ভাবাদর্শিক ও নিপীড়ক কলকব্জা ভেঙে চুরমার

‘এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শ প্রচারকারীদের শুধু অসাড়ই করে দেয়নি, অনেকটা বিপদেও ফেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার এমন পলায়নে তারা হতভম্ব, বিস্মিত।’

গীতিকার ইমতিয়াজ মাহমুদের দুটো লাইন বারবার মনে পড়ছে—'লেখা আছে হাতের রেখায়, জাহাজ ডুববে অহমিকায়'। শেষ পর্যন্ত তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। শেষ পর্যন্ত অহংবোধ থেকেই পরাজিত হলো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। ভাবা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গলায় দড়ি দিয়ে টেনে ভূপাতিত করা হচ্ছে, ৩২ নম্বর পুড়ছে, পুড়ছে আওয়ামী সাম্রাজ্য!

একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করার সময় ২০১২ সালে ভাষা-মতিনের (ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন) একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর কয়েকদিন ঢাকা শহর পাকিস্তানি শাসনমুক্ত ছিল। স্বাধীন ছিল। মেডিকেল চত্বরে রাতারাতি নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে নেমেছিল মানুষের স্রোত। বর্ধিত জুলাইয়ের ৩৪ তারিখে (৩ আগস্ট) শহীদ মিনারের জনসমুদ্র দেখে ভাষা-মতিনকে মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, বাঙালির ভয় প্রথম ভেঙেছিল বায়ান্নর ফাল্গুনে। একটু দীর্ঘ বিরতিতে হলেও যে সাহস তারুণ্যকে সংক্রমিত করেছে বারবার। যে সাহস একগুঁয়ে, একনায়ক ও স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ করে বারবার তাগাদা দিয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশের।

জুলাইয়ের বর্বর হত্যাকাণ্ড ও গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রযন্ত্রে কী কী পরিবর্তন আনবে, তা হয়তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। কিন্তু এই নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানি স্কুল-কলেজ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে যে বড় পরিবর্তন এনেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজাকার আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর যে হত্যা-নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন, বর্বর। আমার ধারণা অভ্যুত্থান শেষে একজন শিক্ষার্থী যখন ক্যাম্পাসে ফিরবেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। তার মধ্যে বড় ধরনের এক পরিবর্তন ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে, যা নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নয়।

যতদূর অনুভব করতে পেরেছি, জুলাই হত্যাকাণ্ডে শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিষ্ঠুর নীরবতা শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেননি। নেওয়ার কোনো কারণও নেই। এমনকি শ্রেণিকক্ষে তাদের সঙ্গে আমরা যে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি, তা অনেকের কাছে প্রহসন ঠেকছে। দেবতার আসন থেকে ইতোমধ্যেই অনেক শিক্ষককেই তারা ছুড়ে ফেলেছেন। নীতিহীন, অনুভূতিহীন, অসংবেদনশীল আখ্যা দিয়ে অনেকক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করছেন। আকারে-ইঙ্গিতে আমাকেও অনেক শিক্ষার্থী টিপ্পনী কেটেছেন, কটাক্ষ করেছেন। আমি তাদের দোষ দেই না। হয়তো আমার কাছে তাদের প্রত্যাশাটা অনেক বেশি ছিল।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আসেনি। আমার ধারণা, নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে এক ধরনের বড় পরিবর্তন এসেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবাদর্শ প্রচারকারীদের মধ্যেও, যারা এক ধরনের সফট পাওয়ার হিসেবে সমাজে কাজ করে ক্ষমতাসীনদের মতাদর্শ প্রচার ও ক্ষমতা প্রলম্বিত করতেন। ফরাসি চিন্তক ও সমাজবিজ্ঞানী লুই আলথুসার যে বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা ভাবাদর্শিক কলকব্জা হিসেবে। লুই আলথুসারের মতে এই ভাবাদর্শিক কলকব্জার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও পরিবার।

২০০৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত সমাজে এক শ্রেণির মানুষের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ আমি নিজে দেখেছি। তাদেরকে আদর্শ বুদ্ধিজীবী মনে করেছি। কিন্তু হায়! জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা একদম নিশ্চুপ। রাষ্ট্রযন্ত্র এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার পরও তাদের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয়নি। আর অর্বাচীন মন্তব্যে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

এবার আসা যাক গণমাধ্যমের কথায়। আওয়ামী রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বারবার বলা হয়েছে, সবকিছুর জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী। কয়েকজন মন্ত্রীমশাই তো রীতিমতো কোরাস গেয়েছেন। কিন্তু দুনিয়ার কোনো গণমাধ্যম এই ন্যারেটিভ গ্রহণ করেনি। বরং সারাবিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে 'স্বৈরাচার' 'নৃশংস একনায়ক' বলেছে, যা আওয়ামী ভাবাদর্শ প্রচারকারীরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। বাংলাদেশের মূলধারার জনপ্রিয় শিল্পীরাও বৃষ্টিতে ভিজে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। বর্জন করেছেন আওয়ামী লীগের সিগনেচার সাংস্কৃতিক আয়োজন জয়বাংলা কনসার্ট। প্রতিবাদ জানিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অনেক ক্রীড়াবিদও। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন সাকিব ও মাশরাফি।

সবারই জানা যে, আওয়ামী লীগের অন্যতম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এই ধরনের চর্চা আছে। তাদের দলে নেওয়ার লক্ষ্য তারুণ্যের জনসমর্থন। মনে পড়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় সাকিব শিক্ষার্থীদের বার্তা দিয়েছিলেন। একটু চিন্তা করে দেখুন, এই দুই জাতীয় ক্রিকেটারের আজ কী পরিণতি! হত্যা, গণগ্রেপ্তার ও নিষ্ঠুর নির্যাতনে মুখবন্ধ রেখে তারা এরইমধ্যে সমাজে প্রত্যাখ্যাত, ধিক্কৃত। যার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। লুই আলথুসারের ভাষায় এটা আওয়ামী লীগের মতাদর্শগত কলকব্জা অকেজো হওয়ার চিহ্ন।

আমার মনে হয় জুলাইয়ের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শ প্রচারকারীদের শুধু অসাড়ই করে দেয়নি, অনেকটা বিপদেও ফেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার এমন পলায়নে তারা হতভম্ব, বিস্মিত। জুলাইয়ের জলজ্যান্ত হত্যাকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতাকে পাশ কাটিয়ে তারা কীভাবে আগামীতে দলীয় ভাবাদর্শ প্রচার করবেন, কীভাবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেবেন, সেটা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে এই পরিস্থিতি তাদের জন্য নিশ্চিতভাবেই ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, শেষ চেষ্টা হিসবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও গণজাগরণ মঞ্চকে সক্রিয় করার একটা চেষ্টা ছিল। এমনকি হেফাজতে ইসলামের একটি অংশকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা ছিল। তা সফল হয়নি। তারুণ্যের তোপে সব উড়ে গেছে।

লুই আলথুসার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভাবাদর্শিক কলকব্জার বাইরে আরেকটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা নিপীড়নমূলক কলকব্জা। যার মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আদালত ও কারাগার। আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শিক কলকব্জায় অসাড়তা আসার পর শেষ মুহূর্তের ভরসা হিসেবে শেখ হাসিনা এই অ্যাপারেটাসের ওপর বেশি নির্ভর করছে। যদিও এই অস্ত্র আগের মতো আর সক্রিয় ছিল না। নির্বিচার গণগ্রেপ্তার ও ব্লক রেইড দিতে দিতে ক্লান্ত বাহিনীগুলোর সদস্যরা শেষ দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। কোথাও কোথাও ফুল বিনিময়, একসঙ্গে চা পান করছেন। যদিও সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে কিছু সংশয় ছিল। কিন্তু ভরসার বিষয় শেখ হাসিনার 'ফাঁদে' পা দেয়নি সেনাবাহিনী। শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করে তারা নিয়েছেন জনগণের পক্ষ।

শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী ভাবাদর্শ আবার কবে, কীভাবে এই দেশে প্রতিষ্ঠা হবে, সেটার জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে তার আগে হিসাব হতে হবে আওয়ামী লীগের লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বিচার ছাত্রহত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধের। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত
560 Shares
facebook sharing button Share
twitter sharing button Tweet
whatsapp sharing button Share
sharethis sharing button Share

পুলিশের পাশে দাঁড়ান, আপনার শেষ ভরসাস্থল কিন্তু তারাই

পুলিশ বাহিনীর সংস্কার দরকার। যাতে করে আর এরকম পদলেহনকারী, দুষ্কৃতিকারী, দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক তোষামোদকারীদের সৃষ্টি না হয়। যেন এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন না ঘটে, পুলিশ যেন পেশাদারিত্বের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে।
ছবি: সংগৃহীত

আমরা আসলে কী প্রমাণ করতে যাচ্ছি? একনায়কতান্ত্রিক, দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে যখনই আমরা নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে যাচ্ছিলাম, আমরা এসব কী দেখতে পাচ্ছি? চারদিকে লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার এই বিশাল বিজয়কে কালিমাদীপ্ত করা হচ্ছে। বিশেষ করে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ নিরীহ পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, এসব নিরীহ পুলিশ সদস্যদের কোনোরকম ক্ষমতা নেই। তারা শুধু কিছু দুষ্কৃতিকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনৈতিক পালেহনকারী সিনিয়রদের আদেশ অনুসরণ করেছে। সেসব সিনিয়ররা এখন পলাতক। এসব দুর্নীতিবাজ, হত্যাকারী পুলিশ অফিসারদের বিচার অবশ্যই হবে দেশের মাটিতে। কিন্তু দিনশেষে আক্রান্ত হচ্ছে সেই আমাদের নিরীহ পুলিশ সদস্যরাই, যাদের অধিকাংশই ছাত্রদের এই যৌক্তিক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন।

কিন্তু এখন আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? প্রতিটি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ,অস্ত্রাগার লুট করা হচ্ছে ,পুলিশ সদস্যদের বিভিন্নভাবে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা কি ভাবছি যে পুলিশ ছাড়া একটা দেশ চলতে পারে? চারিদিকে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি, গণ-ডাকাতির কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমরা কোথায় যাব যদি পুলিশ না থাকে? আপনি কোথায় গিয়ে অভিযোগ দেবেন? আপনার যদি একটা জিডি করা লাগে, আপনার যদি একটা মামলা করতে হয়, আপনার যদি একটা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স লাগে, দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য?

পুলিশের জরুরি সেবার '৯৯৯' নম্বর মানুষের একটি আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। আমরা যখনই কোনো জায়গায় আক্রান্ত হচ্ছিলাম, যখনই কোনো জায়গা থেকে আলোর দিশা পাচ্ছিলাম না এবং এরকম অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে '৯৯৯' নম্বরে কল দিয়েছি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়েছি।

আমরা কি করোনা মহামারির কথা ভুলে গিয়েছি? যখন কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল, আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী বা অন্য কেউ সেই মরদেহ স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। তখন কিন্তু পুলিশ সদস্যরাই গিয়ে সেই মরদেহ সৎকার করেছে। ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছে, বাজার পৌঁছে দিয়েছে, আক্রান্ত হলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। তারা কিন্তু কখনো চিন্তা করেনি যে আমরাও করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। এ কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য পুলিশ সদস্য নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন।

স্বাধীনতার প্রথম বুলেট কিন্তু পুলিশের বন্দুক থেকেই বের হয়েছিল এবং অসংখ্য পুলিশ সদস্য সেদিন নিহত হয়েছিলেন। যেকোনো জাতীয় দুর্যোগের ক্ষেত্রে পুলিশ কিন্তু তার জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে এবং প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে সেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একটা আধুনিক দেশ পুলিশ ছাড়া চলতে পারে না, যেটার প্রমাণ আমরা কয়েক দিনেই পেয়েছি। অসংখ্য অভিযোগ আসছে, কিন্তু অভিযোগ নেওয়ার মতো কেউ নেই, ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কেউ নেই।

সংখ্যালঘু ভাই-বোনেরা আক্রান্ত হচ্ছে, সাধারণ মানুষজন, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। পুলিশের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিন, দিনশেষে কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বলেন, আইনগত আশ্রয় বলেন বা আইনগত বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ বলেন, সবশেষে কিন্তু আমাদের পুলিশের কাছেই যেতে হয়।

হ্যাঁ ,আমিও আপনাদের সঙ্গে একমত যে, পুলিশ বাহিনীর সংস্কার দরকার। যাতে করে আর এরকম পদলেহনকারী, দুষ্কৃতিকারী, দুর্নীতিবাজ, রাজনৈতিক তোষামোদকারীদের সৃষ্টি না হয়। যেন এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন না ঘটে, পুলিশ যেন পেশাদারিত্বের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে।

চলুন আমরা সেরকম পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলি এবং পুলিশ ভাইকে আমাদের নিজেদের ভাই বলে তাদের পাশে দাঁড়াই, কেননা প্রতিটি পুলিশ সদস্য আপনার-আমার কিংবা অন্য কারো ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী বা সন্তান এবং এই সমাজেরই অংশ। আসুন দেশটাকে আবার নতুন করে গড়ে তুলি, আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসি, পুলিশদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেই, যেন আরেকজন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত না হয়, যেন আর একজন সংখ্যালঘু বা সাধারণ মানুষ আক্রান্ত না হয়। চলুন নতুন বাংলাদেশ গঠনে সবাই অংশগ্রহণ করি।

সম্রাট মো. আবু সুফিয়ান: পুলিশ সুপার (জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গ থেকে ফেরত পদায়নের অপেক্ষায়)

বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার

দুপুর ২টার পরে রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রামপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার যে উল্লাসের চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাচ্ছিলো, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে অথবা তারা এরইমধ্যে সংবাদটি জেনে গেছেন।
গণ-আন্দোলন
ঢাকায় ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের একাংশ। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলে যাবে এবং সরকার পতনের আন্দোলনটি এত দ্রুত সফল হয়ে যাবে, সেটি হয়তো আন্দোলনকারীরাও ভাবেননি। তারা হয়তো ভেবেছিলেন, দেশব্যাপী যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, যেভাবে শত শত মানুষ নিহত হচ্ছিলো, তার ধারাবাহিকতায় দেশে হয়তো জরুরি অবস্থা জারি হবে এবং বিক্ষুব্ধ মানুষ সেটিও ভেঙে ফেলবে এবং তারপরে হয়তো আরও রক্তপাত ও প্রাণহানির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতাগ্রহণ করবে। তারপর হয়তো নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার গঠিত হবে।

কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেলো, আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক যেদিন 'বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে রূপান্তরের রূপরেখা প্রস্তাব' দিলো, তার পরদিনই এই ঘটনাটি ঘটলো—যে প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানানো হয়েছিল।

৫ আগস্ট সোমবার ছিল আন্দোলনকারীদের ঢাকা মার্চ কর্মসূচি। সকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে দুপুর ২টার দিকে এটি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ—সেটি পূরণ হতে যাচ্ছে। বিশেষ করে যখন জানানো হলো যে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন।

দুপুর ২টার পরে রাজধানীর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও রামপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার যে উল্লাসের চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যাচ্ছিলো, তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের দাবি পূরণ হয়ে গেছে অথবা তারা এরইমধ্যে সংবাদটি জেনে গেছেন।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগ বাদে দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল—যেমন: বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এমনকি সরকারের নির্বাহী আদেশে সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া জামায়াতের আমিরও এই বৈঠকে ছিলেন বলে তিনি জানান। সেইসঙ্গে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ছিলেন।

বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে সংসদ সদস্যদের বাইরে থেকে অন্য কাউকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুযোগ না থাকলেও রাষ্ট্রপতি তার বিশেষ ক্ষমতাবলে যদি কোনো অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন, তাহলে নির্বাচনের পরে সংসদের প্রথম অধিবেশনে সেটি অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। এরকম পরিস্থিতিকে বলা হয় 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'।

সংবিধানের জন্য দেশ নয়, বরং দেশের জন্য সংবিধান। অতএব কোনো এক সংকটময় মুহূর্তে যদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, সেখানে সংবিধানের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দেশ ও দেশের মানুষের নিরাপত্তা।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ বন্ধুবৎসল। এখানে পারিবারিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী। একই পরিবারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি এমনকি ইসলামি দলের অনুসারী আছেন। সুতরাং দিন শেষে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশে যে ব্যক্তি আক্রমণ হয়েছে, সেটির পুনারবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সেনাপ্রধান যে বার্তাটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন তা হলো, প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের কেউ যাতে আর কোনো ধরনের হামলা-ভাঙচুর বা সংঘাতে না জড়ান। সবাই যেন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন।

কিন্তু দেখা গেলো, পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সংবাদ শোনার পরপরই গণভবনে হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছেন। যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের পরে। যদিও প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। হুবহু সেরকম না হলেও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার সংবাদ শোনার পরে বিক্ষুব্ধ লোকজন যেভাবে গণভবনে ঢুকে গেছে—তার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার রাজপ্রাসাদ দখলের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তবে এটি নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে রাজধানীর বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে কিছু ক্ষুব্ধ জনতা। এটি পুরো জাতির জন্য লজ্জার। রাজনৈতিক মতভিন্নতা বা মতবিরোধের অর্থ এই নয় যে, সবকিছু ভেঙে ফেলতে হবে, সব স্থান ও স্থাপনায় আঘাত হানতে হবে। এটি কোনো সভ্য আচরণ নয়।

গণভবনে ঢুকে চেয়ার টেবিল এবং ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে নিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য টেলিভিশনের খবরে দেখানো হয়েছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত। সুতরাং কেউ যাতে প্রতিহিংসার পথে পা না বাড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

মনে রাখতে হবে, আজকে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একটি সরকারের পতন হলো যেসব কারণে, তার অন্যতম এই প্রতিহিংসা এবং বিরোধী মত ও আদর্শকে ন্যূনতম জায়গা না দেওয়া; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলই শুধু নয়, বরং নির্দলীয় লেখক-সাংবাদিক-নাগরিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের দমনের চেষ্টা করা; তাদেরকে শত্রু বিবেচনা করে কণ্ঠরোধ করা। সুতরাং নতুন সরকারের আমলে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়; বিপক্ষে কথা বললেই বা লিখলেই যেন তাকে শত্রু বিবেচনা করে প্রতিহত করার চেষ্টা করা না হয়—সে বিষয়ে সবার সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।

নতুন সরকারের উচিত হবে সকল রাজনৈতিক মত ও পথের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সারা দেশে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে যে, কেউ যেন ভিন্ন মত ও আদর্শের কারণে আক্রমণের শিকার না হন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যাতে আক্রমণের শিকার না হন, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী যেসব কর্মকর্তা নিজেদের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, প্রচলিত আইনেই তাদের বিচার হোক। তারা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন এবং দেশে থাকলেও তাদের ওপর যেন কোনো ধরনের আক্রমণ চালানো না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ বন্ধুবৎসল। এখানে পারিবারিক কাঠামো অত্যন্ত শক্তিশালী। একই পরিবারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি এমনকি ইসলামি দলের অনুসারী আছেন। সুতরাং দিন শেষে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে বছরের পর বছর ধরে দেশে যে ব্যক্তি আক্রমণ হয়েছে, সেটির পুনারবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।

মনে রাখা দরকার, দেশটি আওয়ামী লীগের যেমন নয়, তেমনি বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি কিংবা কোনো বাম দলেরও নয়। দেশটা মানুষের। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের সকল ক্ষমতার মালিক দেশের জনগণ। সকল ক্ষমতার মালিক মানে দেশেরও মালিক।

অতএব আগামী দিনে বাংলাদেশ কেমন থাকবে সেটি নির্ভর করছে এই জনগণের আচরণের ওপর। প্রতিহিংসা বা হঠকারিতার মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বরং সবার সংযত আচরণের মধ্য দিয়েই একটি সুন্দর, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব। এই সুযোগটি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

খুনগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাসকগোষ্ঠীকে

খুনের খতিয়ান বড় হচ্ছে-যা বেদনাদায়ক! রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কবরের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ কফিন রেখে গায়েবানা জানাজা, ছবি: স্টার

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকারি হিসেবে খুন হয়েছে ৪৫ জন ছাত্র। ন্যায্য দাবির জন্য এতো কেন প্রাণ ঝরে গেলো। খুনের ক্ষুধা এতো দিন ধরে রাষ্ট্র লালন করেছে? রাষ্ট্র কেবল খুন করে ক্ষান্ত হয়নি তা যে ন্যায্য তা প্রমাণে নতুন নতুন বয়ান হাজির করছে। হত্যাকাণ্ডের শিকারদের নানা ধরনের ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। যেমন-সরকারি বিধিনিষেধ না মানা এবং ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া এসব।

যেমন রংপুরে নিহত আবু সাঈদকে শিবিরকর্মী হিসেবে উপস্থাপন। সরকার সবসময় যে ধরনের বাধ্যনুগত জনগণ চান, জনগণের পক্ষে সবসময় তা হয়ে উঠা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্র এক ‍বৃহৎ সমঝোতামূলক, জনগণ কর্তৃক নির্মিত। কিন্তু নির্মাণের পর রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব থাকছে না। জনগণ ও রাষ্ট্র হয়ে উঠছে পরষ্পর বিরোধী সত্তা। আর রাষ্ট্র হলো এক হৃদয়হীন কাঠামো।

যাহোক, হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কী কোনো ন্যায্য যুক্তি থাকতে পারে? পারে না। খুন তো খুনই। এতোগুলো ছাত্র জীবনের পূর্বান্তে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে কে ভেবেছে? খুন একদম অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা। এক স্বয়ংভূ বর্বরতার ইতিহাস। আর এ ইতিহাস হলো টিপ অব দ্য আইসবার্গ। একটা খুনের ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধানে বিশেষ সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতি লাগে। সক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতির অভাব এবং অসৎ উদ্দেশ্য মিলিয়ে যে কর্তৃত্ব তৈরি হয় এর চেয়ে নির্মম কর্তৃত্ব আর কী হতে পারে?

মানুষ হত্যাকাণ্ডগুলো দেখে ফেলেছে। এসব কোনো গুপ্ত বাহিনী করেনি, করেছে রাষ্ট্রীয় অনুগত দল এবং দিবালোকে। ছাত্রদের উদোমবুক ঝাঝরা করছে বুলেট। পাহাড়সম কষ্ট আজ ভর করছে। জনগণ অন্যায্য কিছু ভুলতে চায় না।

খুনগুলো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাসকগোষ্ঠী ও জনগণকে। শাসকগোষ্ঠী চাচ্ছে কতো তাড়াতাড়ি খুনের ঘটনা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। এ জন্য নতুন নতুন ঘটনা তৈরি করছে। জনগণকে সেই দিকে মনোযোগী করে তোলার চেষ্টা করছে। কথা হলো কর্তৃত্ববাদী শাসনের নিচে ইতিমধ্যে গড়ে উঠছে ঠুনকো জনস্মৃতি যার সর্বোচ্চ আয়ু পনের দিন। যেমন-আকাশ চুম্বী দুর্নীতি খবর, কখনও চন্দ্রবোড়া সাপ বা ৪০০ কোটি টাকা।

জনগণের স্মৃতি ভাঙাচুরা বা তাৎক্ষণিকতার ভেতর থাকতে বাধ্য করার অপচেষ্টায় যে এতে খুব বেশি লাভ যে হচ্ছে তা বলা যাবে না। কারণ, মানুষ হত্যাকাণ্ডগুলো দেখে ফেলেছে। এসব কোনো গুপ্ত বাহিনী করেনি, করেছে রাষ্ট্রীয় অনুগত দল এবং দিবালোকে। ছাত্রদের উদোমবুক ঝাঝরা করছে বুলেট। পাহাড়সম কষ্ট আজ ভর করছে। জনগণ অন্যায্য কিছু ভুলতে চায় না। মেমোরিতে রেখে দিতে চায়। ঘটে যাওয়া খুনের ঘটনা বিবেকবানদের তাড়া করে ফিরছে। এতো অমানবিকা বাংলাদেশ কেউ চায়নি।

খুনে কেবল ব্যক্তি খুন হয় না, খুন হয় ব্যক্তির বিস্তর গুণ ও অমিত সম্ভাবনা। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযুক্তির কারণে অচেনা একজন মানুষের খুনও সে গ্রহণ করে না। প্রতিটি খুন  জনমনস্তত্ত্বে গভীর অভিঘাত তৈরি করে। কবি শামসুর রাহমানের 'না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন' এর একটি কবিতার নাম হলো গুণ খুন।

''যুবাদের বাক্যালাপ শুনে আমার হৃৎপিন্ড শুধু
খাঁচার পাখির মতো ডানা ঝাপটায়
ঘন ঘন। কী করে সবাই ওরা চিনে তাকে
যাকে উন্মত্তাবশে খুন করে দিয়েছে কবর
আমার ঘাটের নিচে। কখনো কখনো মধ্যরাতে
সে হেঁটে বেড়ায়
স্বপ্নচারিতায় ঝুলবারান্দায়, কার্নিশে।''

হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে রাষ্ট্র পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছে দুখের ঝাঁপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা কী তিনি তা খুব ভালো করেই জানেন। দ্য আর্ট অব স্টোরি টেলিং: ফ্রম প্যারেন্ট টু প্রফেশনালের লেখক অধ্যাপক হানা বি. হার্ভে লিখেছেন, ''যখন আমরা পরিবারের কাউকে হারাই তখন তিনি মূলত গল্পের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকেন'' রাষ্ট্র উপহার ‍দিচ্ছে অসংখ্য খুনের গল্প। বাবা-মা,পরিবার-পরিজন বাকি জীবন বেঁচে থাকবে এসব খুনের গল্পের ভেতর, ট্রমার ভেতর।

খুনের পরিসংখ্যান নিকষ, কালো ও খটমটে। এগুলোর ভেতর ব্যক্তির মুখ নেই। বাস্তবতা হলো প্রতিটি খুন বেঁচেবর্তে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের দীর্ঘপ্লট। কারণ তারা ছিল পরিবারগুলোর আগামীর আশ্রয়, নির্ভরতা ও বেঁচে থাকার অবলম্বন। মুহুর্তের মধ্যে পরিবারে সে স্বপ্ন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে।  হত্যার গড় পরিসংখ্যান মোটের ওপর চোখ বুলাতে শেখায়, কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তির ওপর নয়।

মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জীবন যেমন অনন্য, তেমনি প্রতিটি মৃত্যু স্বতন্ত্র। জীবন বা মৃত্যুর কোনো গড় হিসাব হয় না। সম্প্রতি হত্যাকাণ্ড গড় হিসাব কষতে শিখাচ্ছে। খুনের শিকার ছাত্রদের বহুমাত্রিক পরিচয়ের বিপরীতে দাঁড় করানো হচ্ছে একরৈখিক পরিচয় যা হলো খুন একটি লাশ মাত্র।

হতাহতের পরিসংখ্যান বড় না ছোট সেটা বড় কথা নয়- তার সকল মাত্রাগুলো ধরা যাচ্ছে কীনা।  বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে কীনা? কারণ, পরিসংখ্যান  নিজেকে প্রকাশ করে অন্যসব মাত্রা নির্গুণ করে। মানুষ যখন পরিসংখ্যানে পরিণত হয়, তখন তা কল্যাণকর হয়- না এমন বিশ্বাস আমাদের লোকজ চিন্তায় পাওয়া যায়-'গুণতির বছর মড়কি লাগে' অর্থাৎ যে বছর আদম শুমারি হয়, সে বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, প্রাণহানি ঘটে। ইতিহাসে তার নজির রয়েছে। কোনো হতাহতের পরিসংখ্যান দেখতে চাই না।

মানুষে এক অজেয় সত্তা। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তাকে মেরে শেষ করা যাচ্ছে না। মানুষ অমর হয়ে উঠছে। মানুষের সংখ্যা কমছে না বাড়ছে।

বাস্তবতা হলো পরিসংখ্যান হয়ে ওঠার আশঙ্কা মানুষকে তাড়া করে ফিরছে। মৃত্যুর পরিসংখ্যান উৎকণ্ঠা তৈরি করে, ব্যথা জাগায় না। কারণ সংখ্যার কাজ মস্তিস্কে, হৃদয়ে নয়। পরিসংখ্যানে গল্প নেই, নেই জয়-পরাজয়, আবেগ-অনুরাগের অনুরণন। তাই খুনগুলো পড়তে সংখ্যার বাইরে এনে । ভালো খবর হলো, সংবাদপত্রগুলো এমন অনেক একক ঘটনা তুলে ধরছে-ফলে ঘটনার গভীরে যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে। যেমন-রংপুরের পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের ঘটনা।

খুনের খতিয়ান বড় হচ্ছে-যা বেদনাদায়ক! রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে কবরের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। অরুন্ধতী রায় ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে একটি বক্তৃতা করেন। বিষয় ছিল দ্য মুসলিম গ্রেভিয়াড টক ব্যাক : ফিকশন ইন দ্য টাইম অব ফেক নিউজ। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, কাশ্মীরবাসীর স্বাধিকার আন্দোলন দমনে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী যে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে কাশ্মীরে কবরের বিস্তৃত ঘটেছে ভয়াবহভাবে।

মানুষে এক অজেয় সত্তা। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তাকে মেরে শেষ করা যাচ্ছে না। মানুষ অমর হয়ে উঠছে। মানুষের সংখ্যা কমছে না বাড়ছে। নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতায় মেতে উঠছে মানুষ। নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে। অনায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।  প্রতিরোধে সে সবচেয়ে সুন্দর। হুমায়ুন আজাদ 'গরীবের সৌন্দর্য কবিতায় লিখেছেন-

''জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়...।''

বাঙালির স্বভাবে রয়েছে এক দ্রোহী মনোভাব। যেকোনো নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদী হয়েছে। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ইতিহাস দেখা গেছে জমিদারদের ‍বিরুদ্ধে এ দেশে কৃষক-প্রজা অসংখ্যা বিদ্রোহ করেছে, পরাস্ত করেছে। ফকির সন্নাসিরাও পিছিয়ে ছিল না। পাকবাহিনী পরাজিত করেছে বীরদর্পে। শাসকগোষ্ঠী যখন নিপীড়নের পথ বেছে নেয় তখন বুঝতে তাকে মৃত্যু পিপাসা টানছে। আর মৃত্যু নিষ্ঠুর বলে তার আপন কেউ নেই।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ যর্থাথ লিখেছেন, আমাদের ইতিহাস তো শুধু মার খাওয়ার নয়। আমাদের ইতিহাস হিসাব নেওয়ার, আমাদের ইতিহাস প্রতিরোধেরও (প্রথম আলো) 

১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল পুলিশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দেয়। ট্রাকের তলায় পিষ্ট করে হত্যা করে সেলিম ও দেলোয়ারকে। কবি ফরহাদ মজহার এর প্রতিবাদে 'লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক' শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতার শেষের কয়েকটি লাইন হলো-

 মিছিল নিরন্তর সামনের দিকে
সব মিছিল এখন সামনের দিকে
আমাদের সব মিছিল সিধা সাদা সামনের দিকে
…শেষবার সামনাসামনি
ফায়সালা হবে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দাবির প্রতি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন বাড়ছে। মানুষ বেরিরে আসছে। প্রতিবাদ ও মিছিলের সারি লম্বা হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে লাল-সবুজের পতাকাজুড়ে। যেকোনো নিপীড়ন বন্ধে সবার দায় রয়েছে। চাই কল্যাণমুখী, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ। খুন চাই না, খুনের হিসাব কষতেও চাই না। চাই সবার জন্য বাংলাদেশ।

The Daily Star  | English

Interim govt to initiate ICT trial of killings during student protests: Asif Nazrul

The government is also trying to ensure that ICT investigators work under the supervision of United Nations, he says

Now

হত্যাকারী কীভাবে নিজের বিচার করবে : আনু মুহাম্মদ

সরকারকে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে যেতে হবে। এই হত্যার বিচার করতে হবে
হত্যাকারী কীভাবে নিজের বিচার করবে: আনু মুহাম্মদ
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ | ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় সংঘর্ষের শুরু; আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হামলা ও গুলি; পুলিশ- র‍্যাব-বিজিবির টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও বুলেটে নিহত দেড় শতাধিক ও আহত কয়েক হাজার।

কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পর কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয়েছে গণআন্দোলনে। শিক্ষার্থী ছাড়াও আন্দোলনে এখন যোগ দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

একটি মাত্র দাবি নিয়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন কেন এমন রূপ পেলো; সরকার, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা; ইতিহাসসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সঙ্গে আলাপচারিতায়।

দ্য ডেইলি স্টার: কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের এমন আচরণের কারণ কী হতে পারে?

আনু মুহাম্মদ: কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা থাকলে, ক্ষমতার দম্ভ থাকলে দেখার চোখটা চলে যায়। তখন মনে হয় আমি যা করবো সেটাই ঠিক এবং ধমক দিলেই সব চুপ হয়ে যাবে। এই সংস্কৃতিটা স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতি।

ডেইলি স্টার: স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতি আমাদের এখানে নতুন না, বহু বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে। একাত্তরের পর এভাবে সরাসরি গুলি করে মানুষ হত্যা আপনি কবে দেখেছেন প্রথম?

আনু মুহাম্মদ: গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ বা এমন আওয়াজ আমরা আগেও শুনেছি। কিন্তু, প্রত্যক্ষভাবে এভাবে একের পর এক গুলি করা এবং এত প্রাণহানী; এমন নির্বিচার গুলি করা যে বাসার বারান্দায়, ছাদে, ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যাবে; আন্দোলনকারীরা তো বটেই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন শ্রমজীবী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পেশাজীবী মানুষও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এমন নির্বিচারে গুলির ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে কখনোই ঘটেনি।

আমরা তিনটি উন্নয়ন দশকের স্বৈতান্ত্রিক শাসন দেখেছি—আইয়ুব খান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং তাদেরকে অতিক্রম করে চলা উন্নয়নের দেড় দশকে শেখ হাসিনা।

তিন দশকেই অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক অনেক আন্দোলন হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ওপর জুলুম হয়েছে। কিন্তু এবারেরটা সকল ইতিহাস অতিক্রম করেছে, এমনকি এই সরকারের এবং অন্যান্য সরকারের সকল অতীত রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এইমাত্রায় হত্যাকাণ্ড আগে কখনো হয়নি।

এইমাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা আগে কখনো হয়নি। মুক্তিযুদ্ধকে ঢাল হিসেবে নিয়ে খুন, লুটপাট, বিদেশে সম্পদ পাচার, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি এবং এইমাত্রায় শিশু-কিশোরদের হত্যা করা, তাদের ওপর বর্বর নিপীড়ন আগে কখনো করা হয়নি।

এ কারণেই বলি, মুক্তিযুদ্ধকে দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং পুনরায় জনগণের হাতে নিয়ে আসতে হবে।

ডেইলি স্টার: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তৃতীয়পক্ষ—বিএনপি, জামায়াত, শিবির—এসব ধ্বংসযজ্ঞ করছে, সরকার কিছু করছে না।

আনু মুহাম্মদ: সরকারের যুক্তির এই ধরন নতুন কিছু না। যেকোনো আন্দোলনে এটাই বলা হয়। ২০১০ সাল থেকে এটা শুনে আসছি। এটাকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মানুষের অধিকারের আন্দোলন, এমনকি শ্রমিকের মজুরির দাবিতে আন্দোলনেও এই কথা বলা হয়। নারীদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও এটা শুনেছি। সুন্দরবন আন্দোলন, তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন জনস্বার্থবিরোধী চুক্তির সময়ও আমরা এগুলো শুনেছি।

এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা বিকৃত করে এবং অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারনাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন সব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের নাম ব্যবহার করা হয়, যাতে বিএনপি-জামায়াতের আরও গৌরব বাড়ে। যে কাজ তারা করেনি, সেখানেও তাদের নাম আসে। তাতে মনে হয় যে বিএনপি-জামায়াত গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছে, জনগণের সঙ্গে আছে। এভাবে তাদের নামে এক ধরনের প্রশংসাসূচক কথা ছড়ায় সরকার। জামায়াত-বিএনপিকে যতটা কৃতিত্ব সরকার দেয়, ততটা কৃতিত্বের দাবিদার তারা না।

ডেইলি স্টার: আইনজীবী মানজুর আল মতিন শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করায় তাকে জামায়াত-শিবির বলা হচ্ছে। এসব করে সরকার ও দেশের উপকার কী?

আনু মুহাম্মদ: এগুলো আত্মঘাতী কথা। কারণ, মানজুর আল মতিন যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো সবাই শুনেছেন। সেগুলো খুবই যুক্তিযুক্ত ও তথ্যভিত্তিক কথা। তাকে যখন জামায়াত-শিবির ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে, তখন সরকারের যারা এই ট্যাগ দিচ্ছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তারা নৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে এই ট্যাগগুলো ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এটা আত্মঘাতী আত্মরক্ষার চেষ্টা। এতে করে তারা আরও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, গ্রহণযোগ্যতা আরও হারাচ্ছে।

ডেইলি স্টার: জীবনের দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করলেন; আন্দোলন-সংগ্রামেও আছেন। আজ আবু সাঈদকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সমকাল। সেখানে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ যখন পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন পুলিশের সঙ্গে ছিল বেরোবি প্রশাসন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মী, কয়েকজন শিক্ষক এবং তারাও পুলিশকে গুলি করতে বলেছে। সাঈদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ১০ কিলোমিটার দূরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে রিকশায় করে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার জন্য গাড়িও দেয়নি। ভিসির বাড়িতে হামলার অভিযোগে মামলা হয়েছে, কিন্তু সেখানে হত্যাকাণ্ডের কথা নেই। একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার নানা ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপস্থিতিতে একজন শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হলো—শিক্ষক হিসেবে এটাকে কীভাবে দেখেন?

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক হিসেবে এটা আমার জন্য খুবই লজ্জার। এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিশেষত গত এক দশকের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাখতে চায় না, ক্ষমতার একটা ভিত্তি হিসেবে তৈরি করতে চায়। এর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছে।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাস্তান ও মেরুদণ্ডহীনদের দাপটের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা ছিল সরকারের। সেটারই ফলাফল হলো এমন একটি নির্মম চেহারা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে এমন লোকদের বসানো হচ্ছে, যারা মেরুদণ্ডহীন, আত্মসম্মানবোধহীন এবং পুরোপুরি দাসের ভূমিকা পালন করে দুর্নীতি-নিপীড়নে সহযোগিতা করতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখছি, এই ধরনের লোকগুলোকে বাছাই করে প্রশাসনে বসানো হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ উঠুক কিছুই হয় না, বরং অভিযোগকারীর ওপর সরকার ক্ষুব্ধ হয় এবং অভিযুক্তদের রক্ষা করার চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীরনগর, বেগম রোকেয়াসহ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এর প্রমাণ দেখেছি।

একই সঙ্গে এই প্রশাসনের নেতৃত্বেই ওই ধরনের শিক্ষক নিয়োগ হয়, যারা তাদেরকে এমন ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। তাদের কর্তৃত্বে, তাদের ভূমিকায় হলগুলোতে ছাত্রলীগের আধিপত্য তৈরি হয়—যাতে কোনো শিক্ষার্থী কোনো কথা বলতে না পারে, কোনো ভিন্নমত তৈরি না হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাস্তান ও মেরুদণ্ডহীনদের দাপটের মধ্যে রাখার প্রচেষ্টা ছিল সরকারের। সেটারই ফলাফল হলো এমন একটি নির্মম চেহারা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনে আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে বাইরের মাস্তানরা এসে ভিসির বাসার ভেতরে আক্রমণ করেছে। ভিসি তখনো দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে আছে। এই পরিস্থিতিটা সরকারের তৈরি। সরকার কীভাবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, সকল প্রতিষ্ঠান নষ্ট করেছে তার নজির এটা।

ডেইলি স্টার: এর বাইরেও শিক্ষকদের আরেকটি চিত্র আছে—যদিও সেটা পরিসরে ছোট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ কলার ধরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, মুখ চেপে ধরছে, আটক করছে—সংখ্যায় কম হলেও কিছু শিক্ষক তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এসব ঘটনায় এসআই পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা শিক্ষকদের গায়েও হাত দিচ্ছেন। একটি ঘটনায় দেখলাম এক পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষককে বলছেন, আপনি রাজাকার, আর নিজেকে দাবি করছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের এমন আচরণকে কীভাবে দেখছেন?

আনু মুহাম্মদ: পুলিশ বাহিনীকে পুরোই দলীয় বাহিনী হিসেবে দাড় করানো হয়েছে। পুলিশকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি বাহিনী হিসেবে দাড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডারদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আমরা অনেকের নাম জানি, অনেকের বিষয়ে কথা হয়েছে, যারা আগে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী ছিল। রাজনৈতিকভাবেই এটাকে দাড় করানো হয়েছে যে পুলিশে উন্নতি করতে হলে, টিকে থাকতে হলে তাদের কী করতে হবে। বিশেষত, পদোন্নতি পেতে হলে তাকে মাস্তানি করতে হবে এবং দলীয় ক্যাডার হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে। আবার যারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে, তারা শাস্তি পাচ্ছে—এমন উদাহরণ তৈরি হয়েছে।

এভাবে পুরো পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যাদেরকে সামনে আনা হয়েছে, তাদের ট্রেনিংটাই এমন যে সরকারের ইঙ্গিত অনুযায়ী তারা কাজ করবে। যারা আন্দোলনে সহযোগিতা করছে—শিক্ষার্থী বা শিক্ষক—তাদেরকে রাজাকার ট্যাগ লাগানো, এটা সরকারের ভাষা। সেটাই পুলিশের মুখে শুনছি। পুলিশের মুখে সরকারের ভাষা আসার কথা না। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি—তারা তো রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তাদের কারো মুখেই সরকারের ভাষা আসার কথা না। কিন্তু এরা সরকারের দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের পতনের বড় ধরনের দৃষ্টান্ত।

ডেইলি স্টার: সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও এখন কেন আন্দোলন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় সরকার। বিষয় দুটিকে কীভাবে দেখছেন?

আনু মুহাম্মদ: প্রথম কথা হলো, কোটা সংস্কারের বিষয়টি সরকার যথাসময়ে সমাধান করেনি। যথাসময়ে সমাধান না করার কারণে এখন বিষয়টি আর কেবলমাত্র কোটা সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাদের একটি দাবি ছিল। সেটা পূরণ না করে সরকার আরও যে ভয়ংকর কাজগুলো করেছে, এখনকার প্রতিবাদ সেটার সূত্র ধরে।

তিন বছরের শিশু থেকে ৭০ বছর বয়সী পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিক ঘরের মধ্যে, বারান্দায়, ছাদে, বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্ত হলো, গুলিবিদ্ধ হলো এবং ইতিহাসের জঘণ্য মাত্রার নারকীয় ও নৃশংস নির্যাতন করলো সরকার। এর একটা বিচার হতে হবে না?

১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাগুলোতে তিন লাখের বেশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা আছে। এমন একটি ফ্যাসিবাদী নির্যাতন এবং রক্তাক্ত অধ্যায় তৈরি করলো সরকার। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এত মানুষের হত্যাকাণ্ড—এটা সারা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পৃথিবীতে তো আমরা অনেক স্বৈতন্ত্রবিরোধী লড়াইও দেখেছি। কিন্তু এমন ঘটনা খুব কম। এটার তো বিচার হতে হবে এবং এর দায় সরকারকে নিতে হবে।

এখন এই আন্দোলনে শুধু শিক্ষার্থীরা নেই—নিহত-আহত মানুষের পরিবারের সদস্যরা আছে; যেসব শিক্ষক দায় অনুভব করছেন তারা আছেন; অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিহত হয়েছেন, তারা আছেন; নারীরা আছেন; এটাতো এখন আর কোটা সংস্কারের আন্দোলন নেই এখন। এটা এখন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে। সবার দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশকে এমন একটি ফ্যাসিবাদী অবস্থানে রাখা যাবে না, গণতান্ত্রিক অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে।

আলোচনায় বসার বিষয়ে বলবো, এখন আলোচনার কী আছে? আলোচনার সময় ছিল ১৪ জুলাই। তখন বসলে, কোটা সংস্কার নিয়ে কথা বললেই ফয়সালা হয়ে যেতো। সরকার সেটা করেনি। তারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও বাজে ধরনের কথা বলেছে, হুমকি দিয়েছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগকে পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে, পুলিশকে পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। সবমিলিয়ে সবকিছু অন্য রকম করে ফেলেছে।

প্রথমত, জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় সরকারকেই নিতে হবে। এখনকার হত্যাকাণ্ডগুলোও জুলাইয়ে গণনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আজ জুলাইয়ের ৩৪ তারিখ। এই জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়ে এর সমাধানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এই সরকার নিজেরাই যেখানে দায়ী, সেখানে তারাই এর বিচার কীভাবে করবে, আমি তার রাস্তা দেখি না। হত্যাকারী নিজেই কীভাবে বিচার করবে? এখন এটা আর জাতীয় ইস্যুও নেই, আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কাজেই আন্দোলনকারীদের আটকে বা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এগুলোর সমাধান হবে না। এর জন্য বাংলাদেশের পুরো গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রশ্ন আসবে।

ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীদের দাবি এবং সরকারের অবস্থান—এর সমাধান কী? আরও হত্যাকাণ্ড, আরও নিপীড়ন?

আনু মুহাম্মদ: এখন এটা বন্ধ করতে হবে সরকারকে পদত্যাগ করে। কীভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে বাংলাদেশ যেতে পারে তার জন্য আন্দোলনকারীদের সম্মিলিত কণ্ঠ ও তাদের দাবি মানতে হবে। সরকারকে পদত্যাগ করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে যেতে হবে। এই হত্যার বিচার করতে হবে, আটক সবাইকে ছাড়তে হবে, কারফিউ তুলে নিতে হবে—সবমিলিয়ে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেই পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায়, সেটাই হতে হবে এখনকার আলোচনার বিষয়।