![অসাম্প্রদায়িক চেতনার পয়লা বৈশাখ](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2018%2F04%2F14%2F5785ae45a9b53fc41618b30ccf070a09-5ad1e7bbacebc.jpeg?rect=125%2C0%2C1350%2C900&auto=format%2Ccompress&fmt=webp)
পৃথিবীর প্রায় সব জাতি—বাঙালি কিংবা ইংরেজ, চীনা কিংবা জাপানি নববর্ষ উদ্যাপন করে থাকে। কোথাও নববর্ষ উদ্যাপিত হয় কনকনে শীতে, কোথাও–বা বসন্ত ঋতুতে। আর আমাদের এখানে বৈশাখের খরতাপে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই আনন্দ–উৎসবের কমতি নেই। ধর্ম-বর্ণ ভুলে শুধু মানুষ পরিচয়ে নববর্ষের উৎসবে প্রত্যেকে অংশ নেয়।
পয়লা বৈশাখ আমাদের এক অনন্য উৎসব। উদ্যাপনের রীতি-প্রকৃতি একে অনন্য ও সর্বজনীন করেছে। সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়। কারণ, নববর্ষ একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এ উৎসবের ধরনের সঙ্গে কোনো বিশেষ ধর্মের যোগ নেই। বরং লোকসংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে পয়লা বৈশাখের নিবিড় সংযোগ। দিন শেষে রাত, রাত শেষে দিন, ঋতুর পরিবর্তন, বছরের পরিবর্তন—এগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার। যা প্রতিটি প্রাণী তথা মানুষের জীবনপ্রবাহকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। নদী-সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষ, লতা–পাতা, ফুল-প্রকৃতিতে সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের সমান অধিকার। তাই পয়লা বৈশাখের উদ্যাপনটাও সর্বজনীন; আর এর রূপটা অসাম্প্রদায়িক। প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষ উদ্যাপনের এই রীতি চলে আসছে।
ঢাকায় রমনার বটমূলে সংগীতের মূর্ছনায় ১৯৬৭ সাল থেকে পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে শুরু করলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। পয়লা বৈশাখ আর সংগীত ছিল ছায়ানটের লড়াইয়ের হাতিয়ার। পাকিস্তানি শাসকেরা দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। সেই সময় শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছায়ানটের সেই অগ্রণী ভূমিকা এ দেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে রমনা বটমূলের বৈশাখ উৎসব ছড়িয়ে গেল চারদিকে। এখন প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, শাহবাগজুড়ে মানুষের ঢল নামে। ১৯৮৯ সাল থেকে চালু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা এতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, ষাঁড়, মহিষ প্রভৃতি লোকজ প্রতিকৃতি ও নানা রং ও বিভঙ্গের মুখোশ নিয়ে শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। এ ছাড়া ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, হাতিরঝিলসহ ঢাকার বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে থাকে উৎসবমুখর পরিবেশ। শহরজুড়ে কুমারের তৈরি মাটির খেলনা, নানা ধরনের কুটিরশিল্প, গৃহস্থালি তৈজসপত্র বিক্রি হয়।
তবে বাঙালির নববর্ষ উদ্যাপনের শুরুটা গ্রামীণ জনপদ থেকে। তাই এই উৎসবের মূল সুরটা লোকজ। আর চরিত্রটা পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন। ঐতিহাসিকভাবে গ্রামে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ মেলা। এসব মেলায় গ্রামের কুমারের তৈরি বাহারি খেলনার পাশাপাশি স্থানীয় কৃষিজাত ও শিল্পজাত পণ্য বিকিকিনি হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে বসে সার্কাস, জারি, সারি ও বাউলগানের আসর। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে গ্রামের কৃষক-দিনমজুর এসব মেলায় অংশ নেন।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় ঐতিহ্যগতভাবে সম্পর্কিত। এর কোনোটার প্রচলন এখনো রয়েছে, যেমন হালখাতা। আবার কোনোটা লুপ্ত হয়ে গেছে, যেমন পুণ্যাহ।
হালখাতা প্রধানত ব্যবসায়ী সমাজে প্রচলিত রয়েছে। পয়লা বৈশাখে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বাকি লেনদেনের নিষ্পত্তি হয়। ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ানো হয়। অনেকেই নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শুরুর দিন পয়লা বৈশাখ নির্ধারণ করে থাকেন।
একসময় দেশজুড়ে জমিদারিপ্রথা চালু ছিল। সেই সময় পয়লা বৈশাখে জমিদারকে প্রজারা খাজনা প্রদান করতেন। খাজনা প্রদান অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল পুণ্যাহ। জমিদারি প্রথা বিলোপ হয় গেলে পুণ্যহ প্রথারও বিলুপ্তি হয়। তবে এখনো পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয় সরকারি জমিজমার ইজারা প্রদান।
পয়লা বৈশাখ খররোদের সূচনা করে। ঝড় আসে। কালবৈশাখী। সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। তবু আমরা এই বৈশাখের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। কারণ, পয়লা বৈশাখ আমাদের শিকড়ের সন্ধান দেয়। সেই শিকড় হচ্ছে বটতলা-হাটতলা। তাতে বসে মেলা। যেখানে গ্রাম-শহর সর্বত্র ধর্ম–বর্ণের পরিচয় ভুলে মানুষ মিলিত হয়। আর আমাদের সমাজের জীবনতৃষ্ণা অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগরূক রাখে।