগম কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার বড়। তার ছোট ভাই ঢাকা কলেজের ছাত্র। অতি সাধারণ একটি পরিবারে বেড়ে উঠা ছেলে সে। কত রাত জেগে, কত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাকে বুয়েট পর্যন্ত এনেছে তার চাকুরিজীবী মা বাবা- সেটা শুধু তারাই জানে। আরও জানে যারা এমন সংগ্রাম করছেন নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে। আশ্চর্য হয়েছি আবরার হত্যার ঘটনা শুনার পরপর বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ঘটনাস্থলে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। ছাত্ররা তার চেহারা দেখার দাবি করার ৩৬ ঘণ্টা পর তিনি দেখা দিয়েছেন। একজন ছেলেহারা বাবা যখন তার ক্যাম্পাসে ছিল তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি সে প্রতিষ্ঠান অভিভাবক। তার মাকে ফোন করে সান্ত্বনার বাণী শোনাননি। তার জানাজায়ও শরিক হননি। মুনষ্যত্ব আজ কোথায় ঠেকছে! কাদের হাতে আমরা তুলে দিচ্ছি আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব। ভিসি পদকে ইদানিং যাচ্ছেতাই বানিয়ে দিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর নামের কিছু কুলাঙ্গার।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আট দফা দাবি জানিয়েছে। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা, আবাসিক হলগুলোতে র‌্যাগের নামে এবং ভিন্নমত দমানোর নামে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা, এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি এর অন্তর্ভুক্ত আছে। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছে বুয়েটের শিক্ষক সমিতিও। কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল আবরার ফাহাদের স্ট্যাটাসে, আমি দেখার জন্য আগ্রহী ছিলাম। আমি সত্যি আপত্তির কিছু খুঁজে পাইনি। মামুলি দুটি স্ট্যাটাস ছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান দেনা-পাওনা নিয়ে। কথাগুলো কেউ ভাবতে পারে দেশপ্রেম, কেউ ভাবতে পারে- ভারত বিদ্বেষ। এরচেয়ে কত নিকৃষ্ট কথাবার্তা আমি দেখি পত্রিকার কলাম বা সংবাদ প্রকাশ করা হলে তার নিচের কমেন্ট বক্সে। হাতের কাছে তাদের পাওয়া যায় না। আবরারকে পাওয়া গেছে বলে মেরে ফেলতে হবে? বাক স্বাধীনতাকে দেশে তাহলে এই পর্যায়ে নামিয়েছি আমরা। ভীতির সংস্কৃতি তাহলে আমরা এতটা ছড়াচ্ছি যে প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে করা চুক্তির বিরোধিতা করলে কাউকে জীবন দিতে হবে! কে তাদের এই অধিকার দিয়েছে এমন বিচারের চর্চা করার? রাষ্ট্রতো দেয়নি, সংবিধান দেয়নি। তাদের দলও দেয়নি। তাহলে এমন আশকারা তারা কোথায় পায়?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আবরারের এই মৃত্যু আমাকে মনে করিয়ে দেয় শিক্ষাঙ্গনে বাহুবল আর নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের দেখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের হত্যার রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকি হানাদারদের সহযোগী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ স্বাধীন দেশে ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় জবাই করে হত্যার রাজনীতি শুরু করে তারা চট্টগ্রাম থেকে। ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে শিবির ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস, ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিরিচের এলোপাথাড়ি কোপে মুমূর্ষু তবারক যখন পানি পানি করে কাতরাচ্ছিল তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়।

১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫ নম্বর কক্ষে শিবিরের কর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে। তার সহপাঠী, শিবির কর্মী রুমমেট এতে অংশ নেয়। কী ভয়াবহ হিংস্রতা! ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হায়নারা জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের ডান হাতের কবজি কেটে নেয়। পরবর্তীতে ওই কর্তিত হাত বর্ষার ফলায় গেঁথে তারা উল্লাস প্রকাশ করে। শিবির একে একে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে তাদের এই হত্যাযজ্ঞ আর রগকাটার রাজনীতি চালু করে। এইতো ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ্ মখদুম হলের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে হত্যা করে পৈচাশিক কায়দায় ম্যানহোলের ভিতরে ফেলে রেখে যায় শিবির ক্যাডাররা। তার হাত-পায়ের রগ ছিল কাটা।

বিজ্ঞাপন

রুমে ডেকে নিয়ে এই কায়দায় টর্চারের রাজনীতি ছাত্রলীগে কখন ঢুকেছে আমি জানি না। তবে এখনও এইটুকু বিশ্বাস আছে হত্যার উদ্দেশ্যে নয়, ক্ষমতার দাপট দেখাতে হয়তো তারা এটা করেছে, যেটি গড়িয়েছে মৃত্যু পর্যন্ত। ছাত্রলীগকে এই ক্ষমতা তো কেউ অর্পণ করেনি যে তারা ভিন্নমতের লোক হলে শিবির স্টাইলে তাকে রুমে ডেকে নিয়ে টর্চার করবে! এমনকি একটা লোক শিবিরের রাজনীতি করলেও তারা সেটা পারে না। শিবিরকেতো নিষিদ্ধও করা হয়নি এই দেশে। তাহলে ছাত্রলীগের আর শিবিরের রাজনীতির যে তফাৎ আছে ছাত্রলীগ নামধারী এইসব অর্বাচীনরা তাকে কি ঘুচিয়ে দিতে চায়?

আমি অবশ্য এই হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার বিরুদ্ধে, কারণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে হত্যাকারীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া সহজ হয়। শিবির ভিন্ন মতের লোকদের হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করতো। তারা কখনো এইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সংগঠনের নেতা-কর্মিদের জবাবদিহি করতে বলেছে, বহিষ্কার করেছে শুনিনি। করেনি। বরং পুরস্কৃত করেছে। ঝামেলায় পড়লে তাকে এবং তার পরিবারকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়েছে। হাতুড়ি, রড, ইট, মুগুর দিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেয়া, রিকশার স্পোক কানের ভেতর ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মগজ বের করে আনা, হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া, চোখ উপড়ে ফেলা, মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলা, কব্জি কেটে নেয়া, কিরিচ, ছোরা, কুড়াল ব্যবহার করে হত্যা করার মতো নৃশংসতা এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল শিবিরের নামের সঙ্গেই যুক্ত। অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে শিবিরের মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে শিবির সরাসরি হত্যার মিশনে নামে। যাকে আঘাত করে তাকে চিরতরে পঙ্গু-অচল করে দেয়। অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদেরকে সাবধান করে। এজন্য শিবিরের নৃশংসতার সঙ্গে অন্য কারো তুলনা হয় না।

অন্যদিকে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রেীয় নেতৃত্ব এ ধরনের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের অপকর্মকে নিজেদের ঘাড়ে নিতে চায় না। অপকর্ম হিসেবে দেখে। বুয়েটের ঘটনাও তারা সেই চোখে দেখছে এখন পর্যন্ত। যারা জড়িত ছিল তাদেরকে বহিষ্কার করেছে। সরকার তৎপর হয়েছে, পুলিশ দুষ্কৃতিকারীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে। কোনো পক্ষ থেকেই হত্যাকারীদের পক্ষে কেউ দাঁড়ায়নি। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে ছাত্রলীগ নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য শিবির স্টাইলে রাজনীতি করবে কেন? ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। তাদের কর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন ও নির্যাতনের অনেক ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বার বার সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। সংবাদ মাধমে এসেছে, যারা এরকম ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি নিজের দলের অনেক নেতা-কর্মীও রয়েছেন।

গত ৮ অক্টোবর ২০১৯ দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। প্রথম আলোর হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন। ২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন। ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ।

বিশ্বজিৎ হত্যার স্মৃতি এখনও তাজা। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে দিনে দুপুরে খুন হন ওই এলাকার একটি দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাস। সেদিন বিএনপির-নেতৃত্বাধীন ১৮-দলের অবরোধ কর্মসূচি চলছিলো। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কুপিয়ে প্রকাশ্যে মারা হয়। বিশ্বজিতের অনেক খুনি এখন মুক্ত, অনেকের ফাঁসি মওকুফ হয়ে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। অতিসম্প্রতি বরগুনায় রিফাত কে যারা হত্যা করেছে তারাও ছিল ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাস্তান। গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের অনেক সহকর্মীকে হত্যা করেছে নানা তুচ্ছ কারণে, টেন্ডারবাজিসহ নানান চাঁদাবাজির ঘটনায়। যখম কত করেছে তার হিসাব রাখা কঠিন।

আমার বিশ্বাস, আবরার হত্যায় জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা পাবে কিন্তু এটাও জানি শিবির স্টাইলে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের এই কালচার যদি শিক্ষাঙ্গন থেকে না যায়, সরকারি ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের গুন্ডা পান্ডারা এখন যে নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করছে তা না থামলে আরও বহু আবরার ফাহাদ মারা যাবে। আমরা একটি ঘটনা লিখতে আরেকটির উদাহরণ দিয়ে যাবো শুধু।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
anisalamgir@gmail.com

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

পরবর্তী খবর

সম্রাট নাটকে ফ্লপ পূর্ণদৈর্ঘ্য রঙিন ভোট

মোস্তফা কামাল | প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০৯ অক্টোবর ২০১৯

সম্রাট, ক্যাসিনো, খালেদ, শামীম, লোকমান, অভিযানের হিড়িকে রংপুর-৩ উপনির্বাচন বাজার পায়নি। এতো বড় একটি জাতীয় নির্বাচন সত্বেও মিডিয়াগুলো একে তেমন ট্রিটমেন্ট দেয়নি। পত্রিকাগুলো রংপুরের নির্বাচনের খবরকে সিঙ্গেল বা ডাবল কলাম করেছে। কোনো কোনো পত্রিকা এ খবর নিয়ে গেছে ব্যাক পেজে। আর টিভিগুলো দিয়েছে একেবারে শটকার্ট খবর। পাঠক-দর্শক-শ্রোতা তথা বাজারদৃষ্টেই খবর বাজারজাত করে গণমাধ্যমগুলো। এ ক্ষেত্রেও আসলে তা-ই হয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে মানুষের গরজ হারিয়ে গেছে কবেই। নির্বাচন গেছে নির্বাসনে। কারো কাছে ভোট-নির্বাচন এখন জাদুঘরের আইটেম। এর চেয়ে হালনাগাদ বা আপডেটের দিকে ঝোক বেশি। তা-ও আবার জুয়া, ক্যাসিনো, টাকা, দাপট, হিরোইজমের কাহিনী। সঙ্গে নারী থাকলে আকর্ষণ আরেকটু বেশি। অথচ বাংলাদেশের নয় বছরের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনটি নিয়ে মানুষের একটুআধটু গরজ থাকলেও থাকতে পারতো। নানা কারণে সেটি হয়নি। এ নির্বাচনটির ফলাফল কি হবে তা মানুষ আগেই জেনেছে। কেউ কেন্দ্রে না গেলেও ভোট হবে, নির্বাচন হবে। সরকারি মহল এবং নির্বাচন কমিশন থেকেও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। হয়েছেও তাই। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলো পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা।

এরশাদপুত্র সাদ নির্বাচিত হয়েছেন না নির্বাচিত করা হয়েছে-সেটাও বুঝতেও কারো বাকি নেই। গরজ না থাকায় রংপুরে ভোটের এমন খরার রঙিন বায়োস্কোপের দর্শকও মেলেনি। গণমাধ্যমগুলোর কাছেও তা নিউজভ্যালু পায়নি। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে সেখানে ভোট পড়েছে ২১ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। তাতে কিছু যায় আসে না। ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পড়তে হবে, সংবিধান বা নির্বাচনি আইনে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। কাজেই ৪ লাখ ৪১ হাজার ভোটারের মধ্যে ৫৮ হাজার ৮০০ মানুষের ভোটে সাদ বা কারো জয়ে ভুল নেই। ৭৮/৭৯ শতাংশ ভোটারের ভোট না দেয়া বা প্রত্যাখ্যানে লজ্জারও বালাই নেই। কেউ ভোট না দিলেও বা একেবারে বিনাভোটে হলেই বা কি? অবশ্যই তিনি একজন মাননীয়। জাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

মানুষ কেন ভোট দিল না, একটি দেশের নাগরিকরা কেন ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল- সেই প্রশ্ন বরং অবান্তরের পর্যায়ে। ষড়যন্ত্রমূলক প্রশ্ন বললেও কেউ বাধা দেবে না। রংপুরের ভোটের দিন ঢাকায় টিসিবির পেঁয়াজ কেনার লাইনে ছিল মানুষের কিলবিল। ভোটারদের এই কেন্দ্রবিমুখতা কাটাতে প্রার্থী বা নির্বাচন কমিশন থেকেও গরজ দেখা যায়নি। উল্টো আয়েস করেছেন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশন কর্তারা। রংপুরে যখন ভোট চলছিল তখন পাশের লেকে মাছ শিকারে নেমেছিলেন ইসির কর্তারা। কী তামাশা! গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছির ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ। তখন জাতীয় পার্টির এইচ এম এরশাদ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪২ হাজার এবং বিএনপির রিটা রহমান ৫৩ হাজার ভোট। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর এই শূন্য আসনে উপনির্বাচনে ভোটের হার নেমে এল অর্ধেকেরও নিচে।

এ নিয়ে কোনো মহলে ভাব-উদ্বেগ না থাকলেও বাংলাদেশের জন্য বার্তা আছে। রয়েছে ভবিষ্যতে নির্বাচনী ব্যবস্থা আরো কোথায় গিয়ে গড়াতে পারে, সেই বিষয়ক আলামত। যার নমুনা মানুষ দেখেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনেও। নির্বাচনি ব্যবস্থাকে খোঁড়া করে দেওয়ার ঠাণ্ডা কোনো আয়োজন চলছে কি-না, সেই জিজ্ঞাসাও থেকে যায়। নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহ নষ্ট হওয়া গণতন্ত্রের জন্য কতো বড় অশনিসংকেত, বাংলাদেশ কি সেটা ভোগার পথে এগুচ্ছে? সেই তরিকার নির্বাচনের শিকার উত্তর কোরিয়ার জনগন। দেশটিতে পাঁচ বছর পর সংঘাতমুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। উত্তর কোরিয়ায় প্রত্যেক নাগরিককে শাসক কিম পরিবারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। আর এই ভোট সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে করে দেখানোর একটি মাধ্যম। এই নির্বাচনে জয়ী হন সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেম্বলির ৬৮৭ সদস্য।‘ঘাড় ধরে’ ভোট দেওয়ানো ওই নির্বাচনে ভোট কাস্টিং দেখানো হয় প্রায় শতভাগ।

কাকে ভোট দিতে হবে তা ঠিক করে দেয় উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীনরা। সেই ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যে বাক্সে ভর্তি করতে হয় ভোটারদের। একটি পেনসিল রাখা থাকে ভোটারদের জন্য। তিনি চাইলে কোনো প্রার্থীকে ক্রস চিহ্ন দিয়ে তার ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। বাস্তবে এমনটি করার দুঃসাহস কেউ করেন না। জবরদস্তিমূলক ভোটের পর ভোট দিতে পারায় কেন্দ্রের সামনে নেচে গেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে হয় ভোটারদের। সবাইকে নেচে গেয়ে শাসকদের প্রতি সন্তুষ্টির জানান দিতে হয়।

কোরিয়ায় তিনটি রাজনৈতিক দলও থাকলেও দু’টি নামকাওয়াস্তে। দৃশ্যমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই তাদের। ক্ষমতাসীন একচ্ছত্র নেতা কিম জং-উনের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টিই সর্বেসর্বা। জনগণের কথিত ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্টেরও কোনো ক্ষমতা নেই। তারা শুধু সুপ্রিম লিডারের পছন্দ করা আইনকানুন পাস করিয়ে নেন। একক নেতার ইচ্ছার প্রতিফলন করার জন্য এটি একটি রাবার স্ট্যাম্প সংসদ। একের পর এক বাংলাদেশে ভোটের যে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে, তা বিবেকবানদের আহত করছে। ফেলছে নানা শঙ্কায়।

নৃতাত্ত্বিকদের গবেষণায় পাওয়া যায়, আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রিসীয় শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন হতো লটারির মাধ্যমে। আমেরিকার আদিবাসীদের অনেক গোত্রের লোকেরা নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে শস্যকণা ছুঁড়ে গোত্রপতি নির্বাচন করত। প্রাচীন ভারতেও নির্বাচনের বিভিন্ন ধরন পাওয়া যায়। মোঘল শাসনবিধানে স্থানীয় প্রশাসন চালাতেন স্থানীয় মনোনীত ব্যক্তিরা। জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতেন সম্রাট নিজে। অন্য কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করত জনগণ। আর গ্রামের লোকেরা নির্বাচিত করত তাদের মোকাদ্দমপ্রধান, গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারী। গ্রাম মোকাদ্দমদের পরামর্শক্রমে নির্বাচিত হতেন পরগণা কাজী ও থানাদার। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে প্রচলিত গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনধর্মী বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা অঞ্চলের মানুষ নির্বাচনমুখী। এটা তাদের কাছে উৎসবের মত। ঔপনিবেশিক শাসকরা সেটা বুঝেই গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারী, আমীন, মুনসেফ, থানাদার, কাজী ধরনের পদ তৈরি করে। সেগুলো করা হত কোনো না কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থায়ই। সময়ে সময়ে তা বিতর্কিতও হয়েছে কারচুপি, জালিয়াতি পক্ষপাতিত্বের কারণে। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা, ভোট কেনা ইত্যাদির ব্যাপারও ছিল। কিন্তু ঘুরে-ফিরে আবার নির্বাচনেই আসতে হয়েছে।

আধুনিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে। গোপন ব্যালট পদ্ধতির প্রবর্তন ১৮৭২ সালে। আর সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয় ১৯২৮ সালে। বিশ্বে নির্বাচনের ইতিহাসে প্রাচীন অবস্থানে গ্রিস ও রোম। গোটা মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মতো শাসক বাছাইও হতো এ রকম নির্বাচনী ব্যবস্থায়। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই। নির্বাচকমণ্ডলীতেও প্রাধান্য থাকত তাদেরই। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে শুরুর দিকের নির্বাচনে জমিদার বা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল।

খারাপ নির্বাচনের দোষ বা ভালো নির্বাচনের গুণ নির্বাচনের নয়, পদ্ধতির। আরো খোলাসা করে বললে, এর আয়োজকদের। নির্বাচনের কর্তৃপক্ষ, ভোট দেয়া, নেয়া, গণনায় সম্পৃক্তরা সময়ে সময়ে একে কলঙ্কিত করেছেন। নির্বাচনকে বিনাভোটে পর্যন্ত এনে ঠেকানো হয়েছে। নির্বাচনকে একটা সুযোগ বা মওকা হিসেবে নেয়ার লোকের অভাব হয়নি কখনো। এরা আড়ালে থেকে কলঙ্কিত করেছে নির্বাচনকে। কিন্তু অঘটনের জন্য দায়ী করে নির্বাচনকেই নির্বাসনে পাঠানো সম্ভব হয়নি। জনমত নির্ণয়ে প্রচলিত ভোট পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা থাকলেও বিশ্বে এখন পর্যন্ত এর বিকল্প আবিস্কার হয়নি।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

পরবর্তী খবর

শুভ বিজয়া দশমী

সম্পাদকীয় | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০১৯

বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা। পাঁচদিনের এই শারদীয় দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছে আজ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশে প্রতিটা উৎসব-পার্বণ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গোৎসবে সেটি আবার প্রমাণিত হল।

ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয় গত শুক্রবার। ঢাক-ঢোলের বাজনা, কাঁসা, শঙ্খের আওয়াজ এবং ভক্তদের উলুধ্বনিতে এখন মুখরিত থাকে প্রতিটি মন্দির ও পূজামণ্ডপ। এর আগে বৃহস্পতিবার শুরু হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। গোধূলি লগ্নে মন্দিরে মন্দিরে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটে উৎসবের। শনিবার ছিল মহাসপ্তমী। রোববার মহাষ্টমী ও কুমারী পূজা। সোমবার মহানবমী আর আজ মঙ্গলবার বিজয়া দশমী।

আজ বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন ও বিজয়া শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই দুর্গা পূজা। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের কথা জানান দিচ্ছে। এ ছাড়া পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি আর মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা পূজা মণ্ডপগুলো। হিন্দুদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও এসব মণ্ডপে ঘুরতে আসায় উৎসব সার্বজনীন রূপ নিয়েছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা উপলক্ষে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। রাজধানীসহ সারাদেশে ৩১ হাজারেও বেশি পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রতিটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে তাই এক মহামিলন ঘটে সবার। এবারের পূজাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করে উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে- এটি স্বস্তির দিক। সবাইকে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা।

এইচআর/এমকেএইচ

পরবর্তী খবর

‘উইপোকা’ দমনের মাধ্যমেই স্বপ্নপূরণ সম্ভব

ড. আহমেদ আমিনুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০১৯

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ‘ঘরের ভেতর’ থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। এই শুদ্ধি অভিযানকে অন্তকরণ থেকে সাধুবাদ জানিয়েছে এদেশের মানুষ। প্রতিদিন এক একটি অভিযান সম্পন্ন হয়, বেরিয়ে আসে সোনাদানা, টাকাপয়সা, মদ, ইয়াবাসহ নানা জাতের মাদকের খনি (!)। মানুষ প্রতিদিন এসব দেখে আর উৎসাহের সঙ্গে সাধুবাদ জানায়। এসব লোমহর্ষক অভিযান দেখে দেখে স্বস্তিও পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার আমার মতো কেউ কেউ হয়তো এরূপ ভেবেও হয়তো অবাক হয়ে যাচ্ছেন যে, এত টাকা আমাদের দেশে! শুধু টাকা আর টাকা! আমাদের দেশ ভরা এখন টাকা, মদ ও ইয়াবায়। মদ, ইয়াবা এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও কী অবাক বিস্ময়ে বোকার মতো ভাবি আমরা এখন টাকাও রপ্তানি করতে পারি!

একদা এই বাংলাদেশে গোয়াল ভরা গরু ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল- ছিল গোলা ভরা ধান। আর বিদেশে পাট রপ্তানি করে আয় হতো বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। সেজন্য পাটের আরেক নাম হয়েছিল ‘সোনালি আঁশ’। সেসব আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। পরবর্তীকালে গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানির মাধ্যমে আমরা শক্ত করেছিলাম আমাদের অর্থনৈতিক ‘তাগদ’ সক্ষমতা। সেই যুগ আর এই যুগ! সেই সময় আর এই সময়! যুগ পাল্টেছে, সময় পাল্টেছে, পাল্টে গেছে মানুষের সম্পদের ধরনও। একদা মানুষ অর্থবিত্তের মালিক হলে জমি কিনে কিনে কিংবা জবরদস্তিমূলক দখলের মাধ্যমে হয়ে উঠতো জমিদার কিংবা ভূঁইয়া! আর এখন অর্থবিত্তের মালিকরা ‘আকাশ’ কিনেন। আকাশের ফ্রিকোয়েন্সি কিনেন। তাই দিয়ে অর্থাৎ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আকাশের তরঙ্গ কিনে কিনে তারা ‘আকাশদার’ হিসেবে পরিচিত না হলেও টেলিভিশন চ্যানেল খুলে খুলে বিকল্প সব সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। ইদানীং দেখছি ভূমি ও আকাশ থেকে অনেকের মন ওঠে গেছে! তারা এখন পাড়ায় মহল্লায় ক্লাবে সভা-সংঘের আড়ালে গড়ে তুলেছেন জুয়ার ব্যাবসা ‘ক্যাসিনো’ যে শব্দটি বাংলাদেশের আইনের কোনো পুস্তকে নেই বলে দাবি করেছেন মাননীয় আইনমন্ত্রী স্বয়ং।

শুধু ক্লাব বা সভা-সমিতি নয় কোনো কোনো ফ্ল্যাট-বাড়িতেও নাকি ‘ক্যাসিনো’র সন্ধান পাওয়া গেছে। আর তাই দেখে নিন্দুকেরা তির্যক ব্যঙ্গের সঙ্গে একে ‘কুটির শিল্প’ বলে মজা করতেও ছাড়েননি। যাই হোক, মানুষের সম্পদের ধরন পাল্টানোর সাথে সাথে তাই আমদানি রপ্তানির সামগ্রীর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। সমাজের কথিত ক্ষমতাশালীদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বাংলাদেশে এখন বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ও মদসহ নানা জাতের মাদকদ্রব্য আমদানি করা হয়। আবার এদের মাধ্যমেই চোরাই পথে ও অন্যায়ভাবে বিদেশে রপ্তানি তথা পাচার করা হয় এদেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত উপার্জনের টাকা!

বাংলাদেশ যে টাকার দেশ, বাংলাদেশ যে টাকায় স্বয়ংসম্পূর্ণ তা আমরা শুদ্ধি অভিযানের বদৌলতে দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা রপ্তানি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে- অবৈধ উপায়ে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে! এ টাকা রপ্তানি থেকে দেশে ‘আয়’ হয় না মোটেই। টাকা পাচারের মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক ভিত্তি কেবল দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে তোলা হচ্ছে। আর দৃশ্যত এক শ্রেণির মানুষের কাছে বিপুল অর্থ-সম্পত্তি পুঞ্জিভূত হওয়ার ফলে মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে হু হু করে। এত উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে এই ব্যবধান কাম্য হতে পারে না। এই বাস্তবতাটি জননেত্রী বাস্তবতার সঙ্গে উপলব্ধি করেছেন।

ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ব্যবহারের মাধ্যমে কিছুসংখ্যক মানুষ এদেশে টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছেন। বলা হচ্ছে এদের অনেকেই দলের মধ্যে বহিরাগত। কিন্তু বহিরাগত হয়ে দলের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানই শুধু নয়- দলীয় উচ্চ পদে আসীন কীভাবে হলেন সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে এসব পদ পাইয়ে দেওয়ার পেছনেও রয়েছে দলের ভেতরেই ‘সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটের লোকেরাই দলের ভেতরকার শক্তিকে যেমন খুইয়ে ফেলছে তেমনি দলের বাহ্যিক ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবোধক করে তুলছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলার স্বপ্ন এবং উন্নয়নকেও করছে দুর্বল। তাই তিনি ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন তাঁর উন্নয়নকে উইপোকা খেয়ে ফেলছে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী ধরনের নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন তা আমরা তাঁর এরূপ আক্ষেপোক্তি থেকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধিজাত বিশ্বাস থেকে বর্তমানের শুদ্ধি অভিযান। এই অভিযানে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা যেমন উজ্জীবিত হয়েছেন তেমনি উজ্জীবিত হয়েছেন রাজনীতি বিমুখ সাধারণ মানুষও।

আমরা লক্ষ করেছি জননেত্রীর এই একটি বক্তব্যের কারণেই সাধারণের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি। একথা উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, আওয়ামী লীগ কিংবা তার অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা উইপোকা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই সর্বস্তরের উন্নয়নে একদিকে যেমন গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে তেমনি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়াও ত্বরান্বিত হবে। দুর্নীতি দমনে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে ইংগিত দিয়েছেন তাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। জননেত্রীর ওপর সাধারণের এই ভরসাটুকু অক্ষুণ্ণ রাখতে সকল প্রকার চেষ্টাই আওয়ামী লীগের প্রকৃত সৈনিকদের করা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘এই সোনার বাংলা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের এতদিনের সংগ্রামে যারা অন্তরায় হয়ে থাকবেন, যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন, যারা কলুষিত করবেন, দল-মত-আত্মীয়-পরিবার আমি দেখতে চাই না। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার দরকার আমরা সেই পদক্ষেপ নেব।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এরূপ কথায় সত্যি সত্যিই চারদিকে অমোঘ উৎসাহের সাড়া পড়ে গেছে।

চলমান অভিযানে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। যদিও কোনো স্বস্তি নেই আওয়ামী লীগের ঘরের ভেতরকার অনেকেরই। অনেকেরই বলতে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি তাদের জীবনের স্বস্তি শেষ হয়ে গেছে যাদের জীবনের ষোলো আনাই অসৎ পথের উপার্জন রাতারাতি যারা ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’-এ পরিণত হয়েছেন! রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে ভদ্রবেশে সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও এরা অলংকৃত করেছিলেন। এখন সেই পদ রক্ষা নিয়েও শুধু স্বস্তিই হারিয়ে ফেলেননি তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত আইনি প্রক্রিয়ায় পড়ে যাবার আশংকায় আতংকে দিনগুজরান করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নিীতির বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে করে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের গলার পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে বলতে হবে। কারণ এবার তারা সেই উপভোগ্য সুখের প্রাসাদ থেকে নিশ্চয়ই নেমে আসবেন সাধারণ মানুষের কাতারে। সেখান থেকে আরো নিচেই নামতে হবে তাদেরকে।

আমরা প্রত্যাশা করবো কেবল রাজধানী কেন্দ্রিক কার্যক্রমের মাধ্যমেই এই শুদ্ধি অভিযানের সমাপ্তি ঘটবে না দেশব্যাপি এই অভিযানের কার্যক্রম বিস্তৃত হবে। কারণ দেশব্যাপি আওয়ামী লীগ এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের পদ-ধারী নেতাকর্মীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবির সাথে নিজের ছবি যুক্ত করে পোস্টার, ব্যানার টানিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব প্রতিপত্তি জাহিরের মাধ্যমেও অনেকেই বিগত কয়েক বছরে ‘টাকার কুমিরে’ পরিণত হয়ে উঠেছেন। কুমির নয় ভয়ংকর হাঙরই বরং বলা ভালো।

সকল পর্যায়েই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান সক্রিয় থাকলেই কেবল বলা যায় কিংবা বলাটা সার্থক হবে যে, ‘ঘরের ভেতর’ থেকে শুদ্ধি অভিযান প্রকৃতই আরম্ভ হয়েছে। ‘দলীয় বা আত্মীয়’ বলে কোনো ছাড় নয়- সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাতে সাধারণ সম্পাদকের এই ঘোষণায় দেশের মানুষের মনের স্বস্তিবোধ আরো গভীরতর হয়েছে। মানুষ এখন শুধু এসব ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়ন দেখতে চায়। অভিযানের শুরুটা আমরা দেখলাম, আমাদের কাছে ভালো লেগেছে; পূর্বেই বলেছি স্বস্তির কথা- স্বস্তিও পেয়েছি অনেক। এদেশের গুটি কয়েক আতংকগ্রস্ত দুর্নীতিবাজ ছাড়া সাম্প্রতিককালের শুদ্ধি অভিযানে সকলেই স্বস্তি পেয়েছে। সকলের সমর্থনও আছে অকুণ্ঠ।

কেবল রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ‘ঘরের ভেতর’ই নয় এই অভিযান চলুক সর্বত্র। সর্বস্তরের উইপোকা দমনের এই শুদ্ধি অভিযানের শেষে আমরা যেন একটি পরিশুদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারি- নিজের কাছে, দেশের কাছে, বিশ্বের কাছে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমকেএইচ

পরবর্তী খবর

পেঁয়াজই মানুষকে কাঁদায়, কোন সবজি হাসায়?

রুমানা রাখি | প্রকাশিত: ০১:২৯ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০১৯

অনেক দিন আগে আমেরিকার বিখ্যাত কমেডি অভিনেতা উইল রগারসের একটি উক্তি পড়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, পেঁয়াজই মানুষকে কাঁদাতে পারে, কিন্তু এমন কোন সবজি নেই যা মানুষকে হাসাতে পারে। তার এই উক্তি পড়ার পর থেকেই মনে হতো আসলেই তো, পেঁয়াজ যেভাবে মানুষকে কাঁদায়, এমন কোন সবজি নাই উল্টো মানুষকে হাসায়। কিন্তু পেঁয়াজ তো কোন সবজি নয়। এটি আসলে একটি মশলা জাতীয় উদ্ভিদ। যার বৈজ্ঞানিক নাম এলিয়াম সেপা। এমন এক মসলার জন্য প্রতিদিন কতো কোটি রাঁধুনী যে তাদের চোখের জল ফেলছেন, তার কোথাও কোন হিসাব নেই।

একই সাথে পেঁয়াজ নেই, এমন কোন রান্না ঘরও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ কোন রান্না শুরুর শুরুতেই জ্বলন্ত উনুনে কড়াইতে তেল দেয়ার পরপরই যে উপাদানটি ব্যবহার করা হয়, তা হলো পেঁয়াজ। তাই চোখের জল সহ্য করে রান্না সুস্বাদু করতে রাঁধুনীরা হাসতে হাসতে পেঁয়াজ কাটেন প্রতিনিয়ত, প্রায় প্রতিবেলায়। পেঁয়াজ শুধু তরকারি মজা করার উপাদানই নয়, আইটেম ভেদে বর্তমানে কাঁচা , জমানো, আচার , চূর্ণ, কুঁচি, ভাজা, এবং শুকনো করা পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়। পেঁয়াজ সাধারণত সরাসরি খাওয়া হয় না, বরং পেঁয়াজ কুঁচি বা ফালি করে কাঁচা অবস্থায় সালাদে খাওয়া হয়। ঝাঁঝালো, মিষ্টি , তিতা পেঁয়াজও পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশে। স্বাদ যেমনই হোক, কাটার সময় কম-বেশি কাঁদিয়ে ছাড়ে সব ধরনের পেঁয়াজ। তবে ধরুন এমন কোন সবজি আছে, যা কাটলেই আমরা হেসে উঠবো। তখন আমাদের রান্না ঘরের দৃশ্যটা কেমন হতো? আমরা হাসছি, আর রান্না করছি। কি মজার দৃশ্য হতো! তবে আমার মনে হয়, যদি এমন কিছু থাকতোও দামের কারণে বাঙালিদের হয়তো কখনো হাসার সুযোগ হতো না।

অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, হাসির সবজি হলে আমরা কেন হাসতে পারবো না। ভাইরে, যখন বিক্রেতারা দেখতো কোন একটা পণ্য কিনে আমরা হাসছি, তখন আমাদের হাসি কেড়ে নিতে দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে নেওয়া হতো যে কেউ কেনার সাহসই পেতো না। আর আমাদের মতো মধ্যবিত্তের মধ্যে চড়া দামের অন্য পণ্যের মতো ওই পণ্যটি দেখেও হাসি উড়ে পালিয়ে যেত।

আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনাটি এমন যে, এখানে একজন ব্যবসায়ী কোন ধরনের স্বচ্ছতা মেনে চলেন না। তিনি কোন পণ্যটি কত টাকায় কিনে, কত দামে বিক্রি করছেন- তার কোন প্রকাশ নেই, কোন জবাবদিহিতা নেই। বাজার মনিটরিং-এর অনেক পদ্ধতি আছে, সরকারি সংস্থা আছে। কিন্তু কোনটিই স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণই কে করছেন, তাও জানা নেই কারও। সাধারণ মানুষ হিসেবে, সবসময়ই মনে হবে, সরকারই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিন্তু সরকারের বানিজ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তোফায়েল আহমেদকে বলতে শুনেছি, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার সব সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কে করবে?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দশ বছরের শাসনামলে সরকারি চাকরিজীবীদের বিলাসী জীবনযাপনের সিঁড়ি নির্মাণ করে দিয়েছেন তাদের বেতন ও নানাবিধ সুবিধা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে। এই সময়ে সরকারি খাত যতটা চাকচিক্য হয়েছে, বেসরকারি খাত ততটাই ম্লান হয়েছে। বেসরকারি দু’একটি পেশা ছাড়া প্রায় সব পেশাতেই দেখা দিয়েছে স্থবিরতা, বাড়ছে না বেতন-ভাতাও। বাংলাদেশীদের বর্তমান মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার। আমরা জানি এগুলো সবই গড় হিসাব। যার আয় বেড়েছে, তার আয় বাড়তিই ছিল। এখন আরো বেড়েছে। প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার করে মানুষ কোটিপতি হচ্ছে। পত্রিকায় যখন খবর আসে দুই মণ ধান বিক্রির টাকায় একটি ইলিশও কেনা যাচ্ছে না, তখন মাথাপিছু আয় বোঝা না গেলেও বোঝা যায় দ্রব্যমূল্য আসলে কতোটা নাগালে আছে। অথচ ইলিশ বাংলাদেশীদের জন্য প্রকৃতির দান। কেউ এর চাষাবাদ করে না, ইলিশের খাবার যোগান দিতে হয় না। শুধু নদী বা সমুদ্র থেকে ধরে বাজার পর্যন্ত এনে বিক্রি করার খরচ। তাতেই ভরা মওসুম ছাড়া কেজি সাইজ ইলিশের দাম ছাড়ায় দেড় থেকে দু’হাজার টাকা।

গত ২২ জুলাই যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, দুইটি কাচা মরিচের দাম এক টাকা। অন্যদিকে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় সুমন আলী নামের একজন ক্রেতার ৭০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি পেঁয়াজ কিনে বাড়ি ফেরার গল্প করা হয়। একদিনের মধ্যে ওই ক্রেতা দেখেন পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪০ টাকা। মানুষের যদি এমন সব ছোট ছোট দ্রব্য কিনতেই এতো টাকা খরচ করতে হয়, তাহলে কারও কি সত্যিই হাসা সম্ভব। মাথাপিছু আয় বাড়ছে, দেশের প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁইছে, আর্থিক উন্নয়নের এমন হার সত্বেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দেশব্যাপী মানুষের বিরক্তি ও ক্রোধ আছে। বিদেশ থেকে বিলাসী মোটরগাড়ি, শৌখিন বস্ত্রাদি, খাদ্য, পানীয়, অতিশৌখিন পণ্য যতই আসুক আর তার বিক্রি বাড়ুক, সাধারণের আলোচনায় দ্রব্যমূল্য বাড়ার বিষয়টি থেকেই যাচ্ছে।

যদিও রমজান মাসে এলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। চাহিদার উর্ধ্বগতির সাথে যোগানের লড়াইয়ে থাকতে হয় সাধারণ মানুষদের। রমজানে দ্রব্যমূল্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় স্থিতিশীল রাখতে কড়া নজরদারি করা হবে বলে যত হুঁশিয়ারি আর আশ্বাস দিয়ে ক্রেতাদের বিশ্বাস সৃষ্টির চেষ্টাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তার কিছুই মানানো যায় না ব্যবসায়ীদের। রোজা শুরুর এক মাস আগে থেকেই বাণিজ্য মন্ত্রী, সচিব আর ব্যবসায়ীরা রুটিন করে বলতে থাকেন যে, পর্যাপ্ত মজুদ আছে, কোন পণ্যের দাম বাড়বে না। কেউ দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যখন দ্বিগুণ হতে থাকে, তখনও রেকর্ড করা সুরের মতোই একই কথা বলতে শোনা যায় তাদের মুখ থেকে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। রোজার আগে সব সময়ই মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয় সিটি কর্পোরেশন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেশি দামে মাংস বিক্রি হচ্ছে অহরহই।

আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনাটি এমন যে, এখানে কোন ব্যবসায়ীকে কোন ধরনের স্বচ্ছতা মেনে চলতে হয় না। তিনি কোন পণ্যটি কত টাকায় কিনে কত দামে বিক্রি করছেন তার কোন প্রকাশ নেই, কোন জবাবদিহিতা নেই। বাজার মনিটরিং-এর কত যে পদ্ধতি আছে, সরকারি সংস্থা আছে। কিন্তু কোনটিই এই স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের পণ্য ব্যবসার পুরো জগতটিই মজুতদার, মুনাফাখোর, ফটকাবাজ, চোরাচালানিদের দখলে। আবার এদের সাথেই রাজনীতির যোগাযোগ। ফলে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি সুশাসনের সাথে জড়িত। অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটের কারণে, সুশাসনের সংকটের কারণে একটি আধুনিক মূল্য সংযোজন আইন করেও আজ সাত বছর ধরে সরকার সংগ্রাম করছে সেটি বাস্তবায়নের জন্য। দাপুটে ব্যবসায়ীদের পেশিশক্তির কাছে সরকার বারবার পরাজিত হয়েছে ২০১২ সালের ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে। স্বাভাবিক সময়ে চাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্য তেল আর সবজি এবং রমজানে ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো ভোগ্যপণ্যের কারণে যাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত, তারা হিমশিম খায়। কিন্তু এদেশে এমন একটি অস্বাভাবিক অর্থ উপার্জনকারী চক্র আছে যারা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি স্বত্ত্বেও এসব তোয়াক্কা না করে দাম যতই হোক না কেন, সেসব কিনে। প্রয়োজনে বেশি কিনে নষ্ট করে তারা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রতিবছর রমজানে নিয়ম করে বাড়তে থাকে ভোজ্যতেল ও চিনির দর। বাংলাদেশে এ দু’টি পণ্যের উৎপাদক মোটামুটি কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা একইসঙ্গে তেল ও চিনি উৎপাদন করেন। তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ব্যবসায়ীদের ডেকে দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তারা দোষ দিয়ে বললেন, এগুলো ডিও ব্যবসায়ীদের কাজ। তারা বললেন, ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করলে কোন পণ্যের দাম বাড়বে না। তাদের কথা মতো, আইন পরিবর্তন করা হলো, ডিও প্রথা বাতিল হলো। সারাদেশের হাজারো মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পরিবেশক নিয়োগ দিলো কোম্পানিগুলো। কিন্তু রমজানের বাজারে ভোজ্যতেল ও চিনির দরে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। পরিবেশকরা আগাম টাকা দিয়ে ট্রাক নিয়ে গিয়ে মিলগেইটে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও তেল-চিনি পান না। বাজারে দাম বেড়ে যায়, কারও কিছুই করার থাকে না। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করলো অত্যাবশকীয় পণ্য বিপণন আইন সংশোধন করবে, সেখানে তেল-চিনি ঢুকানো হবে। তখন সরকার চাইলে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারবে। এখন করছেও তাই। আইন অনুযায়ী, এসব পণ্যে সব খরচ বাদে উৎপাদন পর্যায়ে মিল মালিকদের ২ শতাংশ হারে মুনাফা করার কথা। কিন্তু দাম নির্ধারণের সময় মিল মালিকরা ১ লিটার তেলের জন্য যে খালি প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে, তার দাম ধরে ১৫ টাকা, সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের দিয়ে তেল-চিনির বিজ্ঞাপন করিয়ে প্রচার করা হয় টিভিতে, তাদের সম্মানীও হিসাব করা হয় দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে।

এরপর ঠিক করা হলো, নাহ! এভাবে আর চলে না। গঠন করা হলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারা প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকা খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ পেলে জরিমানা করে। এবার ক্রেতা ঠকানোর জন্য ব্যবসায়ীরা বেছে নিলো অন্যপথ। ইদানিং ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের জন্য আলাদা মূল্য নির্ধারণ করে হাফ লিটার পানি ছাড়ছে কোম্পানিগুলো। সারাদেশে হাফ লিটারের দাম ১৫ টাকা হলেও কোথাও কোথাও একই কোম্পানির হাফ লিটারের বোতলে লেখা খুচরা মূল্য ২৫ টাকা। রেস্টুরেন্টগুলোতে এখন আর আধা লিটারের কোকাকোলা, পেপনি, সেভেন আপ বিক্রি হয় না। তারা আধা লিটার পানীয় তিনটি গ্লাসে ঢেলে প্রতি গ্লাসে দাম নেয় ৫০-৬০ টাকায়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর এখানে কিছু করতে পারে না। কারণ, খোলা পানীয়র গায়ে দাম লেখা নেই। যেমনটি হয়েছে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তার অর্থ হলো, ভারত থেকে বেশি দামে পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। ব্যবসায়ীদের কাছে যতো পেঁয়াজ ছিল, তা আগেরই, কমদামের। কিন্তু তারা দাম বাড়িয়ে দিলো। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সদরদপ্তরের পাশেই কাওরানবাজারের ব্যবসায়ীরাও সারাদেশের ব্যবসায়ীদের মতো পেঁয়াজের ভোক্তাদের পকেট কেটে কাঁদিয়ে ফেললো, কিচ্ছু করতে পারলো না অধিদপ্তরটি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাজারদর নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আছে, সেটা হোক বড় ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষুদ্র কোন কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতি। হাতিরপুল কাঁচাবাজার থেকে কাওরানবাজারের দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো। হাতিরপুলের খুচরা ব্যবসায়ীরা রাতের বিভিন্ন সময়ে কাওরানবাজার থেকে সবজি কিনেন। ধরা যাক, হাতিরপুল কাঁচাবাজারে ১৫ জন সবজি বিক্রেতা আছেন। তারা রাতের বিভিন্ন সময় কাওরানবাজার থেকে ফুলকপি কিনলেন। কেউ কিনলেন ১০ টাকা পিস, কেউ ১২ টাকা, কেউ ১৫ টাকা, আবার কেউ সর্বোচ্চ ২০ টাকা দরে কিনলেন। সকালে হাতিরপুলে বিক্রি শুরুর আগে নিজেরা আলাপ করে শুনেন যে, সর্বোচ্চ যে কতো দামে কিনেছে। যখন তারা জানলো, তাদের একজন ২০ টাকা দামে কিনেছে, তখন তারা ঠিক করে যে, আমরা কেউই ৩০ টাকার নিচে কোন ফুলকপি বেঁচবো না। সবচেয়ে বেশি দামে যে কিনেছে, তার জন্যও মুনাফা রেখে দাম নির্ধারণ করে তারা। এ ধরনের সিন্ডিকেট আছে বড় ব্যবসায়ীদেরও। অথচ বিভিন্ন দেশে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সিন্ডিকেটের বদলে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা হয়, যা বাংলাদেশে নেই।

বাংলাদেশের বাজারেও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা কমিশন আইন পাস হয়েছে, চেয়ারম্যান, সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই কমিশন ব্যবসায়ীদের মধ্যে কতোটা প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারবে, তার ওপরই নির্ভর করবে ভোক্তাদের ভবিষ্যত। কারণ, অন্য সব উদ্যোগই তো ভেস্তে গেছে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমকেএইচ

News Hub