মওলানা ভাসানী ও ইসলামী সমাজতন্ত্র

ভাসানী সমাজতন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু শেষ দিকে তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলছিলেন। এ নিয়ে বিস্ময় ও হতাশা দু’টোই দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে তাঁর অনুরাগী ও অনুসারীদের ভেতরে। বদরুদ্দীন উমর মনে করেন যে, এটা ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের একটি মস্ত বড় পশ্চাদ্গমন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে তিনি লিখেছেন,  Whether the Maulana and his political associates understand the import of such declarations or not is a different  question, but the fact of the matter is that by his latest stand the Maulana has struck at the very root of democratic politics in this country.

ভাসানী সমাজতন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু শেষ দিকে তিনি ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথা বলছিলেন। এ নিয়ে বিস্ময় ও হতাশা দু'টোই দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে তাঁর অনুরাগী ও অনুসারীদের ভেতরে। বদরুদ্দীন উমর মনে করেন যে, এটা ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের একটি মস্ত বড় পশ্চাদ্গমন। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে তিনি লিখেছেন,  Whether the Maulana and his political associates understand the import of such declarations or not is a different  question, but the fact of the matter is that by his latest stand the Maulana has struck at the very root of democratic politics in this country.

হ্যাঁ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য মওলানা ভাসানীর ওই অবস্থানটা অবশ্যই ক্ষতিকর হয়েছে, কিন্তু অতটা মারাত্মক নয় যতটা মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, তার ইসলামী সমাজতন্ত্র ছিল ভুট্টোর ইসলামী সমাজতন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। ভুট্টো আওয়াজটা তুলেছিলেন ভোট পাওয়ার জন্য; ভাসানী তুলেছেন যখন তিনি ভোটের রাজনীতি পরিত্যাগ করেছেন তখন। দ্বিতীয়ত, তিনি ইসলামের কথা বলেছেন হয়তো কৌশল হিসেবেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি ধর্মবিরোধী এবং তার ওঠাবসা নাস্তিকদের সঙ্গে; শত্রুপক্ষ এমন হুমকিও দিচ্ছিল যে ইন্দোনেশিয়াতে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে যেভাবে কমিউনিস্টদের নিধন করে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হয়েছে, পাকিস্তানেও তেমন ঘটনা ঘটানো হবে।

তিনি যে ধর্মবিরোধী নন, তার প্রমাণ উপস্থিত করার একটা ব্যাপার ছিল। তৃতীয়ত, তিনি জানতেন যে, যে মেহনতিদেরকে তিনি আন্দোলনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন তাদের অধিকাংশই মুসলমান, এবং তারা ধর্মের ভাষায় ডাক দিলে যেভাবে সাড়া দেবে অন্যকিছুতেই তেমন সাড়া দেবে না। তাদের সাংস্কৃতিক মানটা ছিল ওই পর্যায়েরই। স্মরণীয় যে ভাসানী সংস্কৃতি নিয়ে খুবই ভাবতেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পাশাপাশি কাগমারীতে তিনি তিনদিনব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলনেরও আয়োজন করেছিলেন। আয়োজনটির ধরন দেখলে বোঝাই যায় সংস্কৃতির চর্চাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, চর্চাকে তিনি গ্রামে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, আবার তাকে আন্তর্জাতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গেও সম্পৃক্ত রাখতে চেয়েছেন। বস্তুত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সেটাই ছিল বৈশিষ্ট্য। কাজটা করতে গিয়ে তিনি ধর্মব্যবসায়ীদের তো বটেই, মার্কিনপন্থি সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ইত্তেফাক পত্রিকা দ্বারাও ভীষণ ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনাধীন সময়ে তিনি যে কৃষক স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার কর্মসূচী ও গঠনতন্ত্রের 'জরুরি কথা' হিসেবে প্রথম বাক্যটিই ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক। সেটি ছিল এই রকমের: 'মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানুষকে লইয়া মানুষের জন্যই অনুষ্ঠিত হইবে।' তাতে বলা হয়েছিল এই মানুষ হচ্ছে 'দেশের জনসাধারণ যারা শোষিত ও নিগৃহীত হচ্ছে'। আরও বলা হয়, 'এই শোষণের অবসান ঘটাইয়া সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা কায়েম করিবার প্রাথমিক স্তর হিসেবে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন।'

বলা হয়েছিল যে, এই বিপ্লব কোনোমতেই সংস্কারমূলক হবে না; এর লক্ষ্য হবে 'সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণহীন, মহান সমাজব্যবস্থা গড়িয়া তোলা। এই লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা চলিতে থাকিবে।' এর জন্য যা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন হবে তা হলো কৃষক সমাজকে ভালোভাবে বোঝানো যে, 'কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থাই তাহাদের সকল দুঃখ-কষ্টের পূর্ণ-অবসান ঘটাইবে- অন্যকোনো ব্যবস্থাই কৃষক জীবনে উন্নয়ন ও প্রাচুর্যের ছোঁয়াচ আনিতে পারিবে না।'

সাংস্কৃতিক মানের নিম্নস্তরবর্তিতাকে মেনে নিয়ে এবং সেটিকে উন্নত করবার জন্য কৃষকদের কাছে পৌঁছবার উপায় হিসেবে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে 'ইসলাম' যোগ করাকে হয়তো কার্যকর পন্থা বলে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সমাজতন্ত্রে যে হিন্দু মুসলমান নাই, সেটি যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইহজাগতিক ব্যবস্থা সেটা তিনি জানতেন না এমনটা মনে করবার কারণ নেই। ভাসানীর প্রস্তাবের, এবং অনড় অবস্থানের কারণেই কৃষক সমিতির লক্ষ্য হিসেবে 'সমাজতন্ত্র' কথাটা যুক্ত হয়। রুশপন্থিরা আপত্তি করেছিলেন, তাদের ধারণা ঘোষণাপত্রে সমাজতন্ত্র থাকলে সমিতির গণচরিত্র নষ্ট হবে।

এ সময়ে অভিযোগ উঠেছিল যে মওলানা ভাসানী সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছেন। অথচ মওলানার পক্ষে আর যাই হোক না কেন, সাম্প্রদায়িক হওয়াটা ছিল একেবারেই অসম্ভব। এর সাক্ষ্য তাঁর সারাজীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজকর্ম। বলিষ্ঠ সাক্ষ্য দিচ্ছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। হাজী দানেশ ও মওলানা ভাসানী এক সময়ে একইসঙ্গে ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। ১৯৫০ সালে মওলানার বয়স তখন ৭০; হাজী দানেশের বয়স ৫০। মওলানা জেলে গেছেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে; হাজী দানেশের কারাভোগ গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হবার দায়ে। হাজী দানেশ লিখছেন, '৫০ সালের সেই পরিচয় থেকে আমি দেখেছি মওলানা সাহেবের মতো অসাম্প্রদায়িক কোনো ব্যক্তি নেই।'

আর সমাজতন্ত্রে মওলানার অঙ্গীকার কতটা যে দৃঢ় ছিল তার সাক্ষ্যও হাজী দানেশ দিয়েছেন। মৃত্যুর ২ বছর আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মওলানা ভাসানী 'আন্তরিকতার সঙ্গে মানুষের মুখে হাসি দেখতে চাইতেন। নিপীড়িত মানুষের একদিন মুক্তি আসবে, আর তা একমাত্র কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আসবে, তা তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি কমিউনিস্টদের ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা করতেন।'

আইয়ুবের পতনের পরে নতুন করে সামরিক শাসন যখন জারি হলো রাজনৈতিক নেতারা তখন হতভম্ব; কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ভাসানীর উদ্ভাবিত ঘেরাও অনেকটা সফল হয়েছে; কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে 'ঘেরাও' চলবে না বোঝা যাচ্ছিল। ভাসানী তখন উদ্ভাবন করেন কৃষক সম্মেলন। প্রথমে অনুষ্ঠান করেন পাকশিতে, অক্টোবর ১৯৬৯ সালে। সেটা ছিল পরীক্ষামূলক। তারপরে বড় আকারে করেন শাহপুরে। ঘরোয়া রাজনীতির তখন অনুমোদন ছিল। সম্মেলনের মাঠে বাঁশের বেড়া ও লাল কাপড়ের ঘের তৈরি করে সামরিক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, এটা প্রকাশ্য নয়, ঘরোয়া বৈঠক বটে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল কৃষকবাহিনী গঠন করা; বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন কৃষক স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকা বাহিনী; এই সময়ে লালটুপির উদ্ভাবনও তিনিই ঘটালেন। লালটুপির পেছনে ছিল চীন ও রুশ বিপ্লবের রেড গার্ডদের স্মৃতি। 

তারপরে জানুয়ারিতে যখন প্রকাশ্য রাজনীতি করার ব্যাপারে ছাড় দেওয়া হলো, তখন একের পর এক সম্মেলন হলো সন্তোষে, মহীপুরে, ঢাকায়, খুলনায়, ময়মনসিংহে। এমনকি ১৯৬৯ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় যেদিন ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বশেষ বৈঠকটি হয় সেদিন সকালেও রেসকোর্স ময়দানে কৃষক শ্রমিক সমাবেশ ও লালটুপি মিছিল করা হয়েছিল। কারো কারো ধারণা, লাখখানেক লোক উপস্থিত ছিল। প্রতিটি কৃষক সম্মেলনেই তিনি সমাজতন্ত্রের আবশ্যকতার কথা খুব জোর দিয়ে বলতেন।

১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানে যান, সেখানকার ন্যাপের এবং হারি (কৃষক) সমিতির আহ্বানে। ওই সফরে যে সমস্ত জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন তাতে তার বক্তব্য মোটেই ধর্মবিষয়ক ছিল না, ছিল সামাজিক বিপ্লব বিষয়ক। তিনি বলেছিলেন পুঁজিপতি ও সামন্ত প্রভুদেরকে জনসাধারণের দাবিদাওয়া মেনে নিতে হবে। বলেছিলেন পাকিস্তানি সরকার আন্দোলনের সময় যত মানুষকে খুন করেছে ব্রিটিশ শাসনের আমলে ততো করা হয়নি।

খুব বড় আকারে একটি কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল পাঞ্জাবের টোবাটেক সিং নামের একটি প্রান্তিক এলাকাতে। সম্মেলনটি ছিল যাকে বলে ঐতিহাসিক। এতে যেমন যোগ দিয়েছিলেন লাহোরের আরিফ ইফতেখারউদ্দিন ও মুলতানের কিশওয়ার গারদেজির মতো বিত্তবানরা, তেমনি এসেছিলেন হাজার হাজার ভূমিহীন কৃষক; এসেছিলেন কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, স্বরচিত কবিতা পাঠ করতে; এসেছিলেন করাচির শ্রমিকনেত্রী কানিজ ফাতিমা। সম্মেলনের দৃশ্যাবলী ও ঘটনাপ্রবাহ কেমন ছিল তার একটি বিবরণ পাওয়া যায় লাহোরের এক সাংবাদিকের বর্ণনায়; উর্দু ভাষায় লিখিত একটি পুস্তকে তিনি জানাচ্ছেন : 'মওলানা ভাসানীকে নিয়ে গাড়ি টোবাটেক সিং-এ পৌঁছুলে চারদিকে দেখা যায় শুধু লালটুপি। ঢোল, বাদ্য, স্লোগান সহকারে তারা মওলানাকে স্বাগত জানায়। জনতার সমুদ্রে কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছিল না। সবাই নিজেই স্লোগান দিচ্ছিল আবার নিজেই জবাব দিচ্ছিল। সবাই বিপুল উদ্দীপনায় মওলানার কথা শোনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। রেলস্টেশন থেকে মওলানাকে মিছিল করে শহরে নিয়ে যাওয়া হলো। শিশুরা আনন্দে নৃত্য করছিল। চাদর এবং দোপাট্টা গায়ে মেয়েরা মওলানার উপর এবং মিছিলের উপর ফুল বর্ষণ করে আনন্দ প্রকাশ করছিল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যুবকদের স্লোগান দিতে দিতে গলা বসে গিয়েছিল। সম্মেলনের অদূরে মেলা বসেছিল। রকমারী দোকানপাট সাজিয়ে স্বল্পমূল্যে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের দোকানীরা খাবার সরবরাহ করছিল। এক আনা মূল্যের একটি রুটি খেলে পেট ভরে যেতো। তাও রুটির সঙ্গে তরকারি বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছিল। রহিমইয়ার খান, বাহাওয়ালপুর, লাহোর, ওহাড়ি, ভাওয়ালনগর, কবিরওয়ালা, বুরেওয়ালা, সারগোদা, লুধহারান, ঝং, ডেরাগাজী খান, শিয়ালকোট, হাজরা, রাওয়ালপিন্ডি, ক্যাম্বেলপুর, গুজরাট, গুজরানওয়ালা, কিলাস, পেশোয়ার, কোহাট, বান্নু, মর্দান, সোয়াত, কোর্ট সেন্টিমেন, কোয়েটা, লাসবেলা এবং করাচি থেকে শ্রমিকরা সম্মেলন স্থলে এসে সমবেত হয়। মোদ্দা কথা "সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান" যেন টোবাটেক সিং-এ ভেঙে পড়েছিল। চারদিক থেকে লোকারণ্য। মেয়েদের প্রতি কেউ চোখ তুলে তাকাচ্ছিল না। যেন ভাই-বোন সবাই একত্রিত হয়েছে।'

ভাসানীর আহ্বানটি ছিল সমাজতান্ত্রিক। পূর্বে যেমন পশ্চিমেও তেমন। কথিত ইসলামী সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তোলার আরও একটি কারণ হতে পারে ক্ষোভ ও অভিমান। মওলানাকে ছেড়ে তার অনুসারীরা একে একে চলে গেছেন। সবশেষে গেছেন চীনপন্থি কমিউনিস্টরা। এঁদের চলে যাওয়াতে তিনি কত যে মনোকষ্ট পেয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে ন্যাপের রংপুর সম্মেলন তাঁর বক্তৃতাতে তার একটি প্রকাশ ঘটেছিল। ওই বক্তৃতাতে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেছেন, 'আমি সিলেট রেফারেন্ডামে পাকিস্তানের জন্য লড়েছি, কিন্তু পাকিস্তান হবার পর জিন্নাহ সাহেব প্রথম গ্রেফতার করেন আমাকে। দুঃখ তখন পাইনি। আমি যখন রংপুরে আসি আমার স্নেহাস্পদ মশিউর রহমান যাদু মিয়া এক গাড়ি লোক পাঠিয়ে দিয়ে স্লোগান দিল, "ভাসানী ফিরে যাও"। দুঃখ তখনও পাইনি। যে আওয়ামী লীগ নিজে হাতে গড়লাম, সেই আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, যে মুজিবকে স্নেহ করতাম সেই মুজিবও বিরুদ্ধে গেল। দুঃখ তখনও পাইনি। কিন্তু যারা আমাকে কাটমোল্লা থেকে সমাজতন্ত্রী বানাল, সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত করলো, নতুন করে আমার জন্ম দিল, তারা যখন কুৎসা করে তখন তো আর দুঃখ ধরে রাখতে পারি না।' হায়দার আকবর খান রনো ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন, তার মনে আছে ভাসানীর সেই বক্তৃতাতে শ্রোতাদের অনেকেই কেঁদেছিলেন।

ভাসানী যখন কৃষক সম্মেলন করছেন দলত্যাগ তখনও ঘটেছে। সাহিত্যিক আবদুল হক তার ২৮ জুন ১৯৭০-এর দিনলিপিতে লিখেছেন : 'ভাসানী ন্যাপে ভাঙন। গত কয়েক মাসে ভাসানী ন্যাপের এইটিই সবচেয়ে বড়ো কথা। জেনারেল সেক্রেটারী মোহাম্মদ তোয়াহা পদত্যাগ করেছেন মাস দু'য়েক আগে।' হয়তো কোনো একটা নয়, ওপরে উল্লেখিত সবক'টি কারণই একত্রে মিলেছিল মওলানাকে 'পশ্চাদপসরণে' বাধ্য করতে। 'পশ্চাদপসরণ' যতটাই হোক না কেন, সমাজতন্ত্রে নিজের আস্থাকে এবং সমাজতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর ভরসার ব্যাপারটাকে তিনি কখনোই দূরে সরিয়ে দেননি।

মুহাম্মদ ইউনূস যেভাবে আমাদের হয়ে ওঠেন 

কেমন ছিল মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির দিন, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এ মুহূর্তে পুরো বাংলাদেশ হাসছে।
ছবি: সংগৃহীত

সেদিন ছিল শুক্রবার। ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর। ওই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা করে নরওয়ের নোবেল পিস প্রাইজ কমিটি। পুরস্কার পান ক্ষুদ্রঋণের জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। দুপুরের পরপরই সবাই জেনে যায় সেই খবর, বিদ্যুৎবেগে। হাওয়ায় হাওয়ায় রটে যায় সেই আনন্দ বারতা ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল জুড়ে।

আমরা তখন হাজির ছিলাম পান্থপথ বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সের সম্মুখভাগে। উপলক্ষ, তারেক মাসুদ পরিচালিত 'অন্তর্যাত্রা' চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো দর্শন। পেশাগত সূত্রে আমি তখন দৈনিক সংবাদ-এ। ততদিনে তিনি 'মাটির ময়না' নির্মাণ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে পেয়েছেন প্রভূত খ্যাতি। তারও আগে 'মুক্তির গান' ও 'মুক্তির কথা'য় নতুন প্রজন্মের কাছে হাজির করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অজ্ঞাত ও লুপ্তপ্রায় সব অধ্যায়। তার আগ্রহ ও অনুরোধেই ছুটির দিনের দুপুর শেষাশেষি বিকেলে বসুন্ধরায় হাজির হওয়া।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির খবরটা প্রথম জানান আমাকে তারেক ভাই। এমন হাসির আবীর রাঙা মুখে বলছিলেন যে সেই স্মৃতি কখনোই বিস্মরণের নয়। ওরকম হাসি ছড়াতে তাকে দেখিনি কখনোই। কোনো শব্দ নেই, শরীরও দুলছে না—অথচ তনু-মন জুড়ে পুরো শরীর হেসে উঠছে।

তারপর আমি যেদিকে তাকাই দেখি, সবাই হাসছে। হাসছে করিডোর, স্টার সিনেপ্লেক্স, বসুন্ধরা সিটি। সবার মাঝেই তখন নীরব হাসির বান ডেকেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এ মুহূর্তে পুরো বাংলাদেশ হাসছে।

এ কারণে এটাও অনুমিত হয় যে আজ এ মুহূর্তে পৃথিবীর যে প্রান্তে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আছে, সবাই হাসছে এবং ভাগাভাগি করে নিচ্ছে জাতির ভাগ্যাকাশে উদিত হওয়া অবিস্মরণীয় এই আনন্দ মুহূর্তকে। আজ রাতে যার যার মতো করে সবাই এই প্রাপ্তিকে উৎসবে রূপ দেবে, বিশেষভাবে স্মরণীয় করে তুলবে।

সেদিনের সেই অনুমান ও প্রত্যাশা যে একবিন্দুও অমূলক ও অসার ছিল না, পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় এরকম একটা সাক্ষ্য খুঁজে পাই। তিনি লিখেছেন, 'অধ্যাপক ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন আমি নাটকের একটা ছোট্ট দল নিয়ে কাঠমুন্ডুর হোটেল এভারেস্টে থাকি। হোটেলের লবিতে চা খাচ্ছি, হঠাৎ আমার ইউনিটের একজন চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল। সে বলছে, স্যার আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। স্যার, আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি।'

'সে বলেনি, অধ্যাপক ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সে বলেছে, আমরা পেয়েছি। অধ্যাপক ইউনূসের এই অর্জন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্জন।' 'আমার মনে আছে এই আনন্দ সংবাদ শোনার পর আমি শুটিং বাতিল করে উৎসবের আয়োজন করি। সেই উৎসবের শিখা আমি বুকের ভেতর আজও জ্বালিয়ে রেখেছি।'

২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস- ছবি : সংগৃহীত

'দেশের বাইরে যখন সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যাই তখন আগের মতো হীনম্মন্যতায় ভুগি না। কারণ এই সবুজ পাসপোর্ট অধ্যাপক ইউনূসও ব্যবহার করেন।'

তারেক ভাইয়ের পাশে থেকে কেউ একজন বললেন, স্বাধীনতার পর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো আজ। আমি মনে মনে বললাম, বাঙালির ইতিহাসেও নয় কি? তর্কে গেলাম না। কারণ, তর্ক করে এই আনন্দ মুহূর্তটাকে ম্রিয়মাণ করতে চাই না।

স্পষ্ট মনে আছে, সেদিনের 'অন্তর্যাত্রা'র প্রদর্শনী সবার জন্যই অন্যমাত্রার আনন্দদায়ক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। তার নোবেল পাওয়ার ঘটনা, প্রিমিয়ার শোর আনন্দের সঙ্গে যোগ করেছিল বিশেষ মহিমা ও মর্যাদা। সেদিন সত্যসত্যই মনে হয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস নন, আমরা নিজেরাই বুঝি অর্জন করেছি নোবেল লরিয়েট হওয়ার গর্ব ও গৌরব। আমরা বিশ্বসভায় এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছি যে আমাদের অগ্রগতি, উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার, মানবাধিকারের চর্চা—সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার যে স্বপ্ন ছিল তা বুঝি আর কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। 'আমরা করব জয়'—এই প্রত্যয় সেদিন গভীরভাবে বেজে উঠেছিল আমাদের মনোজগতে, চিন্তা ও চেতনায়। বঙ্গবন্ধুর সেই কণ্ঠ অনুরণিত হয়েছিল বাঙালির হৃদমাঝারে—'আর দাবায়ে রাখতে পারবা না'।

২০০৬ থেকে ২০২৪—মাঝখানে গড়িয়ে গেছে অনেক সময়। অনেক কিছু বদলেছে, বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। অধরা রয়েছে কেবল আমাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা। তবে এ কথাও সত্যি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে, তার অর্জনকে ঘিরে যে আনন্দ, তা ম্লান হয়নি। ভাটা পড়েনি সেই গর্ব ও গৌরবে। একটা ঘটনায় সেটা বুঝতে পারলাম পরিস্কারভাবে। সেটা বলব এই লেখার শেষাশেষি।

সত্য যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে অসূয়কের সংখ্যা বেড়েছে, আগাছারা বাড়ে যেভাবে। কিংবা হয়তো সংখ্যা বাড়েনি, দেখায় বর্ধিষ্ণু। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে তিনি সবিশেষ শ্রদ্ধা ও গৌরবের হয়ে আছেন আজও, থাকবেন আগামীতেও।

উপরোক্ত দাবির পক্ষে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। আমরা যদি কেবল এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করি, তা হলে সেই তালিকায় অনিবার্যভাবে হাজির থাকবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাপান, কানাডার মতো উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে পাঠ্যবইয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চায় জায়গা করে নিয়েছেন তিনি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার যূথবদ্ধতায়।

তার ব্যতিক্রমীতা ও স্বাতন্ত্র্য হলো, কেবল তিনি তত্ত্ব বলেননি, তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন—

১. বড় বড় ঋণে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা ব্যাধির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকলেও ক্ষুদ্র ঋণে সেটা নেই, থাকলেও সেই হার একেবারে যৎসামান্য।

২. প্রান্তিক বা সাধারণ মানুষকে কোনো কিছু বন্ধকি না রেখেও ঋণ দেওয়া যায়। কারণ তারা ঋণটা যথাযথভাবে বিনিয়োগ করেন। যাতে যুক্ত থাকে পরিশ্রম, সততা ও সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা। ফলে, এই ঋণ গ্রহণ ও ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও ইতিবাচক উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটে।

৩. ক্ষুদ্রঋণের তত্ত্ব তিনি উদ্ভাবন করেছেন। নিজে ঝুঁকি নিয়ে তার পরীক্ষা করেছেন এবং বৃহৎ পরিসরে তা বাস্তবায়ন করে এর উপযোগিতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তার আগে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে এভাবে কেউ ভাবেননি, ভাবলেও তার পরীক্ষা করে সফল হননি।

ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে—যদিও এর সত্যমিথ্যা সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। অভিযোগ রয়েছে, এই ঋণ গ্রামের কোনো কোনো পরিবারে বা মেয়েদের কাছে মরণফাঁদ হিসেবে দেখা দেওয়ায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

লক্ষণীয়, এসব অভিযোগের সবটাই বা বেশিরভাগই এসেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর। এসব ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তা নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। শোনা কথার ভিত্তিতে আলটপকা কোনো অভিযোগ দাঁড় করানো কিংবা তর্ককে উসকিয়ে দেওয়া ও আড্ডা-আলাপ জমানোর জন্য কোনো প্রকার তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এসব প্রসঙ্গ হাজির করা দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক নয়।

এসব অভিযোগ যদি সত্য হয়েও থাকে, তা হলে আমাদেরকে এই প্রসঙ্গও বিবেচনায় নিতে হবে যে ক্ষুদ্রঋণ যারা নিয়েছেন, তাদের কত সংখ্যার বিপরীতে মাত্র কয়জনের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে? আমরা কি খতিয়ে দেখেছি যে কেবল ঋণের জন্যই এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, নাকি পারিপার্শ্বিক অন্যবিষয়ও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল? ক্ষুদ্রঋণ তো অগণন মানুষ নিয়েছেন। এর মধ্যে দিয়ে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনও ঘটেছে।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে এ দেশের নারীদের ক্ষমতায়ন, জীবনমানের পরিবর্তন, শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়া, মাতৃমৃত্যুর হার কমে যাওয়া, গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া, বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমার মতো ইতিবাচক বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার।

এসবের বিপরীতে কেন দু-একজন কিংবা কতিপয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি। এটা কি স্থানীয় ব্যবস্থাপনার কোনো ত্রুটি, নাকি অন্য কোনো কারণ রয়েছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন। এটা যদি পদ্ধতিগত ত্রুটি হতো, তা হলে নিশ্চয় দু-একটা ঘটনার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকত না।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার যে ধারণা, তা নিঃসন্দেহে অভিনব ও অভিনন্দনযোগ্য। সমস্যা হলো, আমাদের বিশ্ব ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাকে বর্তমানে এমনভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করা হয়েছে যে এসবে ব্যক্তির ধারণা এখন লুপ্তপ্রায়। বহুত্ববাদী চিন্তা, সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি আজ নানা কারণে হুমকির মুখোমুখি। এই অবস্থায় সামাজিক ব্যবসার ধারণা সকলের জন্যই আগুনের পরশমনিসম। সত্যই যদি পৃথিবী নামক এ গ্রহের দেশগুলো মানুষে মানুষে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চান, সবার জন্য সুসম বণ্টন নিশ্চিত করতে আগ্রহী হন, তা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার ধারণা হতে পারে তাদের জন্য ইস্তেহার বিশেষ।

বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য তিনি যে 'থ্রি জিরো' বা 'তিন শূন্য'র কথা বলেছেন, আদতে তার কোনো বিকল্প আছে কি? নেই। তিনি দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। বেকারত্ব বা কর্মসংস্থান না থাকার হারকে শূন্যে নিতে তাগিদ দিয়েছেন। কার্বন নিঃসরণকে শূন্যে নামিয়ে আনার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ যে বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য অভিশাপ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমরা যদি সত্যি সত্যিই এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে চাই, আগামী প্রজন্মের জন্য এ গ্রহকে নিরাপদে রেখে যেতে চাই, তা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের 'তিন শূন্য' বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

'ক্ষুদ্র ঋণ', 'সামাজিক ব্যবসা' ও 'তিন শূন্য'কে গভীরভাবে ভেবে দেখলে দেখতে পাবো, এর মধ্যে দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে তাতে রয়েছে মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা ও মঙ্গলসাধনের দুর্নিবার প্রত্যয়। তিনি দেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নিয়ে যেমন দেশ ও জাতির দুঃখ দূর করতে চেয়েছেন, তেমনই আন্তর্জাতিকতা বোধ থেকে পৃথিবীর সমস্যা ও সংকট অপনোদনের জন্য ব্রতী হয়েছেন। এ কারণেই তিনি বিশ্বের দেশে দেশে বন্দিত এক নাম। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে মান্যতা দিয়েছেন, বন্দিত করে নিজেদের সম্মানিত করেছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া আন্তর্জাতিক পুরস্কারের তালিকার দিকে লক্ষ্য করলেও আমাদের বিস্ময়ের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। কেননা সেই তালিকা এতো বড় যে, তা লেখা কয়েক পৃষ্ঠায়ও সম্ভব নয়। তিনিই সম্ভবত এ গ্রহের সর্বাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিত্ব।

অথচ নিজের জন্মভূমিতে তাকে নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক বিতর্কের কোশেশ জারি রয়েছে। সেটা অবশ্য বাঙালির নোবেল সংক্রান্ত অসূয়ক ইতিহাসের দিকে তাকালে অস্বাভাবিক মনে হয় না। সাধে তো আর রবীন্দ্রনাথ বলেন নাই, 'সাত কোটি সন্তানের হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।' ইউনূসকে আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আদালতের বিষয় নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।  আমাদের বিশ্বাস সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিনি পঠিত হবেন, যার শুভারম্ভ হয়েছে ইতোমধ্যেই।

ইউনূসের নোবেল পাওয়ার পর সেই ধারণা অনেকাংশেই বদলে গেছে। এখন বিদেশিরা বাংলাদেশের নাম শুনলেই আলাদা দৃষ্টি রাখে; যাতে প্রস্ফুটন হয় সম্ভ্রম, সমীহ, শ্রদ্ধা ও বিশেষ গুরুত্বের ছাপ। কারণ, বাংলাদেশ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন নোবেল লরিয়েটের দেশ। যিনি নতুন তত্ত্ব কেবল হাজির করেননি, তা বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছেন তার উদ্ভাবন ও উদ্যোগের সার্থকতা

সক্রেটিস থেকে কার্ল মার্কস, নিউটন থেকে আইনস্টাইন, পেলে থেকে মোহাম্মদ আলী, শেক্সপীয়র থেকে রবীন্দ্রনাথ, মার্টিন লুথার জুনিয়র থেকে মাদার তেরেসা প্রমুখ মানবদরদী, প্রতিভাধর ও প্রজ্ঞাবান মনীষীজনের জীবনী পাঠ করে আমরা যেমন আলোর পরশ নিতে চেষ্টা করি, ঠিক তেমনই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে দেশের বাইরে সেরকম পাঠ হচ্ছে, বিদ্যায়তনিক পরিসরে এবং গবেষণার ক্ষেত্রগুলোতে। পৃথিবীর দেশে দেশে বর্তমান ও নতুন প্রজন্ম তার কাজ নিয়ে সবিস্তারে জানতে ভীষণভাবে আগ্রহী।

দেশের বাইরে থাকা আমাদের আত্মীয় স্বজনের তরফে এ ধরনের ভালো লাগার খবর আমরা প্রায়ই পেয়ে থাকি। তারা গর্ব করে বলেন, আগে বিদেশিরা বাংলাদেশের নাম শুনলেই মনে করতো বন্যা, খরা, ঝড়, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়সহ নানারকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ওখানে বুঝি দুর্যোগ দুর্বিপাক সারা বছরই লেগে থাকে। এখানকার মানুষে মানবেতর জীবনযাপন করে। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তাদের কোনো অবদান নেই। নেই গৌরব করার মতো কোন অর্জন, নেই বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদেরকে বিশেষভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো বড় কোনো ঘটনা।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পাওয়ার পর সেই ধারণা অনেকাংশেই বদলে গেছে। এখন বিদেশিরা বাংলাদেশের নাম শুনলেই আলাদা দৃষ্টি রাখে; যাতে প্রস্ফুটন হয় সম্ভ্রম, সমীহ, শ্রদ্ধা ও বিশেষ গুরুত্বের ছাপ। কারণ, বাংলাদেশ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন নোবেল লরিয়েটের দেশ। যিনি নতুন তত্ত্ব কেবল হাজির করেননি, তা বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছেন তার উদ্ভাবন ও উদ্যোগের সার্থকতা।

বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে এরকম সুখের সময় তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় ১৯৭১-এ ও তারপর। তখন বাংলাদেশ নামটা উচ্চারণ করলেই বলতেন, 'গ্রেট লিডার, শেখ মুজিবুর রহমান'। তারপর বাঙালি, বাংলাভাষী ও বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের সেই গৌরব ও আনন্দসুখ পাওয়ার অপার সুযোগ করে দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এখন যে কারও মনে হতে পারে, যে ইউনূস আমাদেরকে আকাশ ছোঁয়ার সাধ এনে দিল নোবেল প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে, বিনিময়ে আমরা কী দিলাম তাকে? এমনকি তার জন্মদিনটাও কোথাও স্মরিত হলো না। এ বুঝি মহৎ প্রাপ্তির বেদনা ও দায়?

বড়কিছু অর্জনের বাস্তবতা হলো, তা কেবল উপঢৌকন ও উষ্ণীষ হয়ে আসে না, সঙ্গে কিছু অরাতি ও অসূয়কও নিয়ে আসে। যদিও তারা প্রকৃতার্থে সংখ্যায় খুব বেশি নয়, কিন্তু দেখায় বেশি। ঠিক যেমন, 'কত বড় আমি, কহে নকল হীরাটি তাইত সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।'

নোবেলের ধর্মই বুঝি এরকম, তা পেলে এত বড় অর্জনকে সহজে মেনে নিতে চাই না অনেকেই। আর বাঙালি তো এ ক্ষেত্রে এককাঠি সরেস। এ কারণে নোবেল প্রাপকের ওপর যেকোনো কলঙ্ক কালিমা লেপন করতেই আনন্দ খুঁজে পান কেউ কেউ—তাদের স্তাবক ও দলদাসেরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও রেহায় পাননি তাদের হাত থেকে। তার নোবেল পাওয়ার পর যা যা করা হয়েছিল তা ফিরে দেখলে কেবল লজ্জা লাগে না, বেদনাও জাগে, করুণা হয়। যেমন—

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছিলেন, 'বিশ্বসাহিত্যের অবস্থা যে এত শোচনীয় হয়ে গেছে, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার না পেলে তা জানা যেতো না।' প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও কিন্তু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্য ছিলেন।

২. আনিসুজ্জামান জানাচ্ছেন যে, 'রবীন্দ্রনাথকে একদা আখ্যা দেওয়া হয়েছিল "পায়রা কবি" ও "হেঁয়ালি কবি" বলে।' আর আমরা তো জানি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের রচনাকে বলেছিলেন অস্পষ্ট, অশ্লীল ও দুর্নীতিপরায়ণ।

৩. একজন এমন কথাও লিখেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'গীতাঞ্জলি' রচনার আগে রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়া থেকে বাউলের গানের যে খাতা নিয়ে গিয়েছিলেন, এখন সেটা তার ফেরত দেওয়া উচিত—নোবেল পুরস্কার তো পেয়েই গেছেন।

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, 'দুঃখ পাবে। পেতে হবে। যত উঠবে তত তোমাকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। এ দেশে জন্মানোর ওই এক কঠিন ভাগ্য। আমি নিষ্ঠুর দুঃখ পেয়েছি। … মধ্যে মধ্যে ভগবানকে বলি কি জানো তারাশঙ্কর? বলি-ভগবান পুনর্জন্ম যদি হবেই, তবে এদেশে যেন না জন্মাই।'

নোবেল প্রাপকদের ওপর খড়গহস্ত হওয়ার প্রবণতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে শুরু হয়েছিল এবং কালব্যাধির মতো আজও তা আছে। বাস্তবদৃষ্টে মনে হয়, সেই প্রবণতা আরও বেশি অসূয়ক ও অরাতির চরম পরাকাষ্ঠায় পৌঁছেছে। যা সর্বৈবপ্রকারে দৃশ্যমান হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে।

নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনকেও প্রায় নবতিপর বয়সে এসে জমি দখলের অভিযোগ শুনতে হয়েছে, তাও আবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের যে কয়েকজনকে শিক্ষার্থীকে নিয়ে গর্ব করতে পারে, সারা বিশ্বে অমর্ত্য সেন তাদের অন্যতম।

তার নানা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভীষণ প্রিয়। তার আমন্ত্রণেই তিনি বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ক্ষিতিমোহনের নোবেল লরিয়েট নাতির বিরুদ্ধে যখন জমি দখলের অভিযোগ আনা হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে রাষ্ট্রের শাসক-প্রশাসক চাইলে কী না করতে পারেন!

কিন্তু তাতে যে এইসব গুণী ব্যক্তিত্বরা আরও উজ্জ্বল হন। বিপরীতে শাসক-প্রশাসকবর্গের জিঘাংসা মনোবৃত্তি ও চোগলখোরি মানসিকতায় রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহৎ পরিসরে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্টাকারে ধরা পড়ে, তা কি তারা বোঝেন না? নিশ্চয় বোঝেন। কিন্তু সেসবকে পদদলন করেন নিজেদের একগুঁয়েমিতা, অসূয়ক বৃত্তি ও অরাতি মানসিকতার কাছে; যার সঙ্গে যুক্ত থাকে শাসকের দণ্ড ও ক্ষমতার দম্ভ।

২০০৬ সালের সেই মাহেন্দ্রমণ্ডিত সময়ের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখা। শেষ করব, এই ২০২৪ সালের ২৭ জুনের একটা ঘটনা বলে।

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা। শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল স্বপ্নদলের নাটক 'হেলেন কেলার'। মহীয়সী এই নারীর জন্মদিন উপলক্ষে মঞ্চায়িত এই নাটকের সুবাদে জানা গেল অনেক কিছু। ১৮৮০ সালের ২৭ জুন জন্মেছিলেন তিনি। দৃষ্টি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়েও মেধা ও প্রজ্ঞায় হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়ের অন্যতম একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। চার্লি চ্যাপলিন, আইনস্টাইন, মার্ক টোয়েন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো যশস্বী ব্যক্তিরা হেলেনের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন।

হেলেন কেলারকেও একবার লেখালেখিতে কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগে আদালতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। পরে হেলেনের মনে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল যে ট্রাইব্যুনাল কেন মিথ্যের ওপর ভর করে তাকে এত বড় অপবাদ দিলো? তাদের পক্ষে কি এই সহজ বিষয়টা বোঝা এতটাই অসম্ভব ছিল যে দুজন মানুষ একই সময়ে একই ধরণের চিন্তা করতেই পারে? রাগে দুঃখে অপমানিত হেলেন সেদিন লেখালেখি চিরদিনের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পণ করেছিলেন। তার টিচার অ্যান সুলেভান তখন বলেছিলেন, বড় কিছুর জন্য বড় বাধা আসবেই। বড় মানুষের ধর্ম হলো সেই বাধা অতিক্রম করে নিজের কাজটা করে যাওয়া। হেলেন সারাজীবন এই শিক্ষাটাকে মুকুট জ্ঞান করেছিলেন।

একজীবনে হেলেন অনেক অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, 'প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম'। নাটকে যখন এই অংশ মঞ্চস্থ হচ্ছিল, তখন বাম পাশের একজন ফিসফিসিয়ে আরেকজনকে বললেন, আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই পুরস্কার পেয়েছেন। তারপর ডানপাশের একজন মা কন্যার কানে কানে বললেন, ওই একই কথা।

যদিও মঞ্চনাটকে কথা বললে অস্বস্তি হয়। তারপরও সবাই কানে কানে পৌঁছে দিলো একই বার্তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে-স্বউদ্যোগে—আমাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এই পুরস্কার পেয়েছেন। মুহূর্তেই পুরো মিলনায়তন ওই একটা সূত্রে তুলনামূলকভাবে অনেকে বেশি একাত্ম হয়ে উঠল 'হেলেন কেলার' মনোড্রামার সঙ্গে।

আমরা লক্ষ্য করলাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে এখনো কীভাবে সবাই গর্ব ও গৌরব বোধ করেন। কীভাবে তাকে আপনার জন জ্ঞানে আমাদের করে নেন। এসব ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে বৃহত্তর যে জনমানস ও ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের বাইরের যে দুনিয়া, সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনেক বেশি 'আপনার' জন, 'আমাদের' হয়ে ওঠা প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব।

অথচ আমরাই বলি পঞ্চমুখে, 'যে দেশে গুণের কদর নেই, সেদেশে গুণী জন্মাতে পারে না।'

২৪ জুন ২০২৪ 

পুলিশের প্রতি জনতার কেন এতো ক্ষোভ?

পুলিশের মাঝেও আছে নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কিন্তু অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের ভিড়ে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখেছি তা কেবল প্রশ্নবিদ্ধ‌ই নয়, বরং ন্যাক্কারজনক। আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছে পুলিশের অবস্থান কোথায় ঠেকেছে তা বলতে অধিক গবেষণার প্রয়োজন নেই। কেবল শিক্ষার্থী নয়, বরং জনসাধারণের কাছে পুলিশ এখন প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই অঞ্চলে বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান হয়ে বর্তমান বাংলাদেশেও পুলিশ বহন করে চলছে একই ভাবমূর্তি।

মির্জা নুরুল হুদা, আইয়ুব খানের পতনের পর বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন যিনি, ছিলেন জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রীও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স পাশ করে যখন তিনি সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন: "বাবা, জীবনে আর যাই হও, আমি মেনে নিবো কিন্তু পুলিশ হ‌বা না" (Baba, whatever you want to be in life is fine with me, but, you must never be a policeman). তিনি চাইলে তখন IPS (Indian Police Service) অফিসার হিসেবে জয়েন করতে পারতেন কিন্তু তাঁর মায়ের এই নির্দেশ ভঙ্গ করেননি। এই ঘটনা ১৯৪০ সালের, আজ থেকে ৮৪ বছর আগে। এই ৮৪ বছরে কি পুলিশের প্রতি গণমানুষের এমন ধারণা পাল্টেছে?

পাল্টানোর তেমন কোনো কারণ ঘটেনি, বরং বেড়েছে। ব্রিটিশ কলোনি থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান আমলে যখন মানুষ আজাদির স্বপ্ন নিয়ে শুরু করছেন জীবনযাত্রা তখন ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক শহীদ আসাদ এবং নব্বইয়ের গণ‌অভ্যুত্থানের নায়ক শহীদ নূর হোসেনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হ‌ওয়ার ঘটনা এখন প্রায় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তো তার উচ্চতর কর্মকর্তার আদেশ ব্যতীত গুলি করে না, তাহলে তাদের দোষ কোথায়?

ব্যাপার হলো, নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলির কারণে কেবল পুলিশকেই ঘৃণা করা হয় ব্যাপারটি তা নয়, বরং সরকারের উচ্চতম কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গুলি করা পুলিশ পর্যন্ত— পুরো চেইন মানুষ চিহ্নিত করে এবং ঘৃণা করে। যে কারণে ভাষা আন্দোলনে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এবং মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিও গণমানুষের ক্ষোভ প্রকাশ পায়। এভাবেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আসাদকে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে আইয়ুব খান এবং নব্বইয়ের গণ‌অভ্যুত্থানে নূর হোসেনকে গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে এরশাদকেও মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আবার চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও গুলি করা পুলিশের সাথে সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিও গণমানুষের ক্ষোভ উপচে পড়ছে। ফলে, গুলির প্রতিক্রিয়ায় গণমানুষের ঘৃণার ভাগিদার কেবল পুলিশ একা নয়, বরং সরকার ও প্রশাসনের পুরো চেইন।

আর পুলিশকে কেবল গুলির কারণে মানুষ অপছন্দ করে তাও নয়, বরং বছরজুড়ে গণমানুষের বিভিন্ন হয়রানির সাথেও তারা জড়িত থাকে বিধায় অন্যান্য পেশার চেয়ে পুলিশের প্রতি ক্ষোভটা বেশি। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও, টাকার বিনিময়ে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া, অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া এবং চার্জশিট থেকে নাম প্রত্যাহারসহ নানাবিধ সমস্যার সমাধান পুলিশ স্রেফ টাকার বিনিময়ে নিমিষেই সমাধান করে দিতে পারেন। এই বিষয়ে বোধহয় পুলিশের জুড়ি নেই। 

ফজলুর রহমান বলেছেন, "আগে যেসব দারোগা ঘুষ খেতো এবং মানুষ সে ব্যাপারে জানতে পারতো তাদের সাথে মানুষ আত্মীয়তা করতে চাইতো না, তাদেরকে ঘৃণা করতো।" ঘুষ খাওয়া পুলিশের প্রতি এই ঘৃণাত্মক মনোভাব বহাল আছে; কারণ ঘুষ খাওয়া দারোগারাও আছে বহাল তবিয়তে।

পাসপোর্ট এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের সময় দায়িত্বরত পুলিশকে টাকা না দিলে যে পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ঘুষের ক্ষেত্রে পুলিশের দুর্নাম রাতারাতি হয়নি; একটা দীর্ঘ সময় নিয়ে আমাদের সমাজে ও প্রশাসনে এই আলাপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং এটি যে নিছক গুজব কিংবা অপপ্রচার নয় তা কিছুদিন পরপরই কিছু পুলিশ সদস্য তাদের অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন, যা আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পারি। সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের কীর্তিকলাপ এখনো বেশ তাজা খবর। স্বভাবতই মানুষ ধারণা করে, একজন পুলিশপ্রধান যখন এমন লুটপাট করতে পারে তাহলে তার অধিনস্তরা না জানি কী করে! বদরুদ্দীন উমরের একটি কথা আছে, একটি ডাকাতের দল যখন দলপতি নির্বাচন করে তখন তারা দলের সবচেয়ে বড় ডাকাতকেই সে সম্মান দিয়ে থাকে।

অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান বলেছেন, "আগে যেসব দারোগা ঘুষ খেতো এবং মানুষ সে ব্যাপারে জানতে পারতো তাদের সাথে মানুষ আত্মীয়তা করতে চাইতো না, তাদেরকে ঘৃণা করতো।" ঘুষ খাওয়া পুলিশের প্রতি এই ঘৃণাত্মক মনোভাব বহাল আছে; কারণ ঘুষ খাওয়া দারোগারাও আছে বহাল তবিয়তে। এই ঘুষের সাথে যখন যুক্ত হয় হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন ও গুলির ঘটনা তখন ঘৃণার তীব্রতা বাড়তে থাকে। এই ঘৃণা দেখতে পাওয়া যায়, কোনো পুলিশ আহত বা নিহতের খবরের কমেন্টবক্সে; অসংখ্য মানুষ ইন্না লিল্লাহ'র পরিবর্তে আলহামদুলিল্লাহ লিখে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করে। অথচ কথা ছিল, রাষ্ট্রের একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী মারা যাওয়ায় নাগরিক স্বেচ্ছায় শোক পালন করবে। যেমনভাবে কথা ছিল পুলিশ হবে জনগণের বন্ধু আর বিপদের সাথী।

বাংলাদেশের টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে পুলিশের যে চিত্রায়ন আমরা দেখি তার মধ্যে অধিকাংশই থাকে নেতিবাচক চরিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়ক কিংবা সেমি-খলনায়কের ভূমিকায় পুলিশের উপস্থিতি একসময় ধরাবাঁধা ব্যাপার ছিল। রাজনৈতিক নেতাদের টাকা খেয়ে তাদের হয়ে কাজ করার পুলিশি চরিত্র চলচ্চিত্র ও নাটক উভয় ফরম্যাটেই দেখা যায়। প্রশ্ন হলো, চলচ্চিত্র ও নাটকের এই চিত্রায়ন কি বানোয়াট, ভিত্তিহীন নাকি অন্য সকল চরিত্রের মতোই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া? পুলিশের প্রতি গণমানুষের সামাজিক ক্ষোভের জায়গায় ডিজিটাল মিডিয়ার পুলিশি চিত্রায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ছদ্রেল উলা খান চৌধুরী ১৯৯০ সালে প্রকাশিত 'অতীত কথা কয়' ব‌ইতে লিখেছেন, "বৃটিশ আমল থেকে একটা প্রবাদ আছে, পুলিশ ঘুষ খায়, তবে কম বেশী সবাই খেলেও দোষটা পড়তো পুলিশের ঘাড়ে, যত দোষ নন্দ ঘোষ। পুলিশ ঘুষ খায় কেন খায়, কি অবস্থায় খায় কার কাছ থেকে খায়, এ বিষয়ে কেউ তলিয়ে দেখে না। ভাল মানুষের কাছ থেকে পুলিশ কখনও ঘুষ খায় না এবং ভাল মানুষ পুলিশকে ঘুষ দেয়‌ও না। পুলিশ ঘুষ খায় খারাপ লোকের কাছ থেকে। সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে।" চৌধুরী ঠিক‌ই বলেছেন, ভালো মানুষ পুলিশকে ঘুষ দেয় না, দেওয়ার কারণ‌ও নেই। কিন্তু খারাপ, অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে যে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাদেরকে সহায়তা করা হয় এবং তাদের পক্ষে কাজ করে অনেক সময় ভিকটিমকে হয়রানি করা হয় তা পরোক্ষভাবেই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জনাব চৌধুরী স্বীকার করেছেন।

সদ্যঘটিত স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যার মধ্যেও পুলিশের শরিক আমরা দেখেছি। অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত— পুলিশ দুভাবেই শরিক হয়েছে। বনশ্রীতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে, রডে ঝুলে থেকে প্রাণ বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টারত একটি কিশোরকে লাগাতার কয়েক রাউন্ড গুলি করা পুলিশ যেমন দেখা গেছে, তেমনি পুলিশকে মেরে লাশ ঝুলিয়ে উল্লাসের দৃশ্য‌ও দেখা গেছে। প্রথম ঘটনা থেকেই দ্বিতীয় ঘটনার হাকিকত বোঝা যাবে। সেই অসহায় অবস্থায় কয়েক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ কিশোরের কোনো আত্মীয় যদি পরবর্তীতে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পুলিশের উপর অনুরূপ হামলার চেষ্টা করে তাহলে তার দায় কে নেবে?

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, পুলিশের মাঝেও আছে নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি। কিন্তু অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের ভিড়ে তারাও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কোনো দুর্নীতিবাজ এস‌আইয়ের অধীনে সৎ হাবিলদার বা কনস্টেবল থাকা একপ্রকার অসম্ভব। যে কারণে সৎ পুলিশদের কারণে পুলিশের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা সমাজে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, যতটা পেরেছে অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের কারণে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল তা দেখে আন্দোলনের সাথে যুক্ত কোনো ছাত্র কিংবা অভিভাবক কি পুলিশকে শ্রদ্ধা করবে? তারাই তো ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন পদ অলংকৃত করবে; তাদের মাঝে কিশোরাবস্থায় পুলিশ সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মনোভাব ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি।

একটি জাতীয় দৈনিকের সূত্রে জানা যায়, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক কর্তৃক চালু হ‌ওয়া কমপ্লেন সেলে, ২০১৭ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০ জুলাই ২০২২ তারিখ পর্যন্ত ৬১ হাজার অভিযোগ এসেছে। এই চার বছরে বিভিন্ন অভিযোগে সারাদেশে প্রায় ৬৫ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গড়ে মাসে এক হাজার ৩৫৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের বাৎসরিক সংখ্যাটা যদি আমরা দেখি, ২০১৮ সালে ১৪ হাজার ৪০২ ; ২০১৯ সালে ১৪ হাজার ৫১২ ; ২০২০ সালে ১৫ হাজার ২১২ এবং ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৪১৮। অর্থাৎ, অভিযোগ এবং অভিযুক্ত পুলিশের সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে।

সকল অভিযোগ সত্য তা নয়, কিন্তু অর্ধেক‌ও যদি সত্য হয় তাহলেও তা ভয়াবহ ব্যাপার। প্রতিটা সত্য ঘটনায় কোনো না কোনো সাধারণ মানুষ নিশ্চয়ই হয়রানির শিকার হয়েছেন। এভাবেই অতীতে যারা হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং বর্তমানে হচ্ছেন তাদের কেউ কি পুলিশকে 'বন্ধু/সেবক' হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন? তাদের পরিবারের কোনো সচেতন ব্যক্তি কি পারবে? পুলিশের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, দুর্নীতির খতিয়ান এবং হয়রানির অভ্যাস যত বাড়ছে দেশের জনসাধারণের কাছে সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে পুলিশের অবস্থান তত‌ই খর্ব হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যে ভূমিকা ছিল তা দেখে আন্দোলনের সাথে যুক্ত কোনো ছাত্র কিংবা অভিভাবক কি পুলিশকে শ্রদ্ধা করবে? তারাই তো ভবিষ্যতে দেশের বিভিন্ন পদ অলংকৃত করবে; তাদের মাঝে কিশোরাবস্থায় পুলিশ সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মনোভাব ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিণতি কী হতে পারে তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি।

শেখ হাসিনার পতনের পর, পুলিশ তাদের ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে কর্মবিরতিতে গিয়েছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের ঘৃণিত কর্মকাণ্ড নিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করতে রাজি নয়। তারাও সংস্কার চায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে পুলিশের লোগো এবং পোশাক পরিবর্তনের কথা বলেছেন। পুলিশ ছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়, এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো, আগের মতো লেজুড়বৃত্তির পুলিশ দিয়েও আর দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। পুলিশকে সংস্কার করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্ত করাই হবে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ।

ব্যবহৃত গ্রন্থাবলি:
১. My seven decades' journey through British India, Pakistan and Bangladesh : Mirza Nurul Huda, Upl, 2021
২. অতীত কথা কয় : এস ইউ খান চৌধুরী, ঢাকা, ১৯৯২