By using this site, you agree to our Privacy Policy.

জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আওয়ামী লীগের দ্বিচারিতা

সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ উত্তাল হয়েছে। তঁাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে জনসাধারণ
সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ উত্তাল হয়েছে। তঁাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে জনসাধারণছবি : প্রথম আলো

ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রলয় বন্ধ থাকে না। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সরকার প্রথমে বুঝতে পারেনি কিংবা বুঝতে চায়নি। একচেটিয়া ক্ষমতার চর্চা করতে করতে ক্ষমতাসীন দল এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সেখানে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি কাজ করছে না। ফলে বেসামাল হয়ে দলের নেতারা উল্টাপাল্টা বলছেন।

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন গণবিদ্রোহে পরিণত হয়েছে। নানা পদ, পদক ও ইহজাগতিক সুবিধা পাওয়া মোসাহেবরা তাঁদের আখের নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় মরণকামড় দিচ্ছেন। লাঠিয়াল আর রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়েও বিদ্রোহ সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ঠিক এ সময় তাঁরা বের করলেন আরেকটা তাস। প্রথমে বললেন, সবকিছুর পেছনে বিএনপি-জামায়াত। তারপর বললেন, তারেক রহমানের নির্দেশে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। এখন খড়্গ উঠেছে জামায়াত-শিবিরের দিকে। বিএনপিকে তো নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা তাঁদের নেই। জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা সহজ। কারণ, দলটি নৈতিক বৈধতা হারিয়েছিল ১৯৭১ সালেই। 

জামায়াতের প্রতি আমার কোনো অনুরাগ-বিরাগ নেই। ইতিহাস বলে, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরোচিত গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধের সহযোগী হিসেবে তাদের ভূমিকা আমাদের জানা। আমরা একাত্তর দেখেছি। 

বাহাত্তর সালে এসব দলের লোকেরা অনেকে গ্রেপ্তার হয়। অনেকে পালিয়ে যায়। বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। তবে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটি সংবিধানে জায়গা পায়নি। তার বদলে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে আমরা পেলাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এর মানে হলো রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে বাড়তি সুবিধা দেবে না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। বেতার-টিভিতে আর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একসঙ্গে পবিত্র কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ চালু হলো। অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা হলো না। পরে আমরা দেখেছি, দেশের প্রধান দলগুলো প্রায় সবাই কমবেশি সাম্প্রদায়িকতা লালন করেছে। 

১৯৭৬ সালে এক সামরিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হলো। তারপর জন্ম নিল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী আবার চলে এল দৃশ্যপটে। আওয়ামী লীগ যে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে আসছিল, তা আর থাকল না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে গেল। আর কে না জানে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রূপটি বড়ই কুৎসিত। এখানে খিস্তিখেউড়, মিটিং ভাঙা, মারামারি, খুনোখুনি—সবই জায়েজ। যখন যে দল ক্ষমতায় গেছে, তখন সেই দল আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন চালাকি নেই, যা করেনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। 

১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা হাতে নিলেন। তিনি নির্বাচনের টোপ দিলেন। ১৯৮৩ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকার বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ চত্বরে এক জনসভায় জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান ‘কেয়ারটেকার সরকার’-এর অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। তার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলের জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলের জোট আর জামায়াত অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। শত্রু যখন ‘কমন’, তখন ‘রাজাকার’, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সব এক কাতারে। একাত্তরের স্মৃতি তাদের মাথায় আর নেই। কে আর ইতিহাস আঁকড়ে থাকতে চায়। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনই মুখ্য। 

১৯৮৬ সালে যখন সংসদ নির্বাচন হয়, তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। তার সঙ্গী হয় ১৫ দলের জোট থেকে বেরিয়ে আসা ৫টি বাম দল। আওয়ামী লীগ তার সমমনাদের নিয়ে এই নির্বাচনে যায়। সঙ্গী হয় জামায়াত। ওই নির্বাচনে জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক নিয়ে প্রথমবার নির্বাচন করে ১০টি আসন পায়। ফলে কী হয়? এরশাদের সামরিক শাসন বৈধ হয়। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বৈধতা পেয়ে যায় জামায়াত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের সদস্যরা এক ছাদের নিচে বসে আইন তৈরির ছাড়পত্র পান। তার পর থেকে তাঁরা একসঙ্গেই। 

১৯৮৮ সাল থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জোয়ার আসে। তখন সবাই মিলেঝুলে ‘যুগপৎ’ আন্দোলন করে। এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিচালনায় সংসদ নির্বাচন হয়। বিএনপির সঙ্গে একটা গোপন সমঝোতা করে জামায়াত সংসদে ১৮টি আসন পায়। বিএনপি সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। 

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মধুচন্দ্রিমা বেশি দিন টেকেনি। আওয়ামী লীগ বছরখানেকের মধ্যেই সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে দেয়। সঙ্গী হয় জামায়াত। আওয়ামী লীগের একটা হিসাব ছিল। তারা দেখল, বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে থাকলে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ ফকফকে। সুতরাং এই জোট ভাঙতে হবে। অন্যদিকে জামায়াত তার বৈধতা আরও পাকাপোক্ত করতে চাইল আওয়ামী লীগের সার্টিফিকেট। তাদের সঙ্গে জুটে গেল এরশাদের জাতীয় পার্টি। আন্দোলনে বিএনপি সরকার বাধ্য হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থাসংবলিত সংশোধন আনল সংবিধানে। ১৯৯৬ সালে হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন। 

দেশের মানুষ মনে করে, বিএনপি হলো মুসলমানের দল। আওয়ামী লীগও মুসলমানের দল হওয়ার জোর চেষ্টা চালাল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ধর্মের পোশাক ধরলেন। সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে শুরু করলেন নির্বাচনী প্রচার। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। জামায়াতের সুবিধা হলো না। বিএনপির ছাতা মাথার ওপর না থাকায় তাদের কপালে জুটল মাত্র তিনটি আসন। 

দুই বছর না যেতেই আবার সরকার পতনের আন্দোলন। এবার বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে। আরও দুটি দল নিয়ে তারা করল চারদলীয় জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ২০০১ সালে হলো নির্বচন। চারদলীয় জোট পেল বিরাট জয়। খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। মন্ত্রিসভায় জায়গা পেলেন জামায়াতের দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। 

জামায়াতে ইসলামী আছে ভারত ও পাকিস্তানে। উপমহাদেশে এই প্রথমবারের মতো জামায়াত একটি দেশে (বাংলাদেশে) সরকারের অংশীদার হতে পারল। এটা একটা রেকর্ড। স্বাধীনতাবিরোধী এই দল এত দূর আসতে পেরেছে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রশ্রয় ও আনুকূল্য পেয়ে। ক্ষমতার জন্য তো মানুষ শয়তানের সঙ্গেও আঁতাত করে। 

একটা বিষয় পরিষ্কার—জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বন্দ্ব অবৈরী। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব হলো বৈরী। জামায়াত যদি বিএনপির সঙ্গে যায়, তাহলে ক্ষমতার সমীকরণে আওয়ামী লীগের অসুবিধা অনেক। তারা একসঙ্গে না থাকলে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। বিএনপি-জামায়াত জোট ভাঙার চেষ্টা হয়েছে অনেক। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার ও চরম দণ্ড দেয়। তাতেও জামায়াতকে নমনীয় করা যায়নি। 

সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ উত্তাল হয়েছে। কোটা সংস্কারের আবরণে প্রকাশ ঘটেছে নির্যাতনের শিকার ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের। তাদের পিটিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। তাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে জনসাধারণ। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সুবিধাভোগী ছাড়া আর প্রায় সবাই ছাত্রদের পক্ষে। ক্রমে এটি রূপ নিয়েছে গণবিদ্রোহের। সরকার নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বিচার গুলি করে শিশু, নারীসহ অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মাঝরাতের আগে অল্প কয় দিনে এত মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার নজির নেই। 

আমাদের বুঝতে হবে, দেশ স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস ছাড়া আমরা কখনো সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। ১৯৭২ থেকেই দেশে চলছে এক ব্যক্তির শাসন। আমরা এখন অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক এ অবস্থা মেনে নিতে পারেন না। ব্যক্তি ও পরিবারের ক্ষমতার খায়েশ আর খামখেয়ালির জন্য পুরো জাতি কেন বারবার মূল্য দেবে? 

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চরম মুহূর্তে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করল। ছাত্রদের একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে জামায়াতের ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করার কৌশল নেয় সরকার। জামায়াত নিষিদ্ধ হয়েছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। কিন্তু সরকারের দ্বিচারিতা এখানে স্পষ্ট। স্বাধীনতাবিরোধিতার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করেনি। নিষিদ্ধ করেছে মানুষের নজর মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে ফেরাতে। নিজেদের দ্বারা পরিচালিত ‘গণহত্যা’ চাপা দিতে। এই উদ্দেশ্য না বোঝার কারণ নেই। মানুষ এত নির্বোধ নয়।


মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক