নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বেঈমানী করলেন হাসিনা!

দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বড় ধরনের বেঈমানী করলেন আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। যাদের শ্রম-ঘামে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাদেরকে বিপদের মুখে ফেলে রেখে গোপনে পালিয়ে গেছেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে গেছেন তার বোন শেখ রেহানাকে। তার ছেলে ও মেয়ে আগে থেকেই বিদেশে আছেন। শেখ রেহানার ছেলে-মেয়েরাও দেশের বাইরে থাকেন। তাই হাসিনা ও রেহানার পুরো পরিবার আপাতত বিপদমুক্ত। কিন্তু দেশে থাকা মন্ত্রী, এমপি ও দলের নেতাকর্মীরা এখন চরম বিপদের মুখে। তাদের বাড়িঘর হামলা করা হচ্ছে, ভাংচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে যেতে হচ্ছে নেতা-কর্মীদের।

তুমুল গণআন্দোলনের মুখে সোমবার দুপুরে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তীব্র জনরোষ থেকে বাঁচতে সেদিনই গোপনে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। হাসিনার ঘনিষ্ট আত্মীদের মধ্যে অনেকেই বিপদ টের পেয়ে তাঁর আগেই দেশ ছেড়ে যান। এদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর মামাত ভাই ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, চাচাত ভাই শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল।

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী, সাবেক অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকার থেকে নানারকম অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ীদের একাংশ দেশ ছেড়ে চলে যান।

কিন্তু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের একটি বড় অংশ এবং আওয়ামীলীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর আস্থা রেখেছিলেন। তার নির্দেশে এদের একটি অংশ সরকার পতনের আন্দোলন প্রতিহত করতে রোববার পর্যন্ত মাঠেও ছিলেন। তারা ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করেননি, যে শেখ হাসিনা এক সপ্তাহ আগেও দম্ভ করে বলেছিলেন, হাসিনা পালায় না; সে-ই তিনিই চোরের মতো গোপনে দেশ ছেড়ে যাবেন।

সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে যাওয়ার খবরে মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতাকর্মীদের মাথায়  হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তারা হতভম্ব ও হতচকিত হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বাসভবন ও প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন বিরাজ করছে তীব্র আতঙ্ক, ক্ষোভ ও হতাশা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হয়েও শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গে এমন বেঈমানী করতে পারেন, কোনোদিন কল্পনাতেও ভাবেননি তারা। তাদের অনেকে শেখ হাসিনাকে ধিক্কার দিচ্ছেন।

তারা মনে করেন, তারা বর্তমান নিরাপত্তাহীনতা নিয়েই শুধু আতঙ্কিত নন, ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন। আওয়ামীলীগ যেমন বিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা মামলা দিয়ে, পুলিশ দিয়ে দৌঁড়ের উপরে রেখেছিল, আগামীতে যে সরকার আসবে তারাও তেমনটি করতে পারেন। অকারণ হয়রানির মুখে পড়তে হবে তাদের। ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে।

তারা মনে করেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলেও যাওয়ায় পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে। তিনি দেশে থেকে যদি জেলেও যেতেন, তাহলে তাকে সামনে রেখে দল আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারতো। মামলা-মোকাদ্দমার ক্ষেত্রে দলীয় আইনজীবীদের সহায়তা পাওয়া যেতো। কিছুটা আশা থাকলে খারাপ পরিস্থিতেও লড়াই করার সাহস পাওয়া যায়। কিন্তু খোদ সভানেত্রী সবাইকে বিপদে ফেলে চলে যাওয়ায় তাদের বিশ্বাস ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গেছে। এই দলের পক্ষে আর সহজে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। তাদের সামনে আরও কোনো আশা নেই।

আওয়ামীলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, দল ও অঙ্গ সংগঠনের সব নেতা-কর্মী কিন্তু খারাপ নন। কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করেছে, বড় রকমের দুর্নীতি করেছে, অন্যদের উপর নিপীড়ন করেছেন। কিন্তু এখন সবাইকে এর মাশুল দিতে হবে। সবাই নিরাপত্তাহীনতা ভুগছি। বাড়িঘরে হামলা হচ্ছে, আগুন দেওয়া হচ্ছে। আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আগামীতে মিথ্যা মামলা, পুলিশি হামলার মতো ধাক্কা আসার আশংকা রয়েছে, তাতে সবার জীবন শেষ হয়ে যাবে। দলের সভানেত্রী দেশে থাকলে একটু সান্ত্বনা ও সাহস পেতাম। মনকে প্রবোধ দিতে পারতাম যে, সবাই মিলে কষ্ট করছি, খারাপ সময় মোকাবেলা করছি, আবার ভাল সময় আসবে। কিন্তু নেত্রী আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেলেন।

আরেকজন আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, আওয়ামীলীগ করার কারণে আজ আমি লজ্জিত, নিজের উপর ক্ষুদ্ধ। শেখ হাসিনা তার শেখ বংশের বাইরে অন্যদের নিয়ে তেমন ভাবেন না, যতটুকু করেন, তা লোক দেখানো-এটা আমাদের বুঝতে পারা উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে জেলে আটক ছিলেন। এ সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদ দক্ষ হাতে হাল না ধরলে দেশ স্বাধিন হতো না, বঙ্গবন্ধুকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না। কিন্তু শেখ হাসিনা কখনোই সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিনের অবদানের সঠিক মূল্যায়নে আগ্রহী ছিলেন না, পাছে যদি তারা শেখ মুজিবের সমকক্ষ হয়ে যান। তাছাড়া দল ও সরকারে তার পরিবারের সদস্য বিশেষ করে শেখ সেলিম, শেখ হেলাল, তাপসদের প্রতিপত্তি ছিল মন্ত্রী এবং দলের সিনিয়র নেতাদের চেয়েও বেশি। তাদের কারণে অনেক অন্যায্য কাজ করতে হতো। শেখ হাসিনা এটা জেনেও কিছু বলতেন না বা বাধা দিতেন না। এসব দেখে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। আমরা নিইনি। এখন মাশুল তো দিতেই হবে।

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.