June / July 2015 • 49 না! এমনকী জানলাও খুলব না। কুমির অবধি চলে এসেছে। এর পর কে আসবে কে জানে! খুলব না! যেই আসুক, কিছুতেই দরজা খুলব না! কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই। পরদিন ভরদুপুরে ফের দরজায় ঠকঠক! ও প্রান্ত থেকে বিনীত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে---‘কেউ আছেন?’ ‘কেউ নেই।’ কড়া সুরে জবাব দিই---‘কে আপনি? শেয়াল? যা লেখার, যা বলার দেয়ালে লিখে যান। আমার সময় নেই।’ ‘আজ্ঞে, আমি শেয়াল নই।’ ‘তবে? ভালুক? তাহলে সামনের পুকুরে গিয়ে শামলা শালুক ভক্ষণ করুন। আমার বাড়িটা আপনার খাস তালুক নয়।’ বিনীত স্বর হেসে বলল---‘আজ্ঞে, আমি ভালুকও নই।’ ‘তাহলে নির্ঘাৎ হায়না! শুনুন মশাই, কোনও বায়না চলবে না। কেটে পড়ুন।’ ‘আমি হায়নাও নই। একজন মানুষ মাত্র।’ মানুষ! তবে আর ভয়ের কী আছে? এইবার লাফ মেরে উঠে দরজা খুলে দিই। বাইরে এক অনিন্দ্যসুন্দর মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রূপ দেখে গলবার পাত্রী নই আমি। বিল ক্লিন্টনও হেব্বি হ্যান্ডসাম ছিল। কিন্তু ভিতর ভিতর পাজির পাঝাড়া। ‘কী চাই?’ বেশ রোয়াব নিয়েই জিজ্ঞাসা করি। মানুষটা স্মিত হাসল। হাসিটা এত শুদ্ধ যে প্রাণ ঠান্ডা হয়ে যায়। লোকটা কোনও রকম ভনিতায় না গিয়ে বলল---‘ভোটপ্রার্থী। যদি আমাকে যোগ্য প্রার্থী বলে মনে করেন তবেই ভোট দেবেন।’ এ কী! এ তো ভোটপ্রার্থীদের জেনারেল ডায়লগ নয়! বিস্মিত হয়ে বলি--- ‘কোন দল? পিসো? না পিসি?’ সে ফের শান্ত হাসল---‘আমি দলে বিশ্বাসী নই। পিসো, পিসি, দাদা, কাকু ধরি না।’ বিস্ময়ের পারদ চড়ল। বলে কী লোকটা? ‘তবে কীসে বিশ্বাস করেন? রঙে?’ ‘নাহ্। আমার কোনও রং নেই। আমি রঙে বিশ্বাস করি না।’ ‘তবে কীসে বিশ্বাস করেন? ভগবানে?’ ‘নাহ্।’ তার শান্ত উত্তর---‘নিজেকে। আর নিজের কাজকে।’ ‘আপনি তো মানুষ! বলি, মান হুঁশ আছে?’ ‘দুটোই আছে।’ ‘মিথ্যে কথা!’ প্রতিবাদ করি---‘মান আর হুঁশ থাকলে কেউ ভোটে দাঁড়ায়?’ ‘আমার দুটোই আছে।’ লোকটা একটুও না রেগে শান্ত স্বরে বলল---‘আমি অপ্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলি না। বলিনি কখনও।’ বিস্ময়ের থার্মোমিটারে পারদ ক্রমাগতই চড়ছে! ‘আপনি ঘুষ খান?’ ‘নাহ্।’ ‘বোম বাঁধতে জানেন? বেঁধেছেন কখনও?’ ‘নাহ্।’ ‘মানুষ খুন করেছেন?’ ‘আজ্ঞে না। তবে মানুষকে বাঁচিয়েছি অনেকবার।’ ‘আপনার চাহিদা কী? ভোটে জিতলে কী চাইবেন? লিমুজিন? সাফারি? রোলস রয়েস?’ ‘আমার ও সব প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন খুব সামান্য।’ লোকটা হাসল---‘সেটা নিজেই মিটিয়ে নিতে পারি। আমি শুধু কাজ করতে চাই।’ টের পেলাম বিস্ময়ের থার্মোমিটারটা ফটাস করে ফেটে গেছে! আমার মাথা ঘুরছে। কানের ভেতরটা বোঁ বোঁ করছে। দাদা তবে ঠিকই বলেছিল…! আমি লাফ মেরে সরে গিয়ে অন্ধের মতো হাত-পা ছুড়লাম---‘এই যাঃ! হুশ হুশ! সব ঝুট হ্যায়… সব ঝুট হ্যায়…! তফাৎ যাও… তফাৎ যাও…!’ লোকটা অবাক। কিছু বোধহয় বলতে চাইছে। কিন্তু আমিও শুনতে পাচ্ছি না! অসম্ভব…! অসম্ভব…! প্রাণপণে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলাম---‘ওরে বাবা রে, মা রে, দাদা রে, এ আমার কী হল রে! বাঁ-চা-ও!’ আমার হাঁকডাক শুনে সকলেই ছুটে এল। দাদা তাড়াতাড়ি বলল---‘কী হয়েছে? কী হয়েছে রে? চেঁচাচ্ছিস কেন?’ ‘ওরে!’ আমি আকুলভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলি---‘দাদা রে-এ-এ! তুই ঠিকই বলেছিলি! আমার হ্যালুসিনেশনই হচ্ছে! নয়তো একটা মানুষ এসে বলে কিনা ভোটে দাঁড়িয়েছে।’ ‘তাতে কী?’ বাবা অবাক---‘বাঘ, সাপ যদি দাঁড়ায়, তবে মানুষ কী দোষ করেছে?’ আমি আরও জোরে মড়াকান্না কেঁদে উঠি---‘বাঘ, সাপ, কুমির সবাই ভোটে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু যার মান আর হুঁশ আছে, সে কী করে ভোটে দাঁড়ায়? তার ওপর বলে কিনা কোনও দল করে না, রঙে বিশ্বাস করে না, ভগবানে বিশ্বাস করে না, নিজেকে আর নিজের কাজকে বিশ্বাস করে! অ্যাঁ! এমন হয় নাকি! মিথ্যে কথা বলে না! ঘুষ খায় না! বোমা বাঁধে না! মানুষ খুন করেনি, বরং বাঁচিয়েছে! আর কোনও দাবি নেই, শুধু নিজের কাজ করতে চায়! এমন মানুষ ভোটে দাঁড়াতেই পারে না! অসম্ভব! অসম্ভব! হ্যালুসিনেশন! নির্ঘাৎ হ্যালুসিনেশন! ওরে দাদা রে, তুই সুবিমল, নির্মল, পরিমল, কমল---সব মলকে ডাক, সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক, সাইকোলজিস্ট ডাক! দরকার পড়লে রাঁচি থেকে গোটা অ্যাসাইলামটাই নিয়ে আয়। আমি ইলেকট্রিক শক খেতেও রাজি আছি! অসম্ভব! অসম্ভব! ওরে বাবা রে, এমন মানুষ কিছুতেই রাজনীতিতে আসতে পারে না! ভোটে দাঁড়াতে পারে না! হ্যালুসিনেশন! নির্ঘাৎ হ্যালুসিনেশন! আমার মাথা নির্ঘাৎ খারাপ হয়েছে রে-এ-এ-এ! ওরে বাবা! মানুষের মতো মানুষ কিনা ভোটে দাঁড়িয়েছে! অসম্ভব! হু-উ-শ! হু-উ-শ! তফাৎ যাও… সব ঝুট হ্যায়।’ কৃতজ্ঞতা---দিব্যদর্শন, অমিতাভ সমাজপতি অলংকরণে রৌণক পাত্র গদ্য সাহিত্যিক। সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে জিঙ্গলবেল, ভোর, ছায়াগ্রহ উল্লেখযোগ্য। পেয়েছেন মিত্র ও ঘোষ পুরস্কার, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় স্মৃতিপুরস্কার
মইরম জানে না ধর্ষণ কী সেলিনা হোসেন সিম যেদিন ওকে ঢেঁকিঘরে কাজটা করল তখনই ওর মনে হয়েছিল, মরণ! ভালোবাসার রেশ জেগে ওঠার আগেই ব্যাপারটি শেষ হয়ে যায়। ও তেমন করে কিছু উপভোগ করে না। বরং ওর ভেতরে ক্রোধ জন্মায়। শুধু বুঝতে পারে জসিম ওকে জোর করেছে। তা জোর তো ও করতেই পারে, জসিম যে ওকে ভালোবাসে, নিজেকে এভাবেই সান্ত্বনা দেয় ও। কিন্তু ভেবে পায় না ‘সান্ত্বনা’ শব্দটি কেন যে ওর মাথায় এল। কতদিন যায় শব্দটি ও আর মাথা থেকে তাড়াতে পারে না। জসিমকে ওর ভাবনার কথাটি জানালে জসিম বলে, আমি তো তরে ভালোবাসি, বাসি না মাইরি? মইরম মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেয়। মুখে কিছু বলে না। মুখে কিছু বলতে ওর ইচ্ছে হয় না। ভাবলে হাসি পায়। গা ঘিনঘিন করে। মনে হয় শরীরে কোনও লোমকূপ নেই, ওগুলো সব পোকা। ধুত, এটা কি ভালোবাসা! ভালোবাসা বোঝার আগেই ভালোবাসার ব্যাপারটি কেমন যেন হয়ে গেল। কী হয়ে গেল এর কোনও ব্যাখ্যা আর মইরম করতে পারে না। ফলে ওর মুখ ভরে থুতু জমে। সেই থুতু ও চারদিকে ছিটাতে ছিটাতে অনুভব করে ওর শরীর আর ওর নেই, ওটা জসিমের হয়ে গেছে। ওকে কেউ জসিম করে ডাকলে ও সহজে উত্তর দিয়ে দেবে। বলবে, ডাকেন ক্যান? আমি তো অহন চা বানাই। চায়ের লগে দুধ মিশাই। চিনি মিশাই। পরক্ষণে ও থরথর করে কেঁপে ওঠে। ভাবে, ওর শরীরটাও চা। জসিম ওকে চায়ের মতো একটু একটু করে খেয়েছে। জসিম যতক্ষণ খেয়েছিল, ততক্ষণ চায়ের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ওর শরীরটা যদি কাপ হয় তাহলে সেই কাপের তলানিতে জমেছিল…। ও বিস্ফারিত দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকায়। তারপর দু’হাতে মুখ ঢাকে। ওর ভীষণ কান্না পায়। খবরটা প্রথমে চাউর করে জসিম। গাঁয়ের বসতি এবং বাজারের মাঝামাঝি যে বিশাল বটগাছটা দিনরাত ডালপালা বিস্তার করছে তার মোটা শেকড়গুলোকে কেন্দ্র করে ও একটু চায়ের দোকান খুলেছে। বেশ কষ্ট হয়েছে দোকানটা গড়তে। ধারদেনা হয়েছে, এর-ওর সঙ্গে দেন-দরবার করতে হয়েছে, বিভিন্নজনের বাড়ি থেকে ভাঙাচোরা মোড়া বা চায়ের পাতিল, কাপ জোগাড় করতে হয়েছে। এমনকী দুটো পিঁড়িও কারও কারও কাছ থেকে নিয়েছে। নসরিন খালা তো তার দুটো কুপির একটি দিয়েছে। বলেছে, মাঝেমাঝে কুপিতে কেরোসিন ভরে দেবে। মানুষের ভালোবাসা পেয়ে ও ভীষণ খুশি। একদম নিঃস্ব অবস্থা থেকে যে জায়গাটি জমিয়ে তুলতে পেরেছে এটাই কে পারে! ইট দিয়ে চুলো বানিয়েছে। শুকনো কাঠে একটু কেরোসিন ঢেলে গুঁজে দিলে দাউদাউ জ্বলে চুলো। চা বানানো হয়। চারপাশে মোড়া আর জলচৌকি পাতা আছে। বসার ব্যবস্থা এটুকুই। তা ছাড়া বটের শেকড়বাকড়গুলোয় বসতে বেশি পছন্দ করে জোয়ান ছেলেরা। ওরা অনায়াসে চিত হয়ে শুয়ে পড়তে পারে। ওদের পিঠে ব্যথা লাগে না, যেন শেকড়গুলো ওদের পিঠের নীচে সমতল তক্তা। কেউ কেউ উপুড় হয়ে গালে হাত দিয়েও সময় কাটায়। আর একদম দিনমজুর যারা ওরা আশপাশে ছোটগল্প 50 • June / July 2015 জ
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইটের ওপর বসে পা মেলে দেয়। লুঙ্গির কোচড়ে মুড়ি নিয়ে খেতে ভালোবাসে ওরা। গাঁইয়ের লোকে জসিমের বুদ্ধির প্রশংসা করে। বলে, পোলাডা কইরা খাইতে শিখছে। অন্য একজন বলে, বোধহয় জাউরা পোলা হইব। হের লাইগা এত বুদ্ধি। অন্যজন, ঠিকই কইছো। জাউরা না অইলে বাপ-মায়ের ঠিকানা নাই ক্যান? বাজারে ঘুইরা খুদকুঁড়া খায়। হা-হা করে হাসে একদল মানুষ। জসিম এ সব কথা শ�োনে, কিন্তু গায়ে মাখে না। ও নিজেও জানে না বাপ-মায়ের কথা। কবে এতিম হয়েছে এমন কথা কেউ ওকে বলে না। কবে মারা গেছে তাও জানে না। এ সব নিয়ে ও আর মাথা ঘামায় না। বেঁচে আছে এটাই তো সবচেয়ে বড় আনন্দ। সেদিন জসিম যখন খবরটা বলে তখন দশ-বারোজন মানুষ চায়ের কাপ হাতে নিয়েছে মাত্র। তখন বিকেলের রোদ বটের পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে বেড়াহীন চা-ঘরের ভেতরে গলতে শুরু করেছে। কারও কারও মুখের ওপর রোদের ছায়া নেতিয়েছে, বেশ দেখাচ্ছে ওদের। রোদ ওদের ক্লান্তি ঘুচিয়ে সতেজ করেছে। রোদের চৌকো ছায়া মাটিতেও গড়াচ্ছে। যেন কোনও কিশ�োরী আলতো হাতে আলপনা এঁকেছে বটের মূলে। জসিমের দাড়িগোঁফহীন মুখে রোদ লাগেনি। বটের একটি ঝাঁকড়া ডাল ওর মুখটা রোদ থেকে আড়াল করে রেখেছে। ওর চ্যাপ্টা-থ্যাবড়া মুখটার জন্য বটগাছের আলাদা মায়া আছে বলে মনে হয়। জসিম একে একে সবার মুখের দিকে তাকায়। তারপর দৃষ্টিটা সামনে ঝুলে থাকা বটগাছের কচি পাতার ওপর নিবদ্ধ করে বলে, সত্তর বছরের নূরালি হাওলাদার সতেরো বছরের মইরমরে গর্ভবতী কইরেছে। উপস্থিত সকলে প্রথমে হকচকিয়ে যায়। ওদের হাতে ধরা চায়ের কাপ ঠোঁট পর্যন্ত ওঠে না। যারা খানিকটুকু উঠিয়েছিল তারা সেটা আবার নীচে নামিয়ে আনে। তারপর কেউ একজন খ্যাঁক করে হাসে। যেন এমন একটি হাসি হাসবে বলে সে জন্মের পর থেকে অপেক্ষা করে ছিল। সবার দৃষ্টি তার ওপর গিয়ে পড়ে। সবাই অনুভব করে লোকটির চেহারায় শয়তানের হাসি ফুটে উঠেছে। ও গাঁয়ের হামেদ মোল্লা। হাটে দালালি করে। গরুর দালাল। হেসে ওঠার পরে হামেদ মোল্লা মুখটি অন্যদিকে ঘোরায়, যেন নিজেকে এ ভাবে আড়াল করলে হাসির কোনও কারণ ওকে দেখাতে হবে না। কিন্তু কেউ ওর দিকে তাকায় না। ওকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু আছে বলে মনে করে না। সকলেই বুঝে যায় যে কোনও কোনও মানুষ বিকৃত আনন্দ পেতে ভালোবাসে। হামেদ মোল্লা খবরটাকে নিজের ভেতর উপভোগ করছে। তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে যে বয়স্ক সে মুখ বাঁকিয়ে বলে, তুই খবরটা পাইছস কোনহান থাইক্যা জসিম্যা? জসিমের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। ও নিজেকে আড়াল করে রেখেই বলে, আমি জানতি পারি। জানার কত পথঘাট আছে। ওর ঠোঁট ওলটানোর ভঙ্গি, হাত নাড়া, চোখের পলক ফেলা ইত্যাদি অনেক কিছুর মধ্যে রহস্যের অনেক কিছু গাঢ় হয় বলে কেউ ওকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করে না। তবে ওর জ্যাঠামিতে বয়স্করা বিরক্ত হয়। বিরক্তি কাটানোর জন্য সবাই একসঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। জসিম জোরে হাসতে হাসতে বলে, গিয়া দ্যাহেন মইরম অহন বমি করতাছে। কিছু খাইবার পারতাছে না। ওর মা অহন মাইয়ারে লইয়া দিশেহারা। একলা মাইয়ামানুষ কত কিছু যে একলা সামলাইতাছে। আহারে! একজন রাগত স্বরে বলে, মইরম কি তোর মাগ যে তুই সব খবর একলাই পাইতাছস? গাঁয়ের মানুষ আর কেউ কিছু জানে না। ছ্যামড়াটা বেশি ফাজিল। জসিম আর কথা বাড়ায় না। বুঝে যায় যে কথা বাড়ালে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবে। নিজেকে আড়াল করার জন্য বিদ্রূপের খ্যাঁকখ্যাঁক হাসিতে ভরিয়ে তোলে চায়ের আসর। যেন হাসির ওপর রোদের ছিনাল স্পর্শ লেগেছে, তাই হাসি তরঙ্গ মতো দুলছে। এই মুহূর্তে হাসি জীবিত কোনও প্রাণী কিংবা একটি বস্তু যার ভৌতিক অবয়ব ছমছম করে বটগাছের তলায়। কেউ কেউ বিষন্ন হয়ে জায়গা ছেড়ে চলে যায়। কারণ তারা খুব কাছ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা দেখছে মা-মেয়ের। শুধু যুবকেরা গাছের শেকড়ে হেলান দিয়ে জসিমকে বলে, আমরা জানি তোর সাথে মইরমের পিরিত আছে। তয় মাইডাটা বোকা। মাথাডা খোলসা না। জসিম চায়ের কাপগুলো বালতির পানিতে ডোবাতে ডোবাতে বলে, মিছা কতা না। ঠিকই বলতাছো তোমরা। মাইয়াডা একডা মাল। আবার সেই খ্যাঁকখ্যাঁক হাসি। তবে এবার সেই হাসির সঙ্গে খানিকটুকু পরিতৃপ্তি যুক্ত হয়। এবার কুরবানের তীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা, তাইলে বুড়াডা মইরমরে পায় ক্যামনে? তুই কি ছাগল! সবই ঈশ্বরের লীলা। জসিম নির্বিকার উত্তর দেয়। ভঙ্গিতে আবার সেই রহস্যের প্রলেপ। ছেলেরা ওকে এমন অচেনা হয়ে উঠতে কখনও দেখেনি। যে ছেলে জীবনে কোনওদিন স্কুলে যায়নি তার আচরণ একজন শিক্ষিত মানুষের মতো বলে ওরা নিজেদের বিপন্ন বোধ করে। জসিমের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে, যুবকরা অবাক হয়। তারপর ওরা আবার বলে, মইরমের সাতে কতদিন ধইরা ভাবসাব চালাইতাছস? মাস চারেক হইতে পারে। তাইলে তো হিসাব মিলা যায়। এবার যুবকেরা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে, শিস দেয়। জসিমের মুখের ওপরে শেষ বিকেলের আলোর ছায়া। পাতার ফাঁক-ফোকরে দিনের আলো বরফি কাটে। আহারে কী সুন্দর এই গেরামটা! সবার ভাবনার ভেতরে বিষন্নতা ঘনিয়ে ওঠে। বিষন্নতা জীবনের অন্য নাম হয়ে ওদেরকে নিজের শরীরের মুখোমুখি করে। এই মুহূর্তে শরীরের তাগিদ রহস্যের অতীত অন্য কিছু। জসিম চায়ের দোকান গোটাতে থাকে। দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। তারপরও সেই ঝিমধরা আলোতে জসিমের দু’চোখ জ্বলে উঠতে দেখে ওরা। যেন চোখজোড়া কোনও বাতিঘর বুঝি। কাউকে আলো দেখাচ্ছে। যুবকেরা একসঙ্গে ওকে মনে মনে গালি দেয়, জাউরা। একজন মরিয়া হয়ে বলে, তুই মইরমরে বিয়া করবি না? করুম। করুম না কেন? মইরমরে ছাড়া তো আর কাউরে বিয়াই করতে পারুম না। যুবকেরা ওর উত্তর শুনে ভিরমি খায়। বটতলায় অন্ধকার নেমে এলে জসিম কেরোসিনের কুপি জ্বালায়। দমকা বাতাসে কুপিটা নিভে যায়। ও আবার সেটা জ্বালিয়ে সুপুরির খোল দিয়ে বানানো ঘেরাটোপের ভেতর বসিয়ে দেয়। কুপিটা জ্বলে ঠিকই, কিন্তু তেমন আলো হয় না। অন্ধকার মিশে থাকে ওদের চোখে। নবীন বলে, কাইল বিষ্টি হইতে পারে। তোর চুলা জ্বলবে বইলে মনে হয় না। খাবি কী? জসিম হাসতে হাসতে বলে, পানি খামু। ছোটবেলা থাইকা আমার পানি খাঅনের অভ্যাস আছে। না খাইয়া থাঅনেরও অভ্যাস আছে। কোনও কিছুতে আমি ঠেহি না। নবীন আবার জোর দিয়ে বলে, মইরমের মা আর মইরমের ঢেঁকিঘরে পানি June / July 2015 • 51 ছোটগল্প
ঢুকতে পারে। চাল ফুডা। ছনের চালে আকাল লাগছে। বুঝছস ঘরের ভালো চালের আকাল। আবার হাসিতে চারদিক ভাসিয়ে দেয় জসিম। বলে, ফুডা চালের ঘরে জ্যোৎস্না দাপায়। খেলা জমে। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা। আমি জ্যোৎস্নার আলোর পরি ধরতে পারি। তোরা তো খেলতে পারস না। খেলা শিখতে হইলে মাঠঘাটের মানুষ অইতে হয়। শালা! যুবকেরা দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গালি দেয়। ওদের দাঁতের নীচে ঈর্ষা কিড়মিড় করে। ওরা বুঝতে পারে যে এই বয়সেই জসিম সতেরো বছরের মইরমের দখল পেয়েছে। দখলের বেড়িটা লোহার চেয়েও কঠিন। জসিম নিজের হাতেও বেড়ি বানাতে পারে। ছেলেটা নিঃসন্দেহে ঘাগু। ওরা চায়ের আসর ছেড়ে উঠে পড়ে। জসিম চটের বস্তায় দোকানের হাঁড়িকুড়ি ঢুকিয়ে নেয়। অন্য ছেলেরা যে যার পথে চলে গেছে। ও পিঠের ওপর বস্তা ফেলে মইরমের মা সকিনার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন সন্ধ্যা উতরেছে। ঘোর অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ নেই। মানুষের অভ্যাস হয়ে গেছে। অন্ধকার চোখে সওয়া। পথঘাট চিনতে অসুবিধা হয় না। জসিমের তো নয়ই। অন্ধকারে ওর দুটো চোখ দশটা হয়ে যায়। জীবনের প্রতি জসিমের কোনও বিতৃষ্ণা নেই। অভিযোগও না। ও মৃদু স্বরে ঘরের দরজায় টোকা দেয়। তখন মা-মেয়ে ধান কুটছিল। স্বামী বেঁচে থাকতে সকিনা নিজের ঘরে এই ঢেঁকি পেতে ধান কোটার ব্যবস্থা করে। এখন এটাই জীবিকার একমাত্র পথ। যা আয় হয় তা দিয়ে দু’জনের কোনওরকমে দিন কেটে যায়। জসিম দু’বার টোকা দেওয়ার পর সকিনা দরজা খোলে। ও নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ঢোকে। পিঠের বস্তাটা এক কোণে নামিয়ে রাখে। কোনও ভূমিকা না করেই বলে, সারা গাঁ জানে মইরমের গর্ভে নূরালি হাওলাদারের সন্তান। ঢেঁকির পাশে বসে থাকা মইরম কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ক্যাঁক করে ওঠে। কথা বলার ভূমিকার শব্দ মাত্র। সকিনা সঙ্গে সঙ্গে ওকে তর্জনী তুলে শাসায়। কড়া কথা বলে, চুপ। ধান ভানা শেষ কর। ধান ভানলে চাল হবে। কুঁড়া হবে। চাল গিলবে নূরালি। কুঁড়া গিলবি তুই। আর জসিম কী গিলবে? মইরমের প্রশ্নে কোনও সরলতা যে নেই সেটা সকিনা এবং জসিম দু’জনেই বোঝে। সকিনা ওর প্রশ্নের উত্তরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে, জসিম গিলবে ধান আর কুঁড়া সব। আপনে কী গিলবেন আম্মা? আমার দুইন্যা আরও বড়। সেইখানে আমার মাইয়া আছে, মাইয়ার জমি আছে, ঘরের ভিটি, চুলা, খড়ি, ঘরের পেছনের কলাগাছ, কবুতর…। হইছে, হইছে থামেন। আপনে অনেক বড় গিলনদার। গিলনের শখ আছে, মুরোদ নাই। হি হি করে হাসে মা-মেয়ে। হাসে জসিম। যে এদের পরিবারের সঙ্গে মিশে নিজের জীবনে পরিবারের ধারণা গড়ে তুলতে চায়। সকিনা চাল ঝেড়ে কুলার মাথা থেকে কুঁড়া উড়িয়ে দেয় ঘরের ভেতর। এ যে কেমন খেলা তিনজনের কেউই তা বুঝতে পারে না। সবচেয়ে কম বোঝে মইরম। যদিও এই মুহূর্তে পৃথিবী ওকেই কেন্দ্র করে ঘুরছে। জসিম ওর নিজস্ব ঢঙের খ্যাঁকখ্যাঁক হাসি হাসতে হাসতে বলে, মইরম বাইরে আয়। পারুম না। ক্যান? ক্যান আবার, ইচ্ছা নাই। ভালা লাগে না। তাইলে থাক। যাই গা। খিদা লাগছে। কেমুন খিদা? হি হি করে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে মইরম। ওর হাসি জসিমের শরীরে জ্বালা ধরায় না। হাসির আনন্দ উপভোগ করে। মইরম যে ওকে কখন কীভাবে আনন্দ দেয় সেটা মইরম জানে না। জানে জসিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ও একটুক্ষণ দাঁড়ায়, সকিনা যদি ওকে কিছু বলে এই আশায়। কিন্তু সকিনা কথা না বলে কাজ করতে থাকে। ও বুঝে যায় আজ আর সুবিধা হবে না। ও বেরিয়ে আসে। আবার অন্ধকারে নামা। অন্ধকারেই ওর পথ চেনা সহজ। জসিম গাছগাছালির আড়ালে মিলিয়ে যায়। খোলা দরজায় বাতাস ঢোকে। সকিনা দরজা বন্ধ করে দেয়। ও জানে জসিমের থাকার জায়গা নেই। বাজারে এর-ওর দোকানে ঘুমায়। সকিনার ঠোঁটের কোণে শিকারির হাসি। এমন একটি ছেলের জন্য ও জাল ফেলেছে। মাছটা ধরতে পারবে এমন একটি বিশ্বাস ওর হয়ে গেছে। ও এখন নিশ্চিত। স্বপ্ন দেখতে দেখতে হেঁটে যায় জসিম। ও সকিনার ঢেঁকিঘরের ঢেঁকির ওপর বসে মইরমকে বলেছে, আমাদের সংসারের লাইগা মাটি চাই। আমরা মাটির মানুষ। ক্ষ্যাত আর আবাদে মাটি কামড়ে থাকতে চাই। আমাদের নিজের ভূমি থাকবে না ক্যানে? আমারে দিয়া ভূমি কামাইতে চাও? মইরম খেঁকিয়ে ওঠে। যার যা ক্ষ্যামতা তার সেইটে করা উচিত। আমারে উচিত শিখাইও না। বেশি কিছু শিখতে আমার ভালা লাগে না। মইরম একমুঠি কুঁড়া হাতে উঠিয়ে নেয়। খবরদার কুঁড়া ছিটাবি না। সকিনা ধমক দেয় মইরমকে। আরও বলে, কুঁড়া বেইচে পয়সা আনতি হবে। ত্যাল-নুন কিনতি হবে। আমি ডিমভাজা খাব। পান্তার পানিতে ডুবায়ে রাখব ডিমভাজা। দিমু। তোরে আমরা ডিম কিনা দিমু। জসিম পাছা টেনে মইরমের কাছে গিয়ে বসে। সকিনা কুঁড়া-ভর্তি টুকরিটা উঠিয়ে নিয়ে বলে, জাবালের মায়ের ধারে কুঁড়া বেইচা আসি। বুড়ির মেলা হাঁস। দুইডা ডিমও কিনতে পারুম তার কাছ থাইকা। 52 • June / July 2015 যার কেউ নেই তেমন একটি ছেলেকেই জামাই করে নেওয়ার ইচ্ছা ওর। তাহলে সবাই মিলে একটি সংসার গুছিয়ে নিতে পারে। স্বামী মরে যাওয়ার পরে সংসারটি ভেঙেছে। মেয়ের ঘর হলেই তো সংসারের পালে বাতাস লাগে। আর একটি সংসার গুছিয়ে নেওয়ার বড় সাধ সকিনার। এ জন্য ঘর দরকার, জমি দরকার। আরও অনেক কিছু চাই। স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে। বুকের ভেতর স্বপ্ন থাকলে দিন ভালো কাটে।
সকিনা বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে মইরমের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জসিম। বলে, তুই রাজি হইয়া যা মইরম। ওই বুইড়াটার সাথে? বুইড়াটা তোরে ঘর তোলার জমি দেবে। জমিটুকু পাইলে আমাদের সংসারে কাকটা ডিম পাড়বে। ওই বুইড়াটার সাথে? আমার পত্থম কাম… না, পত্থম না। পত্থম তুই আর আমি। অহনই… তারপর উন্মাতাল সময়ে হাজার হাজার কাক ডাকে ঢেঁকিঘরে। যেন এটা বজ্রপাতে আলোকিত কোনও মুহূর্ত নয়। অন্ধকার নিঃশব্দে তাড়িত সন্ত্রাসীদের পদচারণায় কণ্টকিত ন্যায়… অন্ধকার প্রস্ফুটিত কুসুম। করবীর রক্তাভ বর্ণচ্ছটায় ফুটে উঠেছে ধ্যানী প্রমথেশ। তার কম্বুকণ্ঠে উচ্চারিত হয়, মৃত্তিকা খোলো দরজা। মৃত্তিকা দরজা খোলে। মৃত্তিকার এখন গ্রহণের সময়। মৃত্তিকা তৈরি। পথের দু’পাশে দণ্ডায়মান শিশুদের কলহাস্য বিপুল বেগে সমতলের দিকে ধাবিত। ওদের কেউ পৃথিবী দর্শনের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। মৃত্তিকার ধমনীতে তারই আগমনী বার্তা। তখন ধড়মড় করে উঠে বসে কাপড় ঠিক করে মইরম। প্রবল বিরক্তি ওর শরীরকে সংকুচিত করতে থাকে। কোনও কিছু বোঝার আগেই পুরুষের শরীর গায়ের ওপর চেপে যায়। এই অনুভবে ওর প্রবল বিতৃষ্ণা জাগে। জসিম ওর হাতটা ধরে কাছে টানার চেষ্টা করে বলে, দূরে গেলা ক্যান? এইখানে আসো। না। মইরমের কণ্ঠের তিক্ত ঝাঁঝ জসিমের কানে বাজে। তারপরও মোলায়েম কণ্ঠে বলে, তোমার ভালা লাগে না মইরি? মইরম মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, মরণ! ভাবনার এই মুহূর্তে কাঠ হয়ে যায় জসিমের শরীর। মইরমের এই তিক্ততা ওকে খুশি করেনি। নিজের ব্যর্থতা নয়, আনন্দের উপভোগ নয়, শুধু মইরমের ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গি ওকে ম্রিয়মাণ করে। ভাবনার এই মুহূর্তে ও মেঠোপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজের ভেতরে মইরমের তিক্ততার ক্রোধ সত্ত্বেও ওর এই প্রথম ভালো লাগা নিজের ভেতরে লালন করে নিজের শারীরিক কম্পন অনুভব করে। কতক্ষণ যে ও শিহরিত হয়, ও নিজেও জানে না। সেদিন একটু পরে মইরম প্রশ্ন করেছিল, তোমার লগে যে কামডা অইল, তা কি ঠিক অইল? আমরা তো বিয়া করি নাই। জসিমের স্বতস্ফূর্ত উত্তর, বিয়া করি নাই তো কী হইছে! আমরা তো বিয়া করমু। ও আচ্ছা। তাইলে ঠিকই আছে। কিন্তু শ্যাষ পর্যন্ত যদি বিয়া না হয়? মইরমের প্রশ্নের উত্তর জসিমের জানা। কিন্তু ও মুখ ফুটে মইরমকে বলতে পারে না যে, তাহলে এটা ধর্ষণ হবে। ও শুধু মইরমের পুরুষ্ট শরীরটা দেখেছিল। ওর শরীরের অভাবের ছায়া নেই। ও কেমন করে একটা তরতাজা মেয়ে হল? সেজন্যই তো বুড়া নূরালি ওর কাছে একটি পুত্রসন্তান চায়। মইরমের হাত ধরে একদিন খাড়া দুপুরবেলা এমন প্রস্তাবটা তো বুড়া দিয়েছিল। বলেছিল, আমারে পোলা দিবি, আমি তোরে ভিটের জন্য জমি দেব। মইরম সেদিন বুড়োর হাত চাপ দিয়ে ধরে বলেছিল, জাউরা পোলা দিয়া কী কইরবেন? বুড়ো খেঁকিয়ে বলেছিল, পোলা অইল ধন। পোলা বংশ। মাইয়া অইলে জাউরা হয়। মাইনসে বিয়া করতে চায় না। পোলা অইলে কোনও জ্বালা নাই। পোলা মাথার মুকুট। বুড়োর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে জ্বলে উঠেছিল মইরমের দু’চোখ। বুড়ো সে দৃষ্টি হজম করে বলেছিল, পোলা অইলে ঘরে ফেরেশতা আহে। থুঃ, এই পোলার লাইগা মাইয়া মানুষের পা ধরন লাগে! আচ্ছা দিমু আপনারে পোলা। বংশের বাত্তি। খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়া মইরম হাসির রেশ কাটাতে পারে না। ওর কাছ থেকে এমন একটা আজব কথা শ�োনে জসিম আর সকিনা। জসিম স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মা আর জসিমের সঙ্গে গল্প করতে করতে মইরম সতর্কভাবে ঢেঁকির ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। বলে, পানি খামু। জসিম কলসি থেকে পানি ঢেলে আনে। ওর পায়ের কাছে বসে গণ্ঢাসটা ওর দিকে এগিয়ে দেয়। মইরমের পানি খাওয়া হলে বলে, বুড়াটা আটকুঁড়া। নইলে চারডা বউয়ের সন্তান হয় না ক্যান? সকিনা চুলোয় ভাত চাপাতে বেরিয়ে যায়। আজ ও ভীষণ খুশি। আজ প্রথমে মেয়েটাকে থালাভর্তি ভাত দেবে। তারপরে জসিম পাবে। সকিনা বুঝে গেল জসিম একটা পোলা হলেও এই মুহূর্তে মইরমের ক্ষমতাই অনেক বেশি। সকিনার চুলোয় দাউদাউ আগুন জ্বলে। মইরম জসিমের কাছ থেকে খানিকটুকু দূরে সরে গিয়ে বলে, ওই বুড়াটার সাথে? কী হইবে? তুই বুইঝা গেলি না যে কী হয়? কিছু হবি না। কিছু হবি না কেড়া কইল? আমার ঘিন্না হয়। মইরমের দৃষ্টি ঝলসে ওঠে। ভাইবা দ্যাখ মইরি আমরা মাটি পামু। ঘর পামু। ভাইবা দ্যাখ পরের বাড়ির ঢেঁকিঘরে থাকা লাগব না। তুই রাজি? মইরম কথা বলে না। জসিমের চুলের মধ্যে দু’হাত ঢুকিয়ে টেনে ধরে বলে, ব্যতা লাগে? জসিম ওর হাত সরিয়ে নেয়। মাথা ঘুরিয়ে ওকে দেখে। মনে হয় মইরমের শরীরে বজ্রপাতের শব্দ। জসিমের মাথার ওপর সেটা কড়কড় শব্দে পড়ে। তখন আকস্মিকভাবে মইরম জিজ্ঞেস করে, আমাগো বিয়া কবে? তুই যেইদিন কইবি হেইদিন। হাঁছা? মিছা কও না তো? এক্কেবারে হাঁছা। মাইয়াগো কতায় বিয়া অয়? তাইলে মাইয়াগো এত দাম? আবার প্রাণ খুলে হাসতে থাকে মইরম। জসিম হাসতে পারে না। শক্ত হয়ে যায় বুকের পাটাতন। ও বুঝে যায় মইরমের কেন এত দাম। নূরালি হাওলাদার মইরমের কাছে ছেলে চায়। আর ও নিজে মইরমের কাছে জমি চায়। যে জমি ওকে নূরালি দেবে বলে কথা দিয়েছে। জসিমের বিশ্বাস নূরালি কথা রাখবে। আর ওর সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার আগে জমিটা লিখিয়ে নিতে পারলে আর পায় কে। নূরালি গাঁয়ের ধনী কৃষক। কিন্তু বাপ হতে না পারার দুঃখ বয়ে বেড়ায়। নূরালি মইরমের হাত ধরে বলেছিল, আমি তোরে ভালোবাসি মইরম। তোরে আমি সতীনের ঘরে নিমু না। আলাদা দাম দিমু। মইরম দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে, বুড়া শিয়াল। June / July 2015 • 53
আমি বুড়া হই নাই রে মইরম। না, বুড়া হন নাই। লোকে কয় সত্তর বছর বয়স হয়েছে আপনের। তোমারে আমি জমি দিমু। তুমি আমারে পোলা দিবা। মইরমের ঘোর কাটে না। বিপুল বিস্ময় ওর সামনে গোলাকার বৃত্ত তৈরি করে। সেই বৃত্তটি ফুটো হয়ে যায় বিশাল এক লাঠির গুঁতোয়। মইরম নিজের ভেতর কোনও ভাবান্তর অনুভব করে না। কিন্তু নূরালির এমন কথা শুনে সকিনা আর জসিম যখন ওকে প্ররোচিত করে তখন খেলাটা ও বেশ উপভোগ করে। বুঝতে পারে ও আর এখন ষোলো বছরের কিশ�োরী নয়। মনের বয়স বেড়ে গেছে। ওকে ঘিরে যা হচ্ছে ওটাকে ও পাঁচ ভূতের কাণ্ড ভাবে না। ঘটনাটা বেশ সাজানো। এখন ঘটনাকে নিজের পক্ষে নিতে হবে। মইরম সতেরো বছরের ভাবনা থেকে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে যায়। বেশ তো জীবন! হেসে-খেলেই বইছে। মইরম যখন তখন হা হা করে হাসতে পারে। যে কারও মুখের ওপর দিয়ে সে হাসি উড়িয়ে দেয়। ষোড়শী মইরম নারী হতে ভীষণ ভালোবাসে। নূরালি ওকে নারীর মর্যাদা দিয়ে ছেলে চেয়েছে। ও নূরালির কাছে যাবে জমি নিতে। মাটি চাই। মাটি ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে? ঘরে-বাজারে পথে হাঁটতে হাঁটতে জসিমের কাছে বলা মইরমের স্বপ্ন শেষ হয় না। অন্ধকারে ও দ্রুত হাঁটতে পারে না। ও দ্রুত পৌঁছে যেতে চায় বাজারে। নকুলের দোকানে ভাত রাখা থাকে ওর জন্য। খিদেও পেয়েছে। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে প্রতি পদে হোঁচট খাচ্ছে। ও আবার ফিরে আসে মইরমের সঙ্গে। যেন মইরম ওকে বলছে, জানো না মইরম মানে ফুল। কেমুন ফুল? গন্ধ আছে? গন্ধ নাই। হুগনা ফুল। মেলা দিন ঘরে থাহে। কারও সন্তান প্রসবের সময় ব্যতা উঠলে ওই ফুল পানিতে ভিজায়ে রাখতে হয়। ফুল যদি পানিতে তাজা হইয়া ওঠে তাহলে সন্তান পস্সবে কষ্ট অয় না। আর যদি তাজা না অয় তাইলে মা মইরা যায়। এমুন কতা তোরে কে কইল? রমিজন বুয়া। রমিজন বুয়া মেলা কতা জানে। যহন কতা কয় তহন মনে হয় কতাগুলো য্যান আকাশ থাইকা ভাইসা আসতেছে। তাইলে তো তুই একডা তাজ্জব ফুল। আমি ফুল হমু ক্যান? আমার নামের মানে ফুল। বাজান কইত মাইয়াডা আমার ফুলের মতন। ওই একডাই কতা। তোর গুণেরও শ্যাষ নাই। বাজান কইত মাইয়াডা আমার বোকার ঢেঁহি। মইরমের হাসিতে জসিমের কান ভরে যায়। ও অন্ধকারে হাত বাড়ায়। যেন ও মইরমকে ধরতে পারবে। হাতটা মুঠি করে। মুঠিতে ঘাম জমে। ওর গতি দ্রুত হয়ে ওঠে। আশ্চর্য ও যেন এখন হাওয়ার বেগে ছুটছে। ও বাতাসে ছড়িয়ে দেয় কণ্ঠ: বিয়ার আগে তুই আমার সন্তানের মা হবি মইরি। লোকে কী কইবে হেইডা লইয়া ভাবিস না। এই দ্যাশে তো মাইয়ারা ধর্ষণ হইতাছে। হেতে কার কী আইসা যায়। বিচার-আচর কি দ্যাশে আছে? ক? আছে? ধর তোরে আমি ধর্ষণ করলাম, হের পরে বিয়া। এইরহম হইলে বেবাক ঠিক। সমাজের মাথা ঠান্ডা। আর ধর্ষণের সন্তানের বাপ হইয়া গেলে তো সমাজ মাথায় তুইলা থুইবে। কইবে, এমন ভালা পোলা হয় না। আমরা সব ঠিক করছি। আগে সন্তান নিমু। তারপর জমি-ঘর নিমু। জীবনরে খাড়া করমু। মইরম তুই আর আমি এই সমাজরে খাঁচা বানামু। ওরা বন্দি থাকবে। আমরা ঘুইরা বেড়ামু সমাজের নাকে দড়ি দিয়া। জসিম বাজারের কাছে আসতেই কফিল ওর হাত চেপে ধরে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে, শালা। গাল পাড়িস ক্যান? তুই না কইলি সত্তর বছরের নূরালি হাওলাদার ষোলো বছরের মইরমরে গর্ভবতী করছে? ঠিকই কইছি। তুই জানলি ক্যামনে? এত কথার জবাব দেই না। শালা সব তোর সাজানো নাটক। সন্তান অই বুড়ার লয়, তোর। হা হা করে হাসতে হাসতে জসিম বলে, বুড়া তো আটকুঁড়া। তাইলে? কাফিল ওর ঘাড়ের ওপর থাবা দিয়ে ধরে। ঠিক কইলাম না? ছাড়। ব্যতা লাগতিছে। কফিলের থাবা আরও চেপে বসে। জসিম দু’হাত দিয়ে ওর হাত ছাড়াতে চায়। পারে না। কফিল হিসহিস কণ্ঠে বলে, বল, ঠিক কি না? নূরালি পোলা চায়। মানুষডা প্রেম বোঝে। একডা প্রেমিক মানুষ। ভালোবাসা চিনে। শালা, তোর কথা ক। কফিল ওর ঘাড় ছাড়ে না। জসিম গায়ের সব জোর দিয়ে ওকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে, ওই বুড়ার কতাই আমার কতা। ভাগ শালা। 54 • June / July 2015
তাইলে তুই অহন ওই বুড়া? জসিম হাসতে হাসতে বলে, কয়দিন পর মইরমের সাতে আমার বিয়া। গরুর গোস্ত আর ভাত খাওয়ামু। অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জসিম। কফিল দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারে ওর চলে যাওয়া দেখে। ওর রাগ বাড়ে। জসিমের ওপর প্রতিশ�োধ নেওয়ার ইচ্ছে হয়। পরক্ষণে নিজেকে নেংটি ইঁদুর বলে গাল দেয়। তারপর ভাবে, ইঁদুরের মতো ধারালো দাঁত ওর নেই। ও অন্ধকারে পথে নামে। দিনের বেলা হলে ধানখেতের আলে শুয়ে থেকে চোখ বুজে রাখত। এভাবে চারপাশ থেকে খানিকক্ষণের জন্য পালিয়ে থাকা যায়। যেদিন নূরালির সঙ্গে ঘটনাটি ঘটল সেদিন বুক ভেঙে গেল মইরমের। বুড়ো প্রথমে ওকে চিৎ করে রেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর উপুড় করল। তারপর উত্তেজিত বুড়ো হাড়সর্বস্ব শরীরে ওকে যখন মন্থন করল, ও চেঁচিয়ে বলল, মরণ! ‘মরণ’ শব্দ শুনে নূরালির থুতু ভরা মুখ থেকে ফসফস শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকে- মরণ তো জমি, ভিটা, ঘুঘু, লাউগাছ। মরণ তো চুলা, ভাতের হাঁড়ি, সানকি, নুনের বাটি। মরণ তো শীত-বৃষ্টি, রাইত জোয়ান স্বামীর চোদন! মরণ তো মরণঘরের মধ্যে পস্সব, পোলার কান্দন। হা হা করে হাসতে থাকে নূরালি। মইরম বুঝে যায় এটা জসিমের হাসি- হুবহু একই রকমনূরালির সঙ্গে জসিমের কোনও পার্থক্য নেই। ও নিস্তেজ হয়ে যায়। ভাবে নূরালি ওকে নিয়ে যা খুশি যা খুশি করুক। এই পুলসেরাতটুকু পেরোলে ও পাবে দোজখ- দোজখের মতো আগুনের সংসার, ইবলিসের মতো স্বামী। ওহ, কী আনন্দ। ওপাশে পড়ে থাকাটা ওড়নাটা টেনে নিয়ে নিজের মুখে লেগে থাকা নূরালির থুতু মোছে। ওরা এখন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বারান্দায় বসে আছে। নূরালি কিছুক্ষণ বারান্দার বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। বেশিক্ষণ ঝুলিয়ে রাখতে পারে না। বেঞ্চের ওপর পা উঠিয়ে নেয়। ওর এখন সুখের সময়। চেহারায় অদৃশ্য হাসির আভা, যেন এই মুহূর্তে ও এখানে নেই। ও এখন সবদেশের আদি মন্দিরে। মন্দিরের সেবাদাসীরা ওকে ঘিরে রেখেছে। কার সঙ্গে যাবে। কারও সঙ্গে তো যেতেই হবে। ঘরে বৃদ্ধা স্ত্রী। সন্তান নেই। দু’জনেই সন্তান চায়। স্ত্রী বলেছে, আমার জন্য আর অপেক্ষা না। তুমি সন্তান উৎপাদন করো। মন্দিরের পুরোহিত নূরালি মুচকি হাসে। ও তো কত সন্তানই উৎপাদন করেছে, তার তো হিসাব রাখেনি। ওর চোখরাঙানিতে মুখ খোলেনি মেয়েরা। ও অন্য কোনও যুবকের সঙ্গে ওদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নইলে মেরে ফেলা। এবার ওর ছেলে চাই। নূরালি আনন্দে উদ্বেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়। ঘরে বাঁজা চার বউয়ের মুখের ওপর ছেলেটা কোলে দিয়ে বলবে, দ্যাখ, ক্ষ্যামতা কত। ও দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চারপাশের মানুষ ওর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায়। মইরম নূরালিকে দেখে। ওর হাসি পায়। সেদিনের উত্তেজনার মুহূর্তে নূরালি ওকে বলেছিল, আমি তোরে ভালোবাসি রে মইরম। ভালোবাসা পবিত্র। ভালোবাসার পুত্র কহনও কুপুত্র হয় না। আমার ভালোবাসতে খুব সাধ হয়। আমি বুড়া হই নাই রে মইরম। যে মানুষ ভালোবাসতে জানে সে মানুষ কি বুড়া হয় রে মইরম! হয় না। মইরমের এই মুহূর্তে মনে হয় ছোটবেলার কোনও কিছু না দেখে ভূতের ভয় পাওয়ার মতো ভূতটা এখন ওর সামনে। ওর ভীষণ হাসি পায়। ভূত দেখার আনন্দ বেশ। সকিনা বলে, হাসস ক্যান ছেমড়ি? ভূত। ও নূরালিকে আঙুল দিয়ে দেখায়। সকিনা হেসে ফেলে। হাসির শব্দে চোখ খোলে নূরালি। কী হইয়েছে? আপনারে ডাকে। টিপসই দিতে অইবে। টিপসই? ও সোজা হয়ে বসে। আপনের টিপসই দেওয়া অইলে এক কাঠা জমি আমার অইবে। হ, টিপসই তো দিমু। নূরালি সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে এসে টিপসই দেয়। পাশে ঝুলিয়ে রাখা ন্যাকড়ায় হাতের কালি মুছে ফেলে। তারপর মইরমের হাত ধরে বাইরে এসে দাঁড়ায়। পেছনে সকিনা। আমি মুড়ি আর কলা খামু। ক্ষিদা লাগছে। সকিনা চুপিচুপি বলে, বমি হইব। হোক। বমি করলে আমার মাথা ঘোরানো থাইমা যাইব। আমার ঘুম পাইতাছে। নূরালির সঙ্গে আসা কাজের লোকটা মুড়ি আর কলা কিনে আনে। ওরা রাস্তা থেকে দূরে সরে গিয়ে কাঁঠাল গাছটার নীচে বসে। মইরম মুড়ি আর কলা খেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে বমি করতে শুরু করে। নূরালি সে দৃশ্য দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, সাবাস, নূরালি সাবাস। তুমি পোলার বাপ হইবা। মইরম আচমকা পেছন ফিরে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে, তুমি না বুইড়া, বাপ হইবে জসিম। কয়েকদিনের মধ্যে মাথায় বেড়া আর খড় দিয়ে ঘর ওঠায় সকিনা। তারও সাতদিন পরে বিয়ে হয় জসিম ও মইরমের। মইরমের চোখের নীচে কালি পড়েছে। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে গেছে। ওর মনে আনন্দ নেই। জীবনের সবটুকু এখন বিস্বাদে ভরা। জসিম ওকে আদর করে বলে, কী হইছে? মইরম কথা বলে না। নিস্পৃহতা ওকে গ্রাস করে রাখে। বেঁচে থাকার অর্থ ওর কাছে ফুরিয়ে গেছে যেন। তখন জসিম ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে, আয়, দুঃখ ভুলাইয়া দিমু। আবার সেই একই ঘটনা। আবার- আবার- মইরমের বমি পায়। শরীর ভালো নেই। কিন্তু আনন্দ কোথায়? জসিম উৎফুল্ল হয়ে বলে, তুই খুশি হইছস মইরি? মইরম তিক্ত কণ্ঠে বলে, মরণ! মইরি সোনা, আমরা অহন স্বামী-স্ত্রী। মইরম একই রকম ভঙ্গিতে আরও তিক্ত কণ্ঠে বলে, মরণ! অলংকরণে দেবযানী রায় বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত শক্তিশালী লেখিকা। বর্তমানে ঢাকার বাংলা অকাদেমির সভাপতি। প্রাপ্ত বহু সংখ্যক পুরস্কারের মধ্যে ১৯৮০ সালে বাংলা অকাদেমি পুরস্কার রয়েছে। June / July 2015 • 55
56 • June / July 2015 প্রচেত গুপ্ত শশীবাবুর ফেসবুক শশীবাবু উত্তেজিত। তিনি কি সত্যি দেখছেন? হতেই পারে না। এ জিনিস সত্যি হতে পারে না। নিশ্চয় চোখের ভুল। এই বয়সে চোখের ভুল হওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। শশীবাবু ঝুঁকে পড়লেন। টেবিলের ওপর প্রায় উঠে পড়লেন বলা চলে। নাকের ওপর ঝুলে পড়া চশমা টেনে তুললেন চোখে। না, ভুল নয়। ওই তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। থ্রি হান্ড্রেড সেভেন্টি সেভেন। তিনশ�ো সাতাত্তর। মাত্র সাতদিনে তিনশ�ো সাতাত্তর। সাতদিনে তিনশ�ো সাতাত্তর হলে সাতাশ দিনে কত হবে? সাতচল্লিশ দিনে? সাতষট্টি দিনে? শশীবাবুর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। একটা বয়সে উত্তেজনায় মানুষের মাথা গুলিয়ে যায়। শশীবাবুর তাই হল। উত্তেজনাকে তার মনে হচ্ছে ‘বিপদ’। বিপদে মানুষ খড়কুটো চেপে ধরে। এই মুহূর্তে শশীবাবুর হাতের কাছে খড়কুটো নেই, মাউস আছে। তিনি মাউস চেপে ধরলেন। শশীপতি সমাদ্দার। সংক্ষেপে শশীপতি। বয়স সাতান্ন বছর তিন মাস সাত দিন। এইরকম ডিটেইলসে বয়সের হিসেব রাখবার কারণ আছে। শশীপতিবাবুর স্বর্গত পিতার নাম পশুপতি সমাদ্দার। তিনি ছিলেন একজন ভাবনা বিলাসী মানুষ। কাজকর্মের থেকে তিনি হাবিজাবি ভাবনার মধ্যে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। তার ভাবনার প্রিয় সময় ছিল সকালবেলা। স্নানের আগে উঠোনে বসে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে তেল মাখতেন। পালিশ করা জুতোর মতো যতক্ষণ না শরীর চকচক করে ওঠে ততক্ষণ তার তেল রগড়ানো প্রক্রিয়া চলত। একদিকে তেল রগড়াতেন, অন্যদিকে ভাবতেন। সম্ভবত তেলের ঝাঁঝে তার ভাবনার দুয়ার খুলত। বিশেষ করে নাকে, কানে তেল দেওয়ার পর ভাবনা যেন উথলে উঠত। ভাবনার বিষয় ছিল নানা প্রকৃতির, নানা সাইজের। তবে মনুষ্যজাতিকে কীভাবে অধঃপাতের হাত থেকে রক্ষা করা যায় তাই নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল সবথেকে বেশি। প্রতিদিন অফিসে লেট করা পশুপতি সমাদ্দারকে এই গুরুদায়িত্ব কে দিল তা অবশ্য কখনও জানা যায়নি। এরকম এক ভাবনাঘন মুহূর্তে তিনি তার একমাত্র সন্তান শশীপতিকে ডেকে পাঠালেন। শশীপতি তখন বালক। স্কুলে পড়ছেন। পারতপক্ষে বাবার সামনে যেতে চাইতেন না। গেলে তার নিজের কোনও সমস্যা হত না, সমস্যা হত দু’টি হাঁটুর। তারা কাঁপত। সেদিনও কাঁপা হাঁটু নিয়ে শশীপতি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পশুপতিবাবু স্নেহের গলায় বললেন, ‘বাবা শশী, প্রত্যহ তেল মাখছ তো?’ বালক শশীপতি কাঁপা হাঁটু সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘হ্যাঁ, মাখছি।’ পশুপতিবাবু খুশি হয়ে বললেন, ‘অতি উত্তম। জীবনে তেল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত বড় হবে তেলের মাহাত্ম্য স্পষ্ট হবে। তেলের কারণে ত্বকে জেল্লা বাড়ে, শরীরে বল বাড়ে, মনে জোর বাড়ে, মগজে চিন্তা বাড়ে। মনে রেখো, তেলই একমাত্র জিনিস যা শুধু নিজে মেখে উপকার পাওয়া যায় না, অন্যকে মাখালেও উপকার মেলে। সুতরাং তেলকে কখনও অবহেলা করবে না। কথাটা মনে থাকবে?’ শশীপতি বাধ্য পুত্রের মতো মাথা নেড়ে বললেন, ‘মনে থাকবে বাবা।’ পশুপতিবাবু বললেন, ‘থাক ওসব। আজ আমি তোমাকে যে জন্য ডেকেছি এবার সেটা বলি। এতক্ষণ আমি মনুষ্যজাতির গোল্লায় যাবার বিবিধ কারণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলাম। করতে করতে বুঝতে পারলাম, মনুষ্যজাতির দুর্দশার অন্যতম কারণটি হল তারা সময়ের মূল্য বোঝে না। জীবনের প্রতিটি ক্ষণই যে অতি মূল্যবান, মানুষ এই সহজ কথাটা শেখেনি। ফলে জীবনের ক্ষণ, মুহূর্ত, পল, অনুপল বৃথা বয়ে যায়। মনে রাখবে, জীবনের কোনও ক্ষণ না যায় ফেলা। বয়স মানে শুধু বছর নয়। মাস, দিন, ঘণ্টা, মুহূর্তও রয়েছে। তুমি প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাবে। হিসেব রাখবে।’ হিসেবের কথা শুনে বালক শশীপতির হাঁটুর কম্পন বেড়ে যায়। এ আবার কী নতুন ঝামেলা রে বাবা! যে কোনও ধরনের হিসেবেই তিনি ছিলেন অতিশয় কাঁচা। স্কুলের অঙ্ক পরীক্ষায় একশ�োর মধ্যে সতেরো, আঠেরো পেলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেন। এই বয়সে আবার নতুন হিসেবে ঢুকতে হবে! উপায় কী? পিতার আদেশ বলে কথা। সেদিন দু’হাতে হাঁটু সামলে ঘাড় কাত করেছিলেন শশীপতি। পিতা চলে গেছেন, পিতার আদেশ রয়ে গেছে। বয়সের হিসেবে ঘণ্টা, সেকেন্ড পর্যন্ত যেতে না পারলেও মাস আর দিনটুকুর ওপর নজর রাখেন অকৃতদার, ওয়ানরুম ফ্ল্যাটবাড়িতে একা থাকা শশীপতি সমাদ্দার। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারে আঁচড় কাটেন। সেই সাতান্ন বছর তিন মাস পাঁচ দিনের শশীবাবু আজ কোন বিপদে পড়েছেন? তার হলটা কী? বিপদের নাম ফেসবুক। সাতদিন হল ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন শশীপতিবাবু, গোদা বাংলায় নিজের নাম লিখিয়েছেন বলা যায়। সেই নাম নিজের আবার নিজেরও নয়। ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে। সতেরো বছরের ঝর্না তাকে বুঝিয়েছে, ‘শশীজেঠু, ফেসবুকে নিজের নাম একটু ঘোলাটেই ছোটগল্প
June / July 2015 • 57 রাখতে হয়। বোঝা যাবে, কিন্তু বোঝা যাবে না। চেনা যাবে, কিন্তু চেনা যাবে না। একে নতুন বাংলায় বলে ঘেঁটে যাওয়া নাম।’ শশীপতিবাবু বিস্মিত। নিজের নাম নিয়ে একী ছেলেখেলা। ঘেঁটে যাওয়াই বা কেমনতর বাংলা! নাম কি মাটির তাল? যে ইচ্ছেমতো ঘাঁটাঘাঁটি করা যায়? তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথার মানে কী ঝর্না? নিজের নাম চেনা যাবে না! এর পর তো বলবে নিজেকেও চেনা যাবে না।’ ঝর্না ঝর্নার মতো খলখল করে হেসে বলে, ‘যাবে না তো বটেই। দু’দিনে ফেসবুকে ডুব দিয়ে দেখো না একবার, দেখবে কী কাণ্ড হয়! দেখবে, তুমি মানুষটাই বদলে গেছ। ছিলে রিয়েল হয়ে গেলে ভার্চুয়াল। রুমাল থেকে বিড়ালের মতো।’ শশীপতিবাবু ভয়ে ভয়ে বলেন, ‘ঝামেলার কিছু হবে না তো রে ঝর্না? আবার নিজের মতো ফিরতে পারব তো?’ ঝর্না উৎসাহের সঙ্গে বলে, ‘অবশ্যই ঝামেলার হবে। সবটাই ঝামেলার। কত বড় বড় সব মানুষের সঙ্গে তোমার আলাপ হবে। তারা তোমার ফ্রেন্ড হবে। তাদের সঙ্গে চ্যাট হবে। তার ওপর গ্রুপ আছে, ওয়াল আছে, লাইক আছে, কমেন্টস আছে। হেভি ব্যাপার। এসব সামলানো কি কম ঝামেলার? একই সঙ্গে ঝামেলার এবং ইন্টারেস্টিং।’ ঝর্না শশীপতিবাবুর মাসতুতো বোনঝি। চটপটে মেয়ে। দশদিন আগে মাসতুতো বোনের বাড়িতে গিয়েছিলেন শশীপতিবাবু। আত্মীয়স্বজন বিশেষ নেই তার। যে দু-একজন আছে তাদের প্রায় কারও সঙ্গেই সম্পর্ক রাখেন না। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝছেন, রোজগেরে অবিবাহিত পুরুষ মানুষের জন্য আত্মীয়স্বজন বিপজ্জনক। একটা বয়স পর্যন্ত তারা বিয়ের সম্বন্ধ আনতে থাকে। আনতেই থাকে, আনতেই থাকে এবং আনতেই থাকে। হাজার বারণ করলেও শ�োনে না। পারলে একেবারে বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে আনে। এনে গদ্গদ মুখে বলে, ‘আহা চটছ কেন? বিয়ে ঠিক হয়নি তো কী হয়েছে, কাজ খানিক এগিয়ে রাখতে তো ক্ষতি নেই? তাই কার্ডটা ছাপিয়েই ফেললাম। হে হে। কার্ড ভালো হয়েছে?’ বয়স হয়ে গেলে আত্মীয়দের মাথা থেকে বিয়ের ভূত নামে, তখন তারা আসে ধার করতে। ভাবটা হল, ‘বিয়ে যখন করলি না, এবার তবে ধার দে। একা মানুষ। তোর রোজগারের টাকা খাবে কে? অত টাকা রেখে করবিটা কী?’ বোঝো কাণ্ড! এই উৎপাতের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই শশীপতিবাবু অল্প বয়সেই আত্মীয়পরিজন পরিত্যাগ করেছেন। এই মাসতুতো বোনের সঙ্গেই যেটুকু সম্পর্ক। তবে তারাও এবার পাততাড়ি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। জামাই বড় প্রোমোশন নিয়ে বদলি হয়েছে। সবাই খুশি। সব থেকে বেশি খুশি সতেরো বছরের ঝর্না। তার অধিকাংশই বন্ধুই নাকি বাইরে। সে মরতে কেন পড়ে থাকবে? এই উপলক্ষেই বোনের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া ছিল। শশীপতিবাবুও গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, বোনঝি অবিরত হাতের মোবাইল ফোনে, কোলের ল্যাপটপে, টেবিলের কম্পিউটারে খুটখুট করে চলেছে। ননস্টপ খুটখুটানি। ব্যাপারটা কী? শশীপতিবাবু একসময় বলেই ফেললেন, ‘কী খুটখুটানি করিস ঝর্না?’ ঝর্না হেসে জবাব দিল, ‘ফেসবুকে চ্যাট করি জেঠু।’ শশীপতিবাবু অবাক হয়ে বলেন, ‘চ্যাট! সেটা কী জিনিস! ব্যাট শুনেছি, ফ্যাট শুনেছি, ক্যাট শুনেছি, র্যাট শুনেছি। চ্যাট তো শুনিনি! এও কি তোদের বিন্দাস, ব্যাপক, হেভি, ঝাক্কাসের মতো নতুন বাংলা শব্দ?’ ঝর্না আকাশ থেকে পড়ে, ‘সেকি জেঠু! চ্যাট কী জানোও না। তুমি কি স্টোন এজে আছ? প্রস্তর যুগে?’ শশীপতিবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘তা খানিকটা বলতে পারিস। অফিসের জন্য বুড়ো বয়সেও জোর করে খানিকটা কম্পিউটার শিখতে হয়েছে। তার বেশি বিদ্যে নেই।’ ঝর্না ঝনঝন করে ওঠে। বলে, ‘তোমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই!’ শশীপতিবাবু নিজের ফেসে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘এরকম একটা কথা অফিসের ছেলেছোকরাদের মুখে শুনেছি বটে, তার বেশি জানি নে। আমার তো ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট আছেই… তাই ভাবলাম…।’ ঝর্না চোখ পাকিয়ে বলল, ‘খুব অন্যায় করছ। তোমার অবশ্যই ফেসবুক অ্যাকাউন্টস সম্পর্কে ডিটেইলস জেনে নেওয়া উচিত ছিল। ফেসবুক ছাড়া আজকের দিনে সব অচল।’ শশীপতিবাবু ঢোঁক গিলে বললেন, ‘এই বুড়ো বয়সে ওসব মানাবে?’ ঝর্না তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘বাজে কথা বোলো না জেঠু। ফেসবুকের অপমান কোরো না। সবার অপমান আমরা সহ্য করি। ফেসবুকের অপমান সহ্য করব না। ফেসবুকে বয়সের হিসেব অন্যরকম। সে বাড়েও না, কমেও না।’ শশীপতিবাবু নড়েচড়ে বসলেন। নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন জীবনের কোনও মুহূর্ত যেন নষ্ট না হয়। ফেসবুকে কি মুহূর্ত আটকে থাকে? সময়? শশীপতিবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘ব্যাপারটা কীরকম শুনতে পারি ঝর্না?’ ঝর্না উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘কোনও ব্যাপারই নয়। ফেসবুকে ছোট-বড় বলে কিছু হয় না। সবাই সমান। সবাই এক। তুমি যদি একবার ফেসবুকে যাও, দেখবে তুমিও সবার মতো হয়ে গেছ। তোমার বয়স গেছে থমকে। বাড়েও না, কমেও না।’ শশীপতিবাবু একই সঙ্গে বিস্মিত এবং মুগ্ধ। পুচকে মেয়েটা বলে কী! তিনি অস্ফুটে বললেন, ‘আমার বয়স কোথায় থমকাবে রে ঝর্না?’ ঝর্নার হাসি সুন্দর। সে সুন্দর হেসে বলল, ‘যখন যেমন চাইবে। আমার সঙ্গে চ্যাট করবার সময় সতেরো। মায়ের সঙ্গে কথা বলবার সময় চল্লিশ। আবার বাবার সঙ্গে কথা কথা বলার সময় সাতচল্লিশ। সবথেকে বড় কথা কী জানো জেঠু? ফেসবুক এমন জিনিস যে তোমাকে মোটে সময় নষ্ট করতে দেবে না। সারাক্ষণ ছুটিয়ে ছাড়বে। প্রতিটা মোমেন্ট এনজয় করবে। কাজে লাগাবে। এই যে তুমি দশটা পাঁচটার অফিস ছাড়া বাকি দিনটা গড়িয়ে এলিয়ে ঘুমিয়ে কাটাও, সেই সুযোগ পাবে না মোটে। তেমন হলে রাতের ঘুমও তাড়িয়ে ছাড়বে ফেসবুক।’ শশীপতিবাবুর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। বাবা তো এই কথাই বলেছিলেন। সময় যেন বৃথা না যায়। সময় যেন বহিয়া না যায়। শশীপতিবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘হ্যাঁরে, আমার ফেসবুক হতে পারে? বয়স তো অনেক। সাতান্ন পার হয়ে গেল…।’ ঝর্না চকচকে চোখে বলল, ‘সাতান্ন কেন, একশ�ো সাতান্নতেও ফেসবুক করা যায়। তুমি কম্পিউটার চালাতে পার?’ শশীপতিবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘ওই যে বললাম, অফিসের গুঁতো খেয়ে খানিকটা পারি। অফিস থেকে লোন নিয়ে বাড়ির জন্য একটা কিনেছিলাম বটে। টেবিলে পড়ে পড়ে সেই মেশিনে ধুলো জমছে।’ ঝর্না লাফিয়ে উঠে বলল, ‘দারুণ। আজই তোমাকে সব শিখিয়ে দিচ্ছি, অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছি তোমার। তারপর যত খুশি চ্যাট করো।’ শশীপতিবাবু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘চ্যাটটা কী ব্যাপার একটু বলবি নাকি? খরচাপাতি লাগে?’ ঝর্না ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে বলল, ‘চ্যাট হল… চ্যাট হল… আচ্ছা, সহজ কথায় বলছি চ্যাট হল কথার কচকচানি। শুধু কথা, কথা আর কথা। কথার ছোটগল্প
58 • June / July 2015 সি, কথার মাউন্টেন, কথার ডেজার্ট।’ এত কথার কথা শুনে শশীপতিবাবু ঘাবড়ে গেলেন। তিনি চুপচাপ মানুষ। বললেন, ‘এত কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে পড়ব না তো রে! ভয় লাগছে।’ ঝর্না বলল, ‘ধুস হাঁপাবে কেন? এ কি তোমার মুখের কথা? এ কথা অন্য কথা। ভার্চুয়াল টক। চটচটে কথাও বলতে পার। চটচটে জানো তো? গামের মতো স্টিকি। আমার তো মনে হয় চটচটে থেকেই চ্যাট কথাটা এসেছে। একবার লেগে গেলে আর ছাড়ানো যায় না। পালানো যায় না। হি হি।’ শশীপতিবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘থাক বাবা, আমার অত বুঝে কাজ নেই। তুই বরং আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দে ঝর্না। সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমার বাবাও বলতেন, সময় নষ্ট মোটে নয়।’ ঝর্না ব্যবস্থা করে দিয়েছে। শশীপতি সমাদ্দারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হয়েছে। সেখানে তার নাম শস। ঝর্নাই নতুন নাম ঠিক করেছে। যদিও শশীপতিবাবু ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন। ‘শস শুনলে কেমন শ্বাস, নাভিশ্বাস শ�োনাচ্ছে না?’ ঝর্না ধমক দিয়ে বলল, ‘শ�োনাক। এটাই স্টাইলের নাম। যেমন ফেসবুকে আমার নাম ঝর্না নয়, ঝরঝর। শুনলেই মনে হয় ঝরঝরে হয়ে গেছি। হোক গে। দেখো, তোমার ওই নাভিশ্বাস কেমন হিট করে। শস দেখে মেয়েরা লাইক করবার জন্য আঁকুপাকু করবে। ফেসবুক ছেড়ে তুমি আর উঠতে পারবে না। কত যে ফ্রেন্ড হবে তোমার! উফ, আমারই হিংসা হচ্ছে।’ কথা শেষ করে খিলখিল করে হেসে উঠল ঝর্না। আঁতকে উঠলেন শশীপতিবাবু। ফ্রেন্ড! কত ফ্রেন্ড? ঝর্না সে প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, মিটিমিটি হেসেছে শুধু। আজ টের পাচ্ছেন শশীপতিবাবু। হঠাৎই খেয়াল হয়েছে তার। খেয়াল করে মাথা ঘুরে গেছে। মাত্র সাতদিনে তার ফেসবুকে ‘ফ্রেন্ড’ জড়ো হয়েছে তিনশ�ো সাতাত্তর জন। বন্ধুতো দূরের কথা। সাতান্ন বছরের জীবনে এত মানুষকে তিনি চেনেনই না। এর পরেও নার্ভাস লাগবে না? মনে হবে না বিপদে পড়েছি? খানিকটা ধাতস্থ হবার পর শশীপতিবাবু বুঝতে পারলেন, এটা বিপদ নয়। এটা আনন্দ। জীবনে বকবকানির এই আনন্দ তাকে এনে দিয়েছে ফেসবুক। সে তার ফেসে হাসি এনেছে। বুকে এনেছে খুশির জোয়ার। এত ‘ফ্রেন্ড’ মানে না জানি কত ভালোবাসা! এত ‘ফ্রেন্ড’ মানে, না জানি কত মায়া মমতা! এত ‘ফ্রেন্ড’ মানে, না জানি কত মতামত, কত বিগ বিগ টক। আহা! বাবা যদি এই জিনিস দেখে যেতে পারতেন! কত ভাবনাই না দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিতেন। ফেসবুক আর তার ‘ফ্রেন্ডকুল’কে তিনি যদি সঙ্গে পেতেন মনুষ্যজাতির গোল্লায় যাওয়া তিনি একা হাতে ঠেকাতেন। বেচারি সে সুযোগ পেলেন না। তেল মেখে মেখে মরলেন। এসব ভাবতে ভাবতে একই সঙ্গে শরীর অবশ হয়ে আসছে আর উত্তেজনায় রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে শশীপতিবাবুর। কই আগে তো কখনও বোঝেননি এ জিনিসের এত গুরুত্ব। এত মানুষ তার ‘ফ্রেন্ড’ হবার জন্য আকুলি বিকুলি করছিল! মনে মনে তিনি ঝর্নাকে আর্শীবাদ করলেন। ফেসবুক দেবতা তার মঙ্গল করুক। তবে শশীপতিবাবু নিজেও খেটেছেন খুব। মোটে সময় নষ্ট করেননি। শুধু বাড়ি টু অফিস আর অফিস টু বাড়ি। বাকি সময়টা কাটিয়েছেন টেবিলের সামনে। কম্পিউটারের মুখোমুখি। মর্নিং ওয়াক বন্ধ করেছেন। সময় কই? তখন তো হনলুলুর ফ্রেন্ডের সঙ্গে কম্পিউটারে খুটখাট চলে। মর্নিং ওয়াকের বন্ধুরা ডাকাডাকি করলে দরজা খোলেন না। সকালে বাজারে গিয়ে ঢেঁড়শ, ঝিঙে, বরবটির খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে কেনবার অভ্যেস ছিল। সে অভ্যেস বাতিল করতে হয়েছে। সময় কম। থামাতে হয়েছে বাজার শেষে চায়ের দোকানের আড্ডা। আড্ডায় গরম চায়ের সঙ্গে রাজারা জড়াদের মুন্ডুপাত চলত। সে পাট চুকেছে। না চুকিয়ে উপায় কী? ওই সময়টায় দামাস্কাসের ‘ফ্রেন্ড’ অপেক্ষা করে থাকে। সাতদিন আগেও শশীপতিবাবু অফিস বেরোতেন হাতে সময় নিয়ে। বগলে ছাতা, ব্যাগে টিফিন বাক্স নিয়ে হেলতে দুলতে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে উঠে বসতেন। তারপর আলতো ভাতঘুম। এই বিলাসিতার আর সুযোগ নেই। ফেসবুকে টোকিয়োবাসী ‘ফ্রেন্ড’কে সামলে অফিসের জন্যই বেরোতেই রোজ লেট হয়ে যায়। এর পরে ট্রামে আর ঘুম হয়? অফিস থেকে ফেরবার পথে মাঝেমাঝে ক্লাবে ঢুঁ মারবার নেশা ছিল। ক্লাবের বন্ধুদের সঙ্গে একহাত তাস খেললে মনটা হালকা হত। সেই নেশা এখন দূর হয়েছে। এখন মন হালকা হয় কম্পিউটারে আলাস্কার ‘ফ্রেন্ড’-এর সঙ্গে বকবক করে। কোনও কোনও রবিবার ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা এসে চা-সিঙারা খেয়ে যেত। বেশ লাগত শশীপতিবাবুর। গান, কবিতা, গল্পগুজবে সময়টা কেটে যেত। গত রবিবার খুব বিশ্রীভাবেই সবাইকে তাড়িয়েছেন। একরকম অপমানই বলা যেতে পারে। তারা বলেছে, আর এদিক মাড়াবে না। না মাড়াক। বয়ে গেছে। এখন ‘ফ্রেন্ড’-এর অভাব নেই শশীপতিবাবুর। তার আছে ফেসবুক। শুধু কি রবিবার সকাল? না শুধু রবিবার সকাল নয়। সাতদিনই এমনটা চলছে। রোজ রাতেই খেতে দেরি। শুতে দেরি। ঘুমোতে দেরি। পরদিন উঠতে দেরি। ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ড আর ফ্রেন্ড। এক মুহূর্ত সময় নেই শশীপতিবাবুর। জীবনের কোনও ক্ষণ তিনি নষ্ট করেন না। শশীপতিবাবু চেয়ারে হেলান দিলেন। সেই শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। চোখ জ্বালা করছে। করুক। মাথা ঝিমঝিম করছে। করুক। কোনও ক্ষণ যেন বৃথা না বয়ে যায়। চোখ বুজে মাউস আঁকড়ে ধরলেন শশীপতিবাবু। তিনশ�ো সাতাত্তরকে তিন লক্ষ সাতাত্তর করতে হবে। ‘ফ্রেন্ড’ যেন থাকে জীবনের বনে বনে, ফুলে ফুলে, পাতায় পাতায়, আড়ালে আড়ালে, কোণে কোণে। আচ্ছা, ঘুমের মধ্যে ফেসবুক করবার কোনও কায়দা আবিষ্কার হয়নি? হবে নিশ্চয়। বিজ্ঞান কখনও পিছিয়ে থাকে না। একদিন ঠিক হবে। ঘুমেও চ্যাট চলবে। লাইক চলবে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মাথায় চক্কর দিল। কিছু বোঝবার আগেই শশীপতিবাবু মাউস, কি বোর্ড নিয়ে চেয়ার থেকে হুড়মুড়িয়ে পড়লেন মেঝেতে। কয়েক মুহূর্তের অন্ধকার। ব্ল্যাক আউট। বেশি বয়সে একটানা পরিশ্রমের ফল। চোখ খুলতে খুলতে থেবড়ে পড়ে থাকা শশীপতিবাবু বুঝতে পারলেন, কোমরে চোট লেগেছে। মনে হয় ভেঙেছে। নিজে উঠে দাঁড়াবার উপায় নেই। কাতরে উঠলেন শশীপতিবাবু। কঁকিয়ে উঠলেন। শশীপতি সমাদ্দার অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাচ্ছেন। টেনে তোলবার মতো কেউ কি আছে? ফেসবুকে যার তিনশ�ো সাতাত্তর জন ‘ফ্রেন্ড’, তার পাশে একজন বন্ধুও কি আছে? একজনও? না, নেই। অলংকরণ -- অ্যালবার্ট অশ�োক লেখক আধুনিক বাংলা সাহিত্যে গল্পকার হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, আশাপূর্ণা দেবী জন্মশতবার্ষিকী সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ছোটগল্প
June / July 2015 • 59 ছোটগল্প আলোলিকা মুখোপাধ্যায় না, সঞ্জয়দের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ ক্লাবের পিকনিকে। ওদের দুই মেয়ের ছোটজন তখন আমার মেয়ে রিমির বয়সী। এরপর আরো কয়েকবার দেখা হল। দুর্গাপুজোর ফাংশনে রিমির সঙ্গে ওদের দুই মেয়ে কণিকা মণিকাও হাতে নাড়ু পাকিয়ে পাকিয়ে “পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে” নাচল। বিজয়া দশমীর বিকেলে এক খাবলা সিঁদুর মাখিয়ে দিয়ে লীনা বলল ওদের বাড়িতে আমাদের একদিন ডাকবে। সে সময় নতুন বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হলে ও তাদের এক বয়সী ছেলে-মেয়ে থাকলে মেলামেশায় আগ্রহ হত। রিমির সঙ্গে মণিকা,কণিকার প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্ভাবনায় ওদের বাড়িতে খুব শিগ্গিরই নেমন্তন্ন পেলাম। আমাদের বাড়ি থেকে আধঘন্টার পথ। সন্ধ্যেবেলা পৌঁছে দেখি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট জয়ন্তদা, মীনাদি, অরিন্দম, বিজয়া, শ্যামল, বন্দনারাও এসেছে। একটু পরে কণিকা, মণিকা এসে রিমি আর বিজয়ার মেয়ে ঋতুকে ডেকে নিয়ে গেল। সঞ্জয় সকলের সঙ্গে কথা- বার্ত্তা বলছেন। লীনার দেখা নেই। কিন্তু ওর চাঁছা-ছোলা সুকন্ঠের আওয়াজ পাচ্ছি। হঠাৎ কানে এল --- “ ছিঃ! আবার দুষ্টুমি করে! মাসিরা দেখলে কি বলবে? অ্যা-ই-ই-ই লাফাবিনা একদম।” আমি সন্ত্রস্ত হলাম। লীনা কাকে বকছে? রিমির তো লোকের বাড়ি গিয়ে লাফালাফি করবার মত বয়স নয়। নাকি দলে পড়ে হুড়োহুড়ি করছে? আবার লীনার ধমক-“ অ্যাই স্টপ!” আর বসে না থেকে আমি আর বিজয়া দু’জনেই কিচেনের দিকে যাচ্ছি দেখে সঞ্জয় ব্যস্ত হয়ে বললেন – “আপনারা বসুন, লীনাকে ডাকছি।” তার আগেই লীনা ঘরে ঢুকল – “ স্যরি, তোমাদের হ্যালো বলতেই আসতে পারছিলাম না। চারটে মিলে এত অসভ্যতা করছে।” বিজয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল-“ ওরা কোথায়? কী করছে বলুন তো!” আমারও রাগ হচ্ছে, বাড়িতে ডেকে অন্যের বাচ্চাদের কেউ এইভাবে ধমক দ্যায়! শাসন করবার একটা ভাষা তো আছে ! তাছাড়া এ বাড়িতে ঢোকামাত্রই মেয়েরা কী এমন অকাজ করল তাও তো বুঝতে পারছিনা! হঠাৎ কলকল করতে করতে ছোট ছোট মেয়েগুলো চলে এল। কণিকা আর মণিকার কাঁধে বসে আছে সবুজ রঙের দুটো প্যারাকিট। লীনার পায়ের কাছে উড়ে এসে বসল একটা নীলপাখী। চারনম্বর নীল বদরিকা সারা ঘরে চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে। লীনা বলল-“ সবুজ মোটাটা হচ্ছে আশুতোষ । ওর বউ শ্যামলী। নীলটার নাম গগন। বউটা নীলা। আজ দুপুর থেকে চারটেতে মিলে কি বদমাইশি করছে! দেব এবার খাঁচায় পুরে!” পাখীর কলকাকলি ছাপিয়ে বাচ্চাদের উল্লাস, লীনার বক্তৃতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম ‘অসভ্য’ তাহলে লাগাতার উড্ডীয়মান মোটা আশুতোষ, শ্যামল, গগন আর নীলা। সঞ্জয় অধৈর্য হয়ে বললেন-“ আরে এগুলোকে খাঁচায় রাখ নি কেন? এবার সবাইকে স্ন্যাক্স দেবে তো! আপনারা বলুনতো কাকে কী ড্রিংক দেব?” লীনার ডাকাডাকিতে তার মাথায় আর দু কাঁধে চড়ে পাখিগুলো ভেতরে চলে গেল। এক গুজরাটি মহিলার সঙ্গে স্ন্যাক্সের ট্রে নিয়ে লীনা ফিরে এল। এতক্ষণ পাখির কাণ্ড-কারকাখানা দেখে জয়ন্ত দা মন্তব্য করলেন --- “ তাই বল, লীনার ধমক-ধামক শুনে বুঝতেই পারিনি যে ও পাখিদের বকছে! এই লাভবার্ডগুলো আবার কথা বোঝে নাকি!ময়না, কাকাতুয়া তো আর নয় ।অলমোস্ট চড়াই পাখির সাইজ ।” লীনা বোঝাতে চেষ্টা করল--- “ চড়ুই পাখি পুষে তো আর কেউ ট্রেনিং দেয়না! দিলে হয়ত বোঝা যেত। প্যারাকিটের যে কি বুদ্ধি তা আপনি ভাবতেই পারবেন না।” লীনার উচ্ছ্বাসে বাধা দিয়ে মীনাদি বললেন--- “আর জেনে দরকার নেই। ছোটবেলায় ছেলে-মেয়েরা সব হুজুগ করে বিড়াল,কুকুর পুষলো। এখন যে যার কলেজে পালিয়েছে। আমি মরছি বুড়ো কুকুর আর ধুমসি বেড়ালের সেবা করে।” সবাই গল্প-টল্প করছি। বাচ্চারা এসে খবর দিল পাখিগুলো নাকি নানারকম ট্রিক্স জানে। মণিকা হেসে হেসে বলছিল ---“ বিকেলে কিচেন সিঙ্কে চান করবার পর আশুতোষ আর গগন কাউন্টার টপে রাখা স্যালাডের প্লেটের পাশে বসে ডানা ঝেড়ে ঝেড়ে জল ছেটাচ্ছিল। মায়ের কাছে ধমক খেয়েছে। মা আশুতোষকে চপস্টিক দিয়ে দুবার মেরেছে।” তিনকন্যা ও পাখির পালক লী
60 • June / July 2015 কী কাণ্ড। বিজয়া নিচু গলায় পরামর্শ দিল --- “ স্যালাড একদম বাদ। বাচ্চাদের খেতে ডাকলে খেয়াল রাখতে হবে।” আবার কণিকা, মণিকার দল এসে হাজির। ওরা পাখিদের কেরামতি দেখবার জন্য সবাইকে কিচেনে যেতে বলছে। সঞ্জয় বললেন --- “আজ নয়। অন্যদিন হবে। এখন ওদের গুড নাইট বলে দাও।” লীনা হাসল --- “ ঠিক আছে। তোমরা এবার ডিনার করবে চল। তখন ওরা ট্রিক্স দেখাবে।” বাচ্চাদের সঙ্গে আমরাও রান্নাঘরে গেলাম। এক তো ওদের স্যালাড নিতে দেবনা, তাছাড়া পাখিদের খেলাও দেখা হবে। কে জানে কীল্ দেখাবে! সার্কাসে কাকাতুয়া, ম্যাকাও-এর কেরামতি দেখেছি। আজ দেখব বদ্রিপাখির কেরদানি। বিরাট রান্নাঘরে স্লাইডিং দরজার কাছে সবুজ আর নীল রঙের দুটো খাঁচা ঝুলছে। নীল খাঁচায় গগন ছোট্ট দোলনায় দোদুল্যমান। নীলা ঝিমোচ্ছে। অন্য খাঁচায় আশুতোষ আর শ্যামলী প্রচণ্ড ঝটাপটি লাগিয়েছে। মাঝে মাঝে ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ ঘোরালো করে আমাদের দেখছে। রিমিরা কিচেন টেবিলে বসে খাচ্ছে। যথারীতি স্যালাড নিতে দেওয়া হয় নি, বিজয়ায় ফিশফিশ সতর্ক বাণী শুনে আমরাও আর ঘাস-পাতার দিকে যাইনি। প্লেট হাতে ডাইনিং রুমের দিকে যাচ্ছি, লীনা বলল ---“ এবার মজা দেখ” ও পাশের প্যান্ট্রির দরজা খোলার সময় আওয়াজ হল ‘ক্যাঁচ” ।তখনই চারটে পাখি চিৎকার করে উঠল --- ‘ক্যাঁচ”। লীনা ঘন ঘন তিনবার দরজাটা খোলা বন্ধ করল, পাখিরা সমস্বরে শব্দ করল --- ক্যাঁচ,ক্যাঁচ,ক্যাঁচ। ক্রমাগত এই যুগলবন্দী শুনে সঞ্জয় থামানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু লীনাকে আজ থামায় কে রে! হাতে দুটো কাঠি নিয়ে এসে খাঁচাদুটোর সামনে ফুলঝুরির মত ঘোরাতে লাগলো। যতক্ষণ ফুলঝুরি ঘুরছে, আশুতোষ অ্যাণ্ড পার্টি যে যার দোলনায় বসে ঘন ঘন দুলে যাচ্ছে। যেই ফুলঝুরি ঘোরানো থেমে গেল, ওরা দোলনা থেকে ডিগবাজি খেয়ে খাঁচার মেঝেতে পাতা স্যাণ্ড পেপারের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল। আমাদের হাততালি শুনে লীনা পরপর তিনবার সেই ঝুলনযাত্রা দেখিয়ে ক্ষান্ত হল। সত্যি! অবাক লাগছিল। জয়ন্তদা স্বীকার করলেন লীনার মত ট্রেনার পেলে চড়াই পাখিও জেমিনি সার্কাসে চান্স পেয়ে যেত। রিমির সঙ্গে কণিকা- মণিকার বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হতে সেও তার সাত বছরের জন্মদিনে একজোড়া পাখি চাইল। কমলা খাঁচা দুলিয়ে দু’টো সবুজ লাভ বার্ড কিনে আনলাম। সারাদিন কিচিরমিচির। বাটি থেকে দানা খায়। জল ছেটায়। তারা বড়কর্ম, ছোটোকর্ম যা-ই করুক, খাঁচা পরিষ্কার করা, দানাপানি দেওয়া ইত্যাদি সব দায় আমার। ঠোকর খাওয়ার ভয়ে একদিন রিমি রান্নাঘরের দস্তানা আভেন-মিট পরে খাবার দিতে গিয়েছিল,ওই বিকট বস্তু দেখে পাখিদু’টি খাঁচার এককোণে সিঁটিয়ে গিয়ে চেঁচাতে লাগলো। সেই থেকে আর রিমি ওদের দেখ-ভাল করেনা। শুধু ট্রেনিং দেয়। রিমি ভায়োলিন শেখে। খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন ছড় টেনে টেনে বেহালা বাজালো। তাতেও পাখিদুটো নির্বিকার। ক্যাঁ,ক্যোঁ কোনও আওয়াজেরই নকল করল না। আমাদের কোনো দরজাও ক্যাঁচ করে খোলেনা। মিউজিক্যাল এনভায়রনমেন্টের অভাবে ,উপযুক্ত ট্রেনারের অভাবে চার্লি আর শার্লি চড়াই পাখীর স্তরেই রয়ে গেল। হঠাৎ একদিন লীনার ফোন! ওরা কয়েকদিনের ছুটিতে ফ্লোরিডা যাচ্ছে। পাখি চারটেকে যদি আমাদের বাড়িতে রেখে যায়। জিজ্ঞেস করলাম ওর সেই পাশের বাড়ির মহিলার কী হল ? তিনি নাকি ওদের জন্য বার্ড সিটিং করেন। লীনা বলে উঠলো ---“ক্যাথির বিড়ালসোহাগী শাশুড়ি ঠিক এই সময়েই ওদের কাছে বেড়াতে আসছেন। সঙ্গে বিড়ালটাও জুটবে। তাই ও পাখিদের রাখতে চাইছেনা।” আসলে আমিও তো চাইছিনা, চারটে পাখির বাড়তি ঝামেলা কে নেবে! তাই পরামর্শ দিলাম- “খাঁচাগুলো তোমাদের বাড়িতেই থাক না। উনি রোজ এসে খাবার আর জল দিয়ে যাবেন। আমি তো পাশের বাড়ির লোকেরা ছুটিতে গেলে ওদের অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোর দেখা-শ�োনা করি। বাড়িতে তো আনিনা।” লীনা ক্ষুন্ন হল-“ পাখি আর মাছ এক হল! পাখি পুষেছো , বুঝতে পারোনা! ওরা মানুষের সঙ্গ ছাড়া বাঁচে?” কথাটা সত্যি। চার্লি আর শার্লি গান-বাজনা কিছু না শিখুক, আমরা বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে একটু ক্যাচর-ম্যাচর করে কিন্তু। মানে অনুরণন হয় আর কি! লীনার মুখের ওপর আর না বলা গেল না। ফ্লোরিডা যাওয়ার আগের দিন মণিকা-কণিকা পাখিসুদ্ধ জোড়া খাঁচা নিয়ে এল। সঙ্গে প্রভূত সরঞ্জাম। তার মধ্যে একটা দম দেওয়া ঘড়ি-বাজনা। আর একটা উইণ্ডচাইম্। ওই বাজনাদুটো নাকি পাখিদের রাতে ঘুম পাড়াতে লাগবে। আমি তো হতভম্ব। রিমি ততক্ষণে কণিকা-মণিকার কাছে ঘুম পাড়ানোর ট্রেনিং নিচ্ছে। রোজ রাতে ওদের খাঁচার ওপর তোয়ালে চাপা দিয়ে, ঘর অন্ধকার করে প্রথমে ঘড়ি বাজনায় দম দিয়ে কিছুক্ষণ জলতরঙ্গ বাজাতে হবে। তারপর উইণ্ড-চাইম্ টা ঝুলন্ত অবস্থায় টুং টাং বাজতে থাকবে। মাঝে মাঝে এসে সেটায় দোলা দিয়ে যাবো। ঘরে আর কোনো কথা-বার্ত্তা বা শব্দ নয়। বাজনা শুনতে শুনতে আশুতোষ, শ্যামলী, গগন আর নীলা ঘুমের দেশে চলে যাবে। সে এক অভিজ্ঞতা! ফ্যামিলি রুমে তিনটে খাঁচায় ছ’টা পাখি সর্বক্ষণ তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে। আশুতোষ রাগী চোখে শার্লি চার্লিদের কর্কশ আওয়াজে ধমক দিচ্ছে। উড়ে এসে জুড়ে বসা আর কাকে বলে? ওদের খাঁচা পরিষ্কার করবার ভার আমার বর দীপকের উপর চাপিয়েছি। ওই ঝগড়ুটে পাখিদের খাঁচায় কে হাত ঢোকাবে? শার্লি চার্লি আপন মনে ওদের লক্ষ্য করে।গগন দোল খায়। নীলা ঝিমোয়। আশুতোষ শ্যামলীর ঝটা-পটি লেগেই থাকে। রাতে খেতে বসে দীপক জিজ্ঞেস করল ---“ আচ্ছা মোটা পাখিটার নাম আশুতোষ কেন? পাখিটার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ওর তো একটা সবুজ টাইপের নাম রাখা উচিৎ ছিল।” ---“ ও বাবা! লীনার ধারণা পাখিটা যোগী পুরুষ। প্রথম থেকেই নাকি ধ্যান করার মত স্থির হয়ে বসে থাকত। মেয়ে পাখিটা ওকে উত্যক্ত করে বলে ফ্যামিলি রুমে টিভির সামনে খাঁচা টেনে এনে কাঠঠোকরাদের কার্টুন ‘ উডি উডপ্রেকার’ দেখায়। কিন্তু ওর দুই পাখি চার্লি আর শার্লির কোনোই শিক্ষা হয় না। রিমির দুঃখ আমি ওদের খাঁচা থেকে বেরিয়ে সারা বাড়ি চরতে দিই না। খাঁচার সামনে চপ্সটিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরতি নৃত্য করাইনা। ওরা শুধু কিচিরমিচির করা ছাড়া আর কিছুই শিখবেনা।
June / July 2015 • 61 সারাক্ষণ ঝটাপটি হয়। যোগী আশুতোষ রেগে গিয়ে ঠুকরে দিলেও শ্যামলীর লজ্জা নেই।” দীপক হয়ত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, রিমি পাশে বসে আছে বলে রসালো আলোচনাটা আর এগোল না। প্রথম রাতেই ঘুম পাড়ানো নিয়ে সমস্যা। রিমিকে সাড়ে আটটার মধ্যে দোতলায় শুতে পাঠাই। ও চায় তার আগে ফ্যামিলি রুম অন্ধকার করে লীনার কথামত বাজনা-বাদ্যি বাজিয়ে আশুতোষদের ঘুম পাড়াবে। এদিকে রাত দশটা-সাড়ে দশটা পর্যন্ত আমাদের টিভি চলে। তখন বাড়ীতে কম্পিউটর ছিলনা। টিভিতেই নিউজ, টক শ�ো, সিনেমা দেখি। লীনার পাখিদের জন্য সেটাও বন্ধ করতে হবে? আমাদের শার্লি চার্লি তো দিব্যি জেগে থাকে। রাতে আলো নিভিয়ে খাঁচার ওপর তোয়ালে চাপা দিয়ে ওপরে চলে যাই। একদম বিরক্ত করেনা। এ সব কথা বলতেই রিমি কাঁদতে লাগলো। পাখিগুলো নাকি এমনিতেই কণিকা-মণিকাদের “মিস করছে’। তার ওপর এ বাড়িতে ওরা শুধু রিমিকেই বেশি চেনে। ও যদি আশুতোষদের ‘গুড নাইট’ না করে, ওরা আরো কষ্ট পাবে। শেষ পর্যন্ত দীপক বলল –“ ঠিক আছে, তুমি এইট থার্টির মধ্যে ওদের ঘুম পাড়িয়ে লাইট অফ করে দাও। আমি আর মা তারপর বেসমেন্টে বসে টিভি দেখব।” সাত রাত্তির এই চলল। রিমি নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে চলে গেলে কী হবে, ওদের পাখা ঝটপটানোর শব্দ, ক্যাচক্যাচানি অনেক্ষণ পর্যন্ত শুনতে পেতাম। পরের শনিবার লীনারা এসে অনেক ধন্যবাদ আর ফ্লোরিডার গিফট-টিফট দিয়ে পাখিগুলোকে ফেরত নিয়ে গেল। রিমির মন খারাপ। সে কথা স্বীকার না করে বলল –“শার্লি চার্লি আবার লোনলি হয়ে গেল।” আমি বোঝালাম –“ মোটেই না! ওদের পাখিগুলো একটুও ফ্রেণ্ডলি নয়। দেখিসনি, আশুতোষ কি রকম রেগে রেগে চ্যাঁচাত। খাঁচার মধ্যে না থাকলে হয়ত তোর পাখিদের কামড়েই দিত।” আশুতোষের সেই চণ্ডাল রাগই কাল হল। কিছুদিন পরে শ্যামলীর সঙ্গে মারামারি করে তাকে এমন ঠুকরোল যে,পাখিটা ঘা হয়ে মরে গেল। লীনা পাখি বুকে ধরে ভেটেনারি ডাক্তারের কাছে গিয়েও বাঁচাতে পারল না। লীনার কথায় শ্যামলীর funeral- এর দিন ওদের বাড়ি গেলাম। রিমি তার বেহালার বাক্স নিয়ে গিয়েছে। কবর দেবার সময় করুণ সুর বাজাবে। সবই লীনার নির্দেশ। দীপক বলল ---“ এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে পাখি, মাছ, কুকুর কত কি মরে গিয়েছিল। হ্যাঁ, মন খারাপ হত, তা বলে গান-বাজনা হবে! তোমার বন্ধুর মাথায় ভালো রকম ছিট আছে। সঞ্জয় যে কি ভাবে পুট আপ করে...”। এত কথা বলেও কিন্তু দীপক গম্ভীর মুখে লীনাদের বাগানে গিয়ে বসল। বাইরের লোক বলতে শুধু আমরা তিনজন। তখন বসন্তকাল। গাছে গাছে বুনো পাখিদের কিচিরমিচির। উইলো গাছের পাশে মাটি খুঁড়ে চৌকো মত গর্ত্ত হয়েছে। লীনা একটা ছোটো টিনের বাক্স হাতে ঘাসের ওপর বসে আছে। ভিতরে লাল টুকটুকে কাপড়ে জড়ানো শ্যামলীর ছোট্ট শরীর। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার, তাই সধবার সাজ। বাকী পাখিগুলো বাড়িতে খাঁচার ভিতরে বন্দি। লীনা ওদের এই করুণ দৃশ্য দেখাতে চায় না। আশুতোষ নাকি খুব অনুতপ্ত! শ্যামলী হত্যার পর ঠিকমত দানা-পানিও খাচ্ছে না। দেখলাম বটে, গোদা সবুজ পাখিটা ঘাড় নীচু করে বসে আছে। শ্যামলীর funeral শুরু হল। কণিকা মণিকা হাতে ফুল নিয়ে বসে আছে। রিমি মাথা নীচু করে খানিক্ষণ বেহালা বাজালো। কণিকা মণিকার চোখে জল। লীনা ভাঙা গলায় গাইল “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।” আধখানা গানের পর শ্যামলীকে মাটি চাপা দেওয়ার সময় আমরাও ক’টা ফুল ছড়িয়ে দিলাম। বছরখানেক বাদে সঞ্জয় লীনারা ডেনভার চলে গেল। প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত। ক্রমশ যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এল। ইদানীং নতুন বছরে একটা করে শুধু গ্রিটিংস কার্ড আসে। রিমি, কণিকা, মণিকারা নিজেদের ক্যারিয়র ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ছোটবেলার ঘরগুলো খালি পড়ে থাকে। গ্যারাজে ফেলে রাখা নীল,সবুজ, কমলা রঙের খাঁচা,ঘরে ঘরে এম্পটিনেস সিন্ড্রোম। স্মৃতি বলতে কিছু পুরোন ছবি। রিমি তার ফেসবুকে দিয়েছে। তিনটে পাখি আর ছটা খাঁচার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে তিনকন্যা। ফোকলা দাঁতে হাসছে সাত বছরের রিমি।। অলংকরণ অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায় জনপ্রিয় লেখিকা আলোলিকা মুখোপাধ্যায় দেশ, বর্তমান, আনন্দমেলায় গল্প লিখেছেন। গত বাইশ বছর ধরে বর্তমান পত্রিকায় ‘প্রবাসীর চিঠি’ লিখে চলেছেন , এবং এর প্রথম খন্ডের জন্য পান ‘উৎসব’ পুরস্কার । আলোলিকা মুখোপাধ্যায় নিউ জার্সি র কল্লোল সংগঠনের স্থাপক সদস্য
কাজকন্যে, দুকূল এবং আপনি জবা বসু জকন্যে কম পড়তে পারে। কিন্তু কাজকন্যে? উঁহু কখনওই নয়। অসংখ্য কাজকন্যে চারপাশে। কাজ শুধু তাদের খুঁজে নেওয়া। সেলাম সেই মানুষটিকে যিনি বলেছিলেন, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’ সত্যিই তো আমাদের কাজকন্যেরা শুধুমাত্র রান্নাবাটি খেলে না, চুল বাঁধারও সময় পায়। এক বিনুনি, দুই বিনুনি, কলা বিনুনি, খেজুর চটি, এলো খোঁপা, টপ নট, হর্সটেল আহা! কতরকমভাবেই না চুল বাঁধে তারা। ওদিকে হাঁড়িতে ভাত ফুটছে, কড়াতে মাছের ঝোল। ভাত, মাছের ঝোল বিনে কত্তামশাই আপিস যান না। পোলাপানগুলিও ইস্কুলে দৌড়ায় চাট্টি মাছ-ভাত মুখে দিয়েই। ওদের জন্য টিফিনের বন্দোবস্ত করতে হয় সকাল ৮টার মধ্যেই। দিনের শুরুটা এভাবে হুটোপুটি করে কেটে যায়। একটু দম নিয়ে শুরু হয় আর এক প্রস্থ রান্নাবাটি। এরই ফাঁকে নিজের নাওয়া, খাওয়া, ঠাকুরঘরে গিয়ে সকলের মঙ্গলকামনা, শ্বশুরমশাইকে ওষুধটা সময়মতো খাওয়ানো, শাশুড়িমায়ের দেওয়া বড়িগুলো ছাতে শুকোতে দেওয়া, হাঁসগুলো পুকুরে ছেড়ে আসা সবই চলে একে একে। কিন্তু ওই যে বললাম কেবল হাঁড়িকুড়ি আর শিলনোড়াতে কাজকন্যে তার দিন আটকে রাখে না। এক বিনুনি, দুই বিনুনি, এলো খোঁপাতেও নিজেকে ছড়িয়ে দেয় সে। ছাতে কাপড় মেলতে গেলে মাথার উপরের খোলা আকাশটা বড্ড টানে তাকে। আর যদি বৃষ্টি নামে তো কথা নেই। সব কাজ ফেলে কাজকন্যে তখন বৃষ্টির কারসাজি দেখে। আহা বৃষ্টিরও কত রূপ। ঝিরিঝিরি, ঝমঝম, টাপুরটুপুর, টিপটিপ, ইলশেগুঁড়ি আরও কত কী! শিলাবৃষ্টি নামলে তো আরও একধাপ বেশি উল্লাস। কাজকন্যে তখন খোলা আকাশের নীচে। ভেজা সপসপে কাজকন্যে উপুড় হয়ে শিল কুড়োবে আর মুখে পুরবে। সঙ্গী করবে নিজের পেটে ধরা কন্যেটিকে। মায়ের এমনধারা কাজের সঙ্গী হতে হতে ছোট মেয়েটিও যে একদিন কাজকন্যে হয়ে উঠবে না কে বলতে পারে? ঘরে অমন দাপুটে শাশুড়ি, স্বামী, দেওর থাকা সত্ত্বেও কী সুন্দর করেই না চুলটা বেঁধেছিল কাজকন্যে সুবর্ণলতা। পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চাওয়া বিপ্লবী ছেলেগুলোকে সমর্থন জানাতে এতটুকু পিছপা হয়নি সে। ঘরের বাইরে পা না রাখতে পারলে কী হবে, ঘরের ছোট্ট জানলাটার খড়খড়ি ফাঁক করে সুবর্ণ বিপ্লবীদের দিকে সহমতের হাত প্রসারিত করেছিল। নিজের কন্যাসন্তানটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে ঘরের ভেতরেই করেছিল নারীশিক্ষার ভিত্তিস্থাপন। আর সুবর্ণলতা চরিত্রটি যাঁর কলমে জীবন পেয়েছে তিনি নিজেও যে একজন কাজকন্যে সেকথা কে না জানে? সংসার, স্বামী, সন্তান সামলে অসাধারণ সব গল্প, উপন্যাস আমাদের জন্য লিখেছেন কাজকন্যে আশাপূর্ণা দেবী। সে সব উপন্যাস ও তার চরিত্ররা উৎসাহ জুগিয়েছে আরও অনেক কাজকন্যেকে। সংসারী মানুষ ঘুম থেকে উঠেই মুখে একটা মুখোশ পরে নেয়। তারপর দিনভর সংসার নামক রঙ্গমঞ্চে চলে তার নানাবিধ ভূমিকা পালন। এমন অমোঘ সত্যটি কী সুন্দরভাবেই না বর্ণনা করেছিল তাঁর কলম। দাপুটে-অদাপুটে, হিংস্র-কোমল, ভালো-মন্দ সব পুরুষেরই সূত্রপাত নারীগর্ভে, এমন কথাও আমি প্রথম শুনেছিলাম এই কাজকন্যের কাছে। পুরুষকে গর্ভে ধারণ এবং জন্মদানের মতো কাজটি করে থাকে একজন কাজকন্যেই। তবুও কেন যে রা প্রবন্ধ 62 • June / July 2015
কন্যাভ্রুণ দেখলেই সমাজের হাত নিশপিশ করে তাকে হত্যার জন্য কে জানে। কন্যেই যদি ভ্যানিশ হয়ে যায় পুত্র জন্মাবে কীভাবে, এই সারসত্য কি সমাজ বোঝে না? কাজকন্যেই সব অবস্থাতেই ছিল, আছে, থাকবে। কন্যের বারদুয়ার পেরোনোর অনুমতি থাকুক বা না থাকুক। পথে পা না রাখলে কী হবে ঘরের ভেতরেই সে নিজের মতো করে চুল বাঁধে। যেমন বেঁধেছিল সুবর্ণ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সেই কন্যেটির কথা যে ১৬ বছরের সংসার ও ভিটেমাটি ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে একবস্ত্রে পূর্ববঙ্গ থেকে এই বঙ্গে এসে পা রেখেছিল। সঙ্গে ছিল ছ’ ছটি পেটের সন্তান। আসার আগে হাতে পেয়েছিল মাত্র একটি ঘণ্টা সময়। কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি গোছানোর সময় ছিল না। নিজের এবং স্বামী, সন্তানের প্রাণটুকু ছাড়া আর কিছু নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আসার সময় চোখে পড়েছিল রক্তমাখা রেলের বগি আর প্রিয়জন হারানোর হাহাকার। কন্যে কিন্তু হেরে যায়নি। বহু ঝড়ঝাপটা সামলে আবার পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়েছিল। তবে তা এই বঙ্গে। মুছে ফেলতে পেরেছিল গায়ে লটকে থাকা ‘রিফিউজি’ শব্দটি। প্রতিটি সন্তানকে জুগিয়েছিলেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি। নিঃসন্দেহে নিজের সংসারে এই কন্যে একজন কাজকন্যে। তবে এর বাইরেও কন্যেকে দেখেছি আরও একটু কাজ করতে। বাড়ির রান্নামাসির দুই ছেলে কমল আর কাজল নতুন ক্লাসে ওঠার পর প্রতিবার গ্রামের বাড়ি থেকে কলকাতা আসত তাদের মায়ের কাছে। আমার চেনা কন্যে ওদের দু’জনকে পড়ার বই, খাতা, কলম প্রতিবছর কিনে দিত। আর পুজোর সময় কেনা হত ওদের জন্য একপ্রস্থ নতুন শার্ট, প্যান্ট। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই কন্যে কাজটুকু সারত। এমন কাজ হয়তো আরও অনেকে করেন। তবু জগদ্ধাত্রী মায়ের এমনতর কাজ আমায় বড় আনন্দ দিত। যুগ পালটেছে। তাল মিলিয়ে বদলেছে সময়। বারদুয়ারের কাঁটাতার গেছে সরে। কন্যে এখন ঘরে বাইরে। বদলেছে তার চলন, বলন। কয়লা, ঘুঁটের উনুন, শিলনোড়া পেরিয়ে সে এখন হটপ্লেট, মাইক্রোওয়েভ, মিক্সি, ব্লেন্ডারের জগতে। বরের জন্য, নিজের জন্য স্মার্ট ব্রেকফাস্ট, ছেলেমেয়ের হেলদি টিফিন সক্কাল সক্কাল তাকে বানিয়ে ফেলতে হয়। কোনও কোনও কন্যে একসঙ্গে বরকে পাশে পায়। দু’জনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে গৃহস্থালি। তারপর ছুটতে হয় কর্মস্থলে। অফিস ক্যাব সকলের জোটে না। বেশিরভাগই বাস, ট্রাম, মেট্রো নির্ভর। সন্তানের লেখাপড়া, নাচ, গান, আঁকা, সাঁতার সবই কন্যে সামলায় একে একে। বাজারহাট, অন্যায্য সাংসারিক কেনাকাটাও করে আজকের কন্যে। চার দেওয়ালের ভিতর সংসার সামলাতে হয়তো নানা আরামদায়ক গ্যাজেট এখন কন্যের হাতের কাছে। সময় সাশ্রয় হয়েছে কিঞ্চিৎ। কিন্তু সেই সময়টুকুতে গা এলানোর ফুরসত মিলল কই? বাড়ির বাইরে পা রাখার অনুমতি মেলার পর কন্যে এখন বাইরের কাজও কাঁধে তুলে নিয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রাম, মফস্বলের কন্যে অনেক আগেই বাড়ির বাইরে পা রেখেছিল। শহুরে কন্যের যেদিন বাড়ির বাইরে কাজের অনুমতি মিলল তার অনেক আগে থেকেই নয়নচাঁপারা ফার্স্ট লোকাল ধরে লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে শিয়ালদা এসে পৌঁছোয় বাবুর বাড়ি বাসন মাজবে বলে। আর যে কন্যেটি ফার্স্ট লোকাল প্রবন্ধ June / July 2015 • 63
ধরে না সে তখন ঘরের গাই-বাছুর সামলায়। ভরদুপুরে এক আকাশ রোদ্দুর মাথায় নিয়ে মাঠপানে দৌড়োয়। হাতে থাকে বরের জন্য গামছা ঢাকা লাঞ্চ। সেদিন খুঁজে পেলাম পাঞ্জাবের এক মেঠো কাজকন্যেকে যে বরকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য, দুটো পয়সা সাশ্রয়ের জন্য দিনে দু’ঘণ্টা নিজে খেতে ট্র্যাক্টর চালায়। আসলে তুমি সুখে রাখো কিংবা দুঃখে, কাজকন্যে তার কাজটুকু করবেই করবে। কী দরকার ছিল মেধা পাটেকর, কিরণ মজুমদার শ, সনিয়া গান্ধি, শেখ হাসিনা, হিলারি ক্লিন্টন, মহাশ্বেতা দেবী, হাবিবা সরাবি, মালালা ইউসুফজাই, বাচেন্দ্রি পাল, অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো আরও অনেক বিখ্যাত কন্যের নিজেকে কাজকন্যে হিসেবে এগিয়ে নিয়ে আসার? চোখের সামনে প্রিয়জনের বীভৎস মৃত্যু দেখেও সনিয়া, হাসিনারা দুয়ার আটকে বসে থাকেনি। পথে নেমেছে প্রিয়জনের রেখে যাওয়া কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। হিলারি ক্লিন্টনের কথা ভাবুন। ওয়েলেসলি কলেজে পড়ার সময় কলেজে আরও বেশি ব্ল্যাক স্টুডেন্ট নিয়োগ এবং ফ্যাকাল্টিতে আরও বেশি ব্ল্যাক নিয়োগ করার আন্দোলন? সে তো নাও করতে পারত। পরবর্তীকালেও কেবল ওকালতি পেশাতে নিজেকে আটকে না রেখে বারে বারেই মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছেন এই একদা মার্কিন ফার্স্ট লেডি। অনেকে বলবেন, এঁরা ক্ষমতালোভী নারী। সত্যিই কি তাই? বোধহয় না। ক্ষমতা হাতে পেয়ে তা ব্যবহার করার ক্ষমতা কি সকলের থাকে? কাজকন্যের সে ক্ষমতা থাকে। আফগানিস্তানের কন্যে হাবিবা সারাবি বামিয়ান প্রদেশের গভর্নরের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর চুপ করে বসে থাকেনি। নারীশিক্ষাবিরোধী আফগানিস্তানে নারীকে শিক্ষিত ও কর্মসুযোগ করে দেওয়ার কাজে উঠে পড়ে লেগেছিল। সেখানকার পুলিশবাহিনীতে মহিলা পুলিশ নিয়োগ এবং অর্ধেকের বেশি শিশুকন্যাকে স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দেয় হাবিবা। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার অনেক আগে থেকেই আফগানিস্তানের মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার কাজে এগিয়ে এসেছিল এই কাজকন্যে। পাকিস্তানে আফগান রিফিউজি মহিলাদের শিক্ষাদানে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার। মজার ব্যাপার হল এই কাজকন্যেকে পড়াশুনো থেকে শতহাত দূরে রাখতে চেয়েছিলেন কন্যের বাবা। হাবিবার পথেরই পথিক ১২ জুলাই ১৯৯৭-এ জন্মানো ছোট্ট মেয়ে মালালা ইউসুফজাই। কাজ করতে গিয়ে মাথায় গুলি লাগল তো বয়েই গেল। কাজকন্যে থোড়াই কেয়ার করে ওই সব গুলি-টুলি। আরও এক কাজকন্যের কাণ্ডটা দেখুন। টাটা ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ (TISS) থেকে এমএ পাশ করার পর পিএইচডি শুরু করেও মাঝপথেও পড়াশুনো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাতের অসহায় আদিবাসী এবং কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো, পিএইচডি কমপ্লিট করার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল তার। তাই ১৯৮৯ সালে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজকন্যে মেধা পাটেকর গড়ে তুলেছিল ভারতবর্ষের সবথেকে বড় আন্দোলন ‘নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন’। আর এক কাজকন্যে অবশ্য মাঝপথে পড়াশুনো ছাড়েনি। বরং বেশ মনে দিয়েই সেটি করেছিল। তারপর চাকরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু পছন্দসই চাকরি কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না। অগত্যা মাত্র ১০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে বিজনেস এন্টারপ্রেনার হিসেবে কেরিয়ার শুরু করল। জাস্ট একটা বায়োটেক কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পাইওনিয়ারিং কনসেপ্ট ছাড়া সেদিন কিরণ মজুমদার শ-এর কাছে আর কিছুই ছিল না। বায়োকন প্রতিষ্ঠার পর সাফল্য এসেছে। কিন্তু থেমে থাকেনি কন্যে। তার ভাষায়, ‘সাকসেস ব্রিডস সাকসেস’। একটি সাফল্য জন্ম দেয় আরেকটি সাফল্যের। কাজকন্যে কিরণ মজুমদার শ এভাবেই এগিয়ে চলেছে। প্রতিটি সাকসেসের পিছনে রয়েছে ডিটারমিনেশন। আসলে ডিটারমিনেশন আর স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা সর্বক্ষণ কাজকন্যেকে তাড়া করে বেড়ায়। ঠিক এরকমভাবেই স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াত পাহাড়ি মেয়েটিকেও। বাড়িতে চরম দারিদ্র্য থাকলে কী হবে মাঝে মাঝেই প্লেনে চড়ার স্বপ্ন দেখত সে। নিজেকে অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবলভাবে কাজ করত তার মধ্যে। স্বপ্ন দেখত সুদৃশ্য গাড়ি চড়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওঠাবসা করছে সমাজের বিখ্যাত মানুষজনের সঙ্গে। প্রায়ই দেখতে পেত রুকস্যাক পিঠে বিদেশি ছেলেমেয়ের দল গ্রামের পথে হেঁটে যাচ্ছে। জেনেছিল ওরা মাউন্টেনিয়র। মাউন্টেনিয়রিং-এ পুরুষের আধিপত্য কন্যের চোখ এড়ায়নি। তাই সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল, ‘যে কাজে পুরুষের একাধিপত্য, আমি শুধু সে কাজ করবই না, আরও ভালো করে তা করব।’ একদিন সত্যিই তেমন কাজ করে দেখাল কন্যে। ২৩ মে ১৯৮৪, প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে পা রাখল কাজকন্যে বাচেন্দ্রি পাল। এভারেস্ট থেকে নামার পর এই কাজকন্যে এখন আরও অনেক কাজকন্যেকে এভারেস্টে পাঠানোর কাজে মগ্ন। একটি দেশের মর্যাদা নির্ভর করে দেশটির মেয়েদের পারফরম্যান্সের ওপর---এমনটিই মনে করে আমাদের এই কাজকন্যে। পাহাড় চড়ার কাজে বাচেন্দ্রি নিজের বাবাকে কখনওই পাশে পায়নি। বাবা একাজে বরং এগিয়ে দিতেন নিজের দুই পুত্রসন্তানকে। কখনওই বাচেন্দ্রিকে নয়। ওদিকে বাংলার কন্যা ছন্দা গায়েনকে এভারেস্টে পা রাখার উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তার বাবা। আচমকা বাবার মৃত্যু সংসারে বিপদ ডেকে আনে। দিশাহারা ছন্দা টিউশন করে সেই অভাব কিছুটা সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। তাই হাওড়ায় নিজের বাড়িতেই আমূলের দুধ, দই, মাখনের দোকান দেয়। এতকিছু সত্ত্বেও এভারেস্ট জয়ের ভূতটিকে কখনওই মাথা থেকে বিদায় করেনি ছন্দা। ১৮ মে ২০১৩ সকাল ৭টায় এভারেস্টে উঠে পড়ে এই কাজকন্যে। নেমেও এসেছিল শৃঙ্গজয় করে। চেয়েছিল আরও অনেক কন্যেকে এভারেস্টে পাঠানোর প্রশিক্ষণ দিতে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আরও একটি অভিযানে গিয়ে পাহাড়ের কোন কোলে যে শুয়ে রইল এই পাহাড়কন্যে থুড়ি কাজকন্যে আজও তার হদিশ মিলল না। যশ, প্রতিপত্তি, খ্যাতির শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও কাজকন্যে মাটির কাছাকাছি বাস করতেই ভালোবাসে। ১৯২৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছিল কল্লোল যুগের লেখক মনীশ ঘটক ও তাঁর লেখিকা স্ত্রী ধরিত্রী ঘটকের কন্যাসন্তানটি। স্কুলজীবন ঢাকাতেই। তারপর বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এমএ পাশ করল সেই কন্যে। বাবা-মায়ের ধারা কন্যের মধ্যেও বর্তেছিল। কলম যেন কথা বলে 64 • June / July 2015
তার। নটী, অরণ্যের অধিকার, হাজার চুরাশির মা, তিতুমির, আশমানের আয়না, স্তন্যদায়িনী, যাবজ্জীবন এবং আরও অনেক অনেক অবাক করা উপন্যাস কন্যে লিখল। পদ্মশ্রী, সাহিত্য আকাদেমি, জ্ঞানপীঠ, ম্যাগসাসে ইত্যাদি পুরস্কার সেই কবেই ঝুলিতে ঢুকে পড়েছে তার। তবে শুধুই কলম চালিয়ে তাঁর কাজ সারেননি কাজকন্যে মহাশ্বেতা। আমাদের সকলের প্রিয় মহাশ্বেতা দেবী। দুকূল পত্রিকার অন্যতম উপদেষ্টা। গরিবের দৈন্য, দুর্দশাকে বিপণন করে এগোতে চাননি তিনি। নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে। একাত্মতা অনুভব করেছেন লোধা, শবরদের সঙ্গে। গড়ে তুলেছেন ‘আদি জাতি ঐক্য পরিষদ’। শবরদের দিয়ে কাশফুল, ঘাস, জংলি খেজুরপাতা ইত্যাদির টুকরি, ঝুড়ি, বাঁশি বানিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন শবরমেলার। বছর দুয়েক আগে একবার কন্যের বাড়িতে গেছিলাম। সেখানে দেখেছি তাঁর লেখার টেবিলের পাশে ছোট একটি খাটে শুয়ে রয়েছে অসুস্থ শবর মা এবং সেই মায়ের ছোট্ট শিশুটি আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছে ঘরময়। কী দরকার ছিল এই কন্যের প্রান্তিক মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোর? গল্প-উপন্যাস লিখে তো যথেষ্ট খ্যাতি মিলেছিল। আসলে ওই যে বললাম, নিজেকে যতক্ষণ না অন্যের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন ততক্ষণ শান্তি নেই কাজকন্যের। নেই বেঁচে থাকার আনন্দ। বেঁচে থাকার প্রসঙ্গ যখন উঠল তখন আরও এক কাজকন্যের কথা না বলে পারছি না। নাম তার অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী। জীবন শুরুর প্রথমদিকে এতটুকু বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিল না এই কন্যের। অবসাদ এতটাই গ্রাস করেছিল, দু’দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল। অথচ অবাক কাণ্ড, কন্যে আজ তীব্রভাবে বাঁচতে চায়। শরীরে ক্যান্সার ঘাঁটি গাড়তে পারে এমন সিঁদুরে মেঘ দেখে নিজের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ শরীর থেকে বাদ দিল। বিশেষ করে এমন দুটি অঙ্গ, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নারীত্ব। প্রিম্যাচিওর মেনোপজ ডেকে আনতেও পিছুপা হল না সে। কন্যের এমনধারা কাজ অনেকের হাস্যকর মনে হয়েছে। কত না চটুল মন্তব্য শুনতে হয়েছে তাকে। কন্যে অবশ্য এসবে ঘাবড়ায়নি। কেননা এই মুহূর্তে সে প্রকৃতই একজন কাজকন্যে। প্রাচুর্য এবং ভোগবিলাসিতায় ডুবে না থেকে UNHCR–এর অ্যাম্বাসাডর হিসেবে সে এখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে ব্যস্ত। নিজের জন্য নয়, মানুষের জন্য তাকে তো বেঁচে থাকতেই হবে। আমি নিশ্চিত জোলি আর কোনওদিনও আত্মহত্যার পথে পা বাড়াবে না। কাজকন্যেরা আত্মহত্যা করে না। নিন্দে- মন্দ শিকেয় তুলে আসুন না আমরা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি নামক কাজকন্যেটির বেঁচে থাকার এমন প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করি। এভাবেই তো রাজকন্যে একদিন কাজকন্যে হয়ে ওঠে। এ তো গেল রাজকন্যেদের কাজকন্যে হয়ে ওঠার গল্প। কিন্তু রাজ্যপাটশূন্য কাজকন্যেদের কী হবে? তাদের গল্প কি কেউ বলবে না? হ্যাঁ, তাদের গল্প শ�োনাবে দুকূল। আসলে দুকূল-এর এডিটর-ইন-চিফ নিজেও একজন কাজকন্যে। এক বঙ্গললনার সুদূর মার্কিন মূলুকে বসে একূল, ওকূল দুকূলকে একটি পত্রিকায় একাকার করে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এ প্রসঙ্গে আপনাদের সঙ্গে চুপিচুপি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আজ থেকে প্রায় বছর চৌত্রিশ আগে কলেজ থেকে ফিরছিলাম আমি আর শর্বরী (বর্তমান এডিটর-ইন-চিফ)। খিদেতে আমার পেট চুঁইচুঁই করছে। ভাবছি বাড়ি ফিরে কখন কিছু খাব। শর্বরীকে সেকথা বলতেই ও বলেছিল, ‘জানিস জবা, আমার না খিদে পায় না।’ ভারী অবাক হয়েছিলাম ওর কথায়। আসলে সেদিন বুঝিনি শর্বরীর খিদেটা ঠিক ভাত-ডালের জন্য নয়। ওর ছিল অন্য খিদে। কিছু একটা পছন্দসই কাজ করার খিদে। দুকূল সেই পছন্দসই কাজ। ইতিমধ্যে দুকূল কয়েকজন কাজকন্যের গল্প আপনাদের শুনিয়েছে। বাকি আছে আরও অনেক কাজকন্যের গল্প। টিউশনের টাকা জমিয়ে খুনের মিথ্যে অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত বাবাকে জেল থেকে ফিরিয়ে আনা, রাস্তায় পড়ে থাকা আহত পশুপাখিকে নিজের বাড়িতে এনে শুশ্রূষা, সুন্দরবনের আয়লায় সর্বসান্ত হওয়া মানুষগুলোকে বাঁচানোর জন্য বনবিবির পালাদল গড়ে তোলা, কমিউনিজমের আদর্শ বুকে আঁকড়ে ধরে খাদান শিল্পীদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া কিংবা দমদম স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের এককোনায় ভিখারি শিশুগুলিকে লেখাপড়া শেখানো এমন অজস্র কাজকন্যের গল্প এখনও বলা বাকি। না জানি আরও কত কাজকন্যে রয়েছে আশপাশে। এতটা নীরবে তারা কাজ সারছে যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কোনওরকম প্রচারের মুখাপেক্ষী এরা নয়। শুধুমাত্র নিজের প্যাশন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আপনভোলা এসব কাজকন্যে শত অসুবিধে হলেও মুখ ফুটে সেকথা কাউকে জানাবে না। ওদের মুখ না ফুটলেও আমরা কি মুখ বুজে থাকব? বুকে হাত রেখে বলুন তো, আপনার কি কখনও ইচ্ছে হয় না একজন কাজকন্যে হয়ে উঠতে? ইচ্ছে হয় নাকি অন্যের জন্য অমন কোনও কাজ করতে? সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছে থাকলেও হয়তো সবসময় অমনধারা কাজ করে ওঠা সম্ভব হয় না। না-ই বা হতে পারলাম কাজকন্যে। কিন্তু কাজকন্যের কাজের ভাগীদার তো হয়ে উঠতে পারি? সামান্য বুদ্ধি, পরামর্শ, ভালোবাসা বা প্রয়োজন মনে করলে আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে আমরা তো খুব সহজেই কাজকন্যেদের পাশে থাকতে পারি। রাজ্যপাটহীন এসব কাজকন্যে এবং আপনাদের মাঝে দুকূল মাধ্যম হিসেবে কাজ শুরু করেছে। এবার ‘কাজকন্যে’কে আপনি কতদূর ‘নিজের কন্যে’ ভাববেন সেটি আপনার বিবেচনার বিষয়। শেষ করব আমাদের সকলের প্রিয় কাজকন্যেকে স্মরণ করে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মৃত্যুশয্যায় সহধর্মিনীকে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য কতগুলো দামাল সন্তান রেখে গেলাম।’ সেই দামাল সন্তানেরা পরবর্তীকালে বেলুড়ে প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান, যার শাখা আজ পৃথিবীব্যপী ছড়িয়ে আছে। দামালদের দিয়ে এই কাজটি যিনি করিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং ঠাকুরপত্নী কাজকন্যে শ্রীমা সারদাদেবী। জবা বসু কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। দুকূল পত্রিকায় তিনি কাজকন্যের কথা সিরিজের মাধ্যমে কৃতী মহিলাদের সামনে তুলে এনেছেন। June / July 2015 • 65
ও কলেূ র কবিতা একটা সকালবেলায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম ক্লাস ফাইভে পড়া একটা ফুটফুটে ছেলে এসে আমাকে বলল, এই নাও একটা বল আমাকে আউট করো আমি তার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম আমি তার এক মাথা চুল নেড়ে দিয়ে বললাম আমি তোমাকে একটা বল করতে পারি কিন্তু আউট করতে পারি না। কতটুকু ক্রিকেট আমি পারি? ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হওয়ার পর অনেকে বলেছিলেন, এ কি পারবে? এ কি ক্রিকেটটা জানে? আমি তখন একটা জিনিস ভেবেছিলাম আমার মাথায় একশ কেজির ওজন সেই একশ কেজির ওপরে কেউ যদি একটা পাহাড় চাপিয়ে দেয় ইট ডাজন্ট মেক এনি ডিফারেন্স। সবাই একরকমভাবে দাঁড়ায় না সবাই একরকম ভাবে মারে না সবাই একরকমভাবে ঝুঁকি নেয় না সবাই একরকমভাবে মাঠে ঢোকে না একরকমভাবে মাঠ ছেড়ে যায় না। খেলা ছেড়ে যাওয়াটাও একটা বড় খেলা আমার জিভ আর আমার স্ত্রীর জিভ এক নয় আমার স্ত্রী আমাকে মাছ খেতে বলে কিন্তু আমি মাছ খেতে পারি না। ক্রিকেটেও একরকম মাছ আছে সেটা আমি খেতে পারি না। পাবলিক আর প্রাইভেট দুটোই জরুরী আমি দুটোকেই ভালবাসি আমি আমার স্ত্রীকে গভীরতম মুহূর্তে বলেছিলাম তুমি হলে থার্ড ইম্পরট্যান্ট থিং ইন মাই লাইফ প্রথমে আমার দেশ দ্বিতীয় আমার বাবা মা তৃতীয় তুমি। আমি তাকে ধাপ্পা দিইনি সেটা সে জানে। মোপাসার গল্পে পড়েছিলাম মেয়েটা ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করেছিল কাকে তুমি সবচেয়ে ভালবাস ? ছেলেটা মেয়েটাকে বলেছিল – তোমাকে কী দরকার ছিল বলার? মেয়েটা মজা করে বলল, তাহলে যাও তোমার মা’কে খুন করে তার হৃদপিণ্ড নিয়ে এসো। ছেলেটা সেটাও করেছিল, কিন্তু হাতে গরম হৃদপিণ্ড নিয়ে দৌড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল হাত থেকে ছিটকে পড়ল হৃদপিন্ড ধুলো থেকে যখন তুলতে গেল হৃদপিন্ডের ভেতর থেকে মা বলে উঠলেন খোকা তোর লাগে নি তো ? আমি এম এস ধোনি, কতট ুকু ক্রিকেট বুঝি? সুবোধ সরকার আমি সাংবাদিকদের বলি আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন , সেটা আপনাদের প্রেরোগেটিভ তব আমি উত্তর দেব কি না সেটাও আমার হিউম্যান রাইট। কী করলে করাচির খেলাটা হারতাম না সিডনির খেলাটা হারতাম না সেটা আমি ভাবি না আমি সেদিন জিততে পারিনি এটা আমি শান্তভাবে নিই এত চ্যাঁচানোর কী আছে? আমি যেদিন মারা যাব সেদিন আমি মারা যাব আকাশে মারা যাব জলে মারা যাব বালিতে মুখ ডুবিয়ে মারা যাব ভেবে কি হবে? মারা যাবার পর যা আকাশ তাই বালি তাই জল। মৃত্যুর কোনও সুন্দর রাস্তা নেই। নো বেটার ওয়ে টু ডাই । একটা ব্রেকফাস্ট থেকে আর একটা ডিনার মাঝখানে জীবনটা অনেক বড় একটা সকাল, একটা দুপুর একটা মধ্যাহ্ন, একটা অপরাহ্ন, একটা বিকেল, একটা গোধূলি বিশ্বাস করুন আমি ব্রেকফাস্ট আর ডিনারের মাঝখানে ভালবাসা ও কন্ডোমের মাঝখানে বৃষ্টি ও ডেলাইটের মাঝখানে বিষণ্ণতা ও ঊল্লাসের মাঝখানে ডাকোয়ার্থ-লুইস নিয়মটা জানিনা আমি তাকিয়ে থাকি আম্পায়ারের আঙুলের দিকে আমি তার ভুলটাকেও সম্মান করি। সোভিয়েট ভুল করে, বার্লিন ওয়াল ভুল করে মহাচীন ভুল করে, আমেরিকা-ইরাক ভুল করে পার্লামেন্ট ভুল করে আর একজন আম্পায়ার ভুল করতে পারে না? ক্রিকেট এবং জীবন আমাকে একটাই কথা বলেছিল সকালে সমস্ত খারাপ ভুলের মধ্যে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকাটাই হল মানুষের আসল ইতিহাস। সুবোধ সরকার- বিশিষ্ট কবি, অধ্যাপক। এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা উনত্রিশ। সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে সুবোধ ভার্সাস সুবোধ, মেয়েদের টয়লেটে কী করছিলাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গভূষণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি, বাংলাদেশ কবি সংসদের নজরুল পুরস্কার। 66 • June / July 2015
June / July 2015 • 67 আমি খেলতে ভালোবাসি। মা রোজ অফিস চলে গেলে কালো, কাকুমতো ছেলে, ফ্ল্যাটে মাসির কাছে আসে। ওরা গল্পসল্প করে। যখন মাসিও ঘুম যায়, ও ঠিক দৌড়ে আসে কাছে, হাত বাড়িয়ে ডাকে, ‘আয়!’ আমরা খেলা-টেলা করি। মাকে একদম বলি না- যদি রাগ হয়, ভয় পায়! আজও কাকুটা এসেছিল। মাসি চুল আঁচড়ে দিল। নাকি বেড়াতে নিয়ে যাবে। কতরকম মজা হবে! কই, খেলনা, পুতুল কই? আরও অনেক কাকু মিলে আমায় ব্যথা দিচ্ছে খুব। মাসি এই তো পাশে ছিল, আর, সূর্য ডোবার শেষে, সে-ও কোথায় দিল ডুব! আমি চিনেছি এইবার, এরা রাক্ষস-খোক্কশ! এখন মা এসে পড়লেইনা, না, আমাকে বকবে না, সবই, সবটা কাকুর দোষ! যেমন, মিথ্যে রেগে গিয়ে নতুন বার্বি ডলের হাত জোরে মুচড়ে দিয়েছি- অমন, আমাকে নিয়েও বুঝি খেলতে লেগেছে। আমার কান্না নিভে গেলে, চোখ আঁধার হয়ে এলে, ওরা মানুষ তো নয় কেউ! তাই গাছে মিশেছে নার্সারি রাইম চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ও কলেূ র কবিতা গ্রীষ্ম আলস্য আসে শরীরে গাছের যেমন ঘুম পায় অসময়ে পা গড়িয়ে নামে পিঁপড়ের সারি, রেশ টেনে চলে যায় বুকের আচলে মেয়ে পোড়া গোধূলির উড়ন্ত লাল জামা বর্ষা যারা গান ভুলে যায় একদিন শুধু ছিপ ফেলে বসে থেকে, তাদের ঘিরেও গুনগুন করে আলো, জাল জোনাকি জাগায় বাবুইএর বাসাটিকে তারা খোঁজে আলজমি শরৎ পুরাণের দোর খুলে আসমানি বর্ষণ মা-র কোলে এল ধর্ষণজাত শিশু সাদা শাড়ি পরা হরিণেরা নার্সিং ডিউটি রাতের শেষে গ্রীবা ছড়িয়েছে দু চোখের মুক্তিতে হেমন্ত ট্রেনের লাইনও এরকম বয়ে চলে একটা ঝাপট থেকে আরেকটা ঝাপটায় দীঘা কোরাপুট বৈশালী দৃশ্যেরা শুধু সেলফি তোলার ছাপ গায়ে উড়ে যাওয়া, বুক তেতো শীত ঘুরে ঘুরে নামা পিঁপড়েরা প্রতি শীতে বুঝেছে জীবন, খেলা করা ভুখ নিয়ে। রোদ ভাঙা শার্সিতে আছড়ে ফিরেছে ক্লাসরুম বুকনিও, চোখ বুজে থাকে বই বসন্ত শিমূল পলাশ মহুল নেচেছে বলে হাওয়া জল মাটি জমি মেলায় মেলায়, চা গরম মুমফলি সুখে স্বেদে শ�োকে অভিমানে সংগমে তাপিত শরীর বলে, আমি থাকব না? থাকবই কবি, পেশায় অধ্যাপক। সম্পতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অফুরন্ত নুরজাহান, মনোহর বেতাসের চোখ। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও সুকান্ত পুরস্কার। ঋতুবাহার সুতপা সেনগুপ্ত পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। শক্তিশালী কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিত। বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি সম্মাননা পেয়েছেন।
68 • June / July 2015 বাড়িঘর সিরিজ যশ�োধরা রায়চৌধুরী তোমার পুঁটলির মধ্যে এঁটে যায় সমস্ত পৃথিবী। কিছুই জানি না আমি। কিছুই জানিনি। কীভাবে যে... অথচ কী ইলাস্টিক, অথচ কত না ধরে যাবে। যত পুরবে, যত ভরবে, যত নেবে ভেতরে কাছিয়ে তোমার পুঁটলিটি ফুলবে, এঁটে যাবে পরমা প্রকৃতি। নিঃসীম যে অন্ধকার। সে আকাশ ছাতে ছাতে বাঁধা। ফুলে উঠে বেলুনের মতো যায় বাড়িটিকে নিয়ে। পরে নেমে আসে বাড়ি, মূলদেশে, শিকড়ের টানে অনুভব করি তার মায়াভার, কতখানি ভারী মাধ্যাকর্ষণ! তুমি কত না বিপদ ঘিরে ঘিরে মুক্তোর মতন গড়ো নিজ লালা দিয়ে এ বলয়। বেদনা মধ্যেই থাকে, বেদনার এই এক বাসা। এই সঙ্কটে তাকে চেনা যায়, বস্তু দিয়ে ঠাসা। এতটা জিনিস তবে কীভাবে এঁটেছে অনুভবে? ভুলে যাওয়া ফিরে পাওয়া ভুলে যাওয়া ফিরে পাওয়াগুলি? এই সব অন্ধকার প্রথমত ওপরের দিকে তুলে দেবে এই সব জিনিসের ভার, যা যা, নীচে টেনে নেবে। ২ বাড়িঘর, মূলমন্ত্র। অবচেতনের থেকে আসা। কতটা আকাশ ধরে এই বাড়িঘরে, জবুথবু এই ঘর, এ প্যাকেজ, এইসব প্যাকিং বাক্সেরা আমাদের এই এই নিচু নিচু দরজা জানালা। আলপিন থেকে আমি হাতি অবধি সকলই রেখেছি। তোমার রাখার শিল্পে আমি কিন্তু কখনও থাকিনি আমি সেই ফাঁসিযোদ্ধা, আমি সেই হাসিকান্না ঠাসা তোমার বিকৃতিমধ্যে কৃমি হয়ে থেকে রয়ে গেছি ৩ কাঁচা, দগদগে সব অসহ্য কঠোর অনুভব রহস্য রোমাঞ্চময় খাতাপত্র, অনুপুঙ্খ বাঁচা জং ধরা তালা দেওয়া কালো সিন্দুকের ভরা ঘর। ছেঁড়া ছেঁড়া পোকাধরা অসংখ্য বিদায়প্রস্তাব। দেওয়াল আলমারি শুদ্ধু বইপত্র উইপোকাঢাকা বাদামি বল্কল সহ যাবতীয় অনুরাগী রোদ বেদম ঘড়ির বুকে টিকটিকবিহীন কাঁটাগুলি প্রতিটি আলাপ থেকে খসে পড়ে যাওয়া শুকনো ফুল। এই সব, এই সব, জড়ো করে আগুনে দিয়েছ যে আগুন ধরে রাখা আছে এই বাড়ির ভেতরে যেইমাত্র বাড়ি থেকে কেড়ে নিয়ে বিচ্ছিন্ন করেছ যেন শিশু, মাতৃক্রোড় থেকে কাড়া। ট্যাঁ ট্যাঁ কেঁদে ওঠে বাড়িঘর থেকে আজ বাড়িঘর বিচ্ছিন্ন হয়েছে। অমল হৃদয়ে সব ধরা আছে, কালো করে লেখা কাজলের দাগ থেকে অশ্রুজল আলাদা হবে না। সে অক্ষর এ মুহূর্তে অজড় অমর হয়ে গেছে। কবি যশ�োধরা রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও বিশেষ রচনা সমানভাবে পাঠকের কাছে আদৃত। পেশাগতভাবে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক।
June / July 2015 • 69 একটা কিছু ধরব বলে দৌড়েছিলাম। বাস কিম্বা পাখির পালক, মুহূর্তকাল… এখন আমার ঠিক মনে নেই কোন অছিলা। এখন আমার ঠিক মনে নেই, তোমার মুখে কোন সকালে ঝাপটেছিল আয়না পোকা… কেবল জানি, সময় তাকে দেয়নি রুখে। সময় তো কোন অন্ধকারের বন্ধুপ্রাচীন আমার মুঠোয় আটকে আছে, এই যে বালি – তোমার কোনও সমুদ্রে খুব কাছেই আছি। ঢেউ সেখানে সাঁতার শেখায়, জল সেখানে তোমার হাতের রেখায় রেখায় অন্তরালই কেউ তো নাবিক, ভাঙা জাহাজ জুড়তে জানে ! আমিই এখন সেই নাবিকের নাম-ভূমিকায় বাড়ালে হাত সময় পেরোই হাওয়ার মতো… অন্ধকারের সামনে তখন কী আসে যায় ? আসবে তবে ? এক ঠিকানার বাসিন্দা হই ? আসবে তবে ? এক জোছনায় সারাই ক্ষত ? সময় সরল বালির মতো, সেও তো জানোই । এখন মুঠোয় নীল বাতিঘর, নেমেছে রাত সকাল অব্দি থমকে আছে সারা শহর তোমায় নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবনা-ঘেরা মনখারাপের অনেক উঁচু একটা টিলায় আজ আমার এই অপেক্ষাটাই অর্থবহ… হ্যাঁ, জানি, কী ধরব বলে দৌড়েছিলাম। শ্রীজাত- কবি, গীতিকার। প্রকাশিত গ্রন্থ আঠেরো। আমি আর উইলিয়ামস, কর্কটক্রান্তির দেশে,বান্ধবী গাছ সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, কত্ৃতিবাস পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি পুরস্কার। মুহূর্তকাল শ্রীজাত নিজের কেউ না হলেও প্রবাল কুমার বসু অন্য আর একদিন আসুন এখন আপনাকে দেবার মতন আমার কোনও সময় নেই আর একটু পরেই একজন আসবেন তিনি একটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি শান্তির বিষয়ে কথা বলবেন কিন্তু আমার প্রস্তুতি দরকার ভদ্রলোক সেদিনকার মতন ফিরে গেলেন আর কখনই তিনি আসেননি যোগাযোগের কোনও সূত্রও রেখে যাননি উনি তাড়াহুড়োতে ওনার মুখটাও দেখা হয়নি ঠিক করে কোথাও দেখা হলে হয়ত চিনতেও পারব না তবু আজ সকালে উঠে ওনার জন্যই মনটা হু হু করে উঠল কোনও কোনওদিন কারো কারো জন্য এরকমই হয় নিজের কেউ না হলেও প্রবাল কমুার বসু ৮০’র দশকে কবিতা লেখা শুরু করেন, এবং এখন পর্যন্ত তাঁর ১৬টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি গৌরী ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার ও বাংলা কবিতার জন্য ২০০৫ সালে রাজ্য আকাদেমি পুরস্কার পান। কুয়াশাঘেরা কথাবার্তা অনেক হল, এবার যা বলার সোজাসুজি বলো দিগন্ত পেরোতে গিয়ে কুয়াশার ভিতরে যে রোদের রেখা জেগে উঠেছিল, সে-কথা এখনও স্বীকার না-করলে তথ্যগোপন হবে সেই আলোর কথা না-বললে রহস্যের কথাও সবটা বলা হবে না আর, রহস্য বলতে গেলে কুয়াশার অবতারণা করতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে তোমাকে আগে কেউ দেখেনি কুয়াশা থেকে রোদের চিহ্নটুকু মুছে দিলে তোমার বিশেষ স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে, এমন মনে করারও কোনও কারণ নেই এ-কথা ঠিক, রাত্রির আড়ালে কুয়াশার ভিতরে উল্কার মতো উড়ে যেতে-যেতে মৃত্যু যখন পরস্ত্রীর ছদ্মবেশে তোমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল, তুমি তার কোমল টের পাচ্ছিলে সর্বস্বে তখন এক অনবদ্য চন্দ্রালোক তোমাকে একটুও পীড়িত করেনি এখানে উল্কার কথা তুমি যে বানিয়ে ভেবেছ, তা বেশ বোঝা যায় উড়ন্ত মোটর বাইকের বদলে উল্কা বললে একটি বাতাবরণ তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু গোয়েন্দারা তাতে বিভ্রান্ত হতে পারে এ-কথা তোমার ভাবা উচিত ছিল ধানখেতে ছিটকে পড়ার আগে গৌতম ঘোষদস্তিদার সাতের দশকের কবি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধরচনায়ও পারঙ্গম। ‘রক্তমাংস’ কবিতাপত্রের সম্পাদক। রহস্যকাহিনি গৌতম ঘোষদস্তিদার
70 • June / July 2015 কাদের প্রতীক এই ফুল, কীসের প্রতীক ওই চিতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনলাম, গান গাইছেন শুভমিতা জানি না কে দিয়ে গেছে সুর দেখি না তো মালা কে পরায় শুধু বুঝি, থাকলে কার থাকে আর জানি, গেলে কার যায় চলে গেল কত স্বাধীনতা চলে গেল সাতের দশক ‘মুক্তি’ ছিল পুলিশের নাম লক-আপেই গেলে দিল চোখ অসংখ্য ট্রিগার-টেপা আলো ডেকে আনল একই অন্ধকার আঙুলে জড়িয়ে রইল চুল পায়ের তলায় থাকল ভাঁড় দু-এক মুহূর্ত আগে আমি ধরতেও পারিনি তাকে তাই নরকের থেকে স্বর্গ ঘুরে আবারও নরকে ফিরতে চাই গাছের হৃৎপিণ্ডে ছোরা মেরে হাঁড়ি ভরে তুলতে চাই রসে সমস্ত মৃত্যুর পরে ফের জন্ম নেব নিজেরই ঔরসে সুখ-দুঃখ আলাদা করব না এই জিভ আমার অশ্বমেধ তোমার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে বলি, সত্যি হয়নি হাজারও বিচ্ছেদ মিথ্যে হয়ে গেছে নিষ্ঠুরতা ফিকে হয়ে গেছে হাহাকার শুধুমাত্র রাজপথ নয়, এই বন-জঙ্গলও তোমার তুমি পেলে আমিও তো পাবো একসঙ্গে বাতাসে ছড়াব মুছে যাব, ভয় পাও কেন? আমাকে কি জলরং ভাবো? শুধু অনুভূতি নই, আমি অসহ্য খিদের সামনে ভাত আমাকে মুখের মধ্যে নিলে, আমিই তোমার পারিজাত বন্ধ কোনও বইয়ে যেরকম এক পৃষ্ঠা আরেক পৃষ্ঠার সমস্ত অক্ষর শুষে নেয় সেভাবেই আমি বারবার তোমার কান্নাকে শুষে নিই হলে পরে হতে পারে ভুল রেনি-ডে শব্দের একটাই মানে বৃষ্টি হলে বন্ধ থাকবে স্কুল বীজ হাতে উন্মাদ কৃষক ছুটে যাবে মাঠ থেকে মাঠে তোমাকে রোপণ করা মানে লক্ষ্মী ফিরে আসছেন তল্লাটে ফিরে আসছে সেই পক্ষীরাজ যার খুর ধুলো ওড়ালেই নিমেষে পৌঁছব সেই দেশে যেখানে চাবুক রাখা নেই সেখানে যখনই স্বপ্ন ভাঙে শুরু হয় নতুন একটা ভোর… মারা যায় না, সতী হয় না কেউ উমা আর উমার শংকর ডোবায় কলসির মুখ জলে পাখিকে ওড়ার কথা বলে সে গল্পে আমরাও উচ্চারিত গল্প তো পথের সঙ্গে চলে ক্বচিৎ-কখনও কুয়াশায় সামনে কিছু দেখা যায় না আর ভোঁতা হয়ে আসে অনুভূতি ব্লেডের ডগায় জমে ধার কিন্তু সে নেহাতই সাময়িক আখ্যান তো বিস্তারে বিস্তারে যে-কোনও নদীকে এনে ফেলে একটা কোনও সমুদ্রের পারে নুলিয়ার হাত খালি রেখে সম্রাটের হাতে দেয় বীণা আগুন যখন ঘিরে ফেলে আমি বুঝি পালাতে পারি না? কিন্তু আমি প্রলেতারিয়েত ধরে নাও, আমিই লুম্পেন… মেলাও আমার সঙ্গে গলা, শুভমিতা একা গাইবেন? পথে এবার বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় কবি আধুনিক প্রজন্মের এক উল্লেখযোগ্য নাম। দেশে বিদেশে বহু সম্মানের অধিকারী। তাঁর কবিতার দর্শন-বোধ এবং গভীরতা পাঠককে এক অনন্য অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করায়।
June / July 2015 • 71 ছুঁয়ে থাকাটুকুই জরুরি! এই বোধে এত ওড়াউড়ি… পার হয়ে যাওয়া… শুধু পার হয়ে যাওয়া… আমরা আবহমান শরীরে বাঁচিয়ে রাখা স্নান! আর সব কথা আমি সরিয়ে ফেলেছি একাগ্র করেছি প্রেম- ছুঁয়ে থাকবই খুবলে খাওয়া ঈশ্বরীর মৃতদেহে আমরাও মৃতদেহ হই ছুঁয়ে থাকি পচাগলা লাশ… ভনভনে মাছি… উপড়ে নেওয়া চোখে আমরাই নিথর আকাশ হয়ে আছি… আর সব কথা দূরে থাক- ছুঁয়ে থাকাটুকুই জরুরি! ব্যথা হয়ে থাকা… অনুতাপ হয়ে থাকা… শরীরে বাঁচিয়ে রাখা স্নান… মেয়েটির মৃতদেহ ছুঁয়ে হাত ধরবার পর আর ছাড়ছি না… আমরা আবহমান… কবি একটি প্রকাশনা সংস্থায় চাকুরি করেন। ভালবাসার মাটি, সমস্ত দুঃখীকে আজ তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি পুরস্কার। বধ্যভূমি বিভাস রায়চৌধুরী কাঁকশার বনবাংলোয় দুজনে নিশ্চুপ। অন্ধকারে ভেসে আসছে হরিণের ডাক এক্ষুনি শঙ্খ লাগবে গোখরো-খরিশে, তুমি এইবার খুলে ফেলো পুজোর পোশাক! চোখ বোজো, এখন পৃথিবী ঋতুমতী হবে নিথর মেদিনী আজই শ�োধ করবে ঋণ তীব্র যন্ত্রণায় গাছে-গাছে শিং ঘষছে চন্দ্রাহত তিন-চারটি কাতর হরিণ। কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। তাঁর লেখা ছোটদের ও বড়দের বইয়ের সংখ্যা প্রায় চল্লিশটিরও বেশি। এ বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপেন্দ্রকিশ�োর রায়চৌধুরী পুরস্কার পেয়েছেন। বনবাংলো রতনতনু ঘাটী আজকাল বসে থাকলেই কথা আমাকে পেড়ে ফ্যালে আগুন যেমন জ্বলন্ত দেশলাই কাঠিকে হাত থেকে দান পড়ে যায় জীবন থেকে সঙ্গ ঝরে যায় প্রথম বৃষ্টির স্মৃতি আমার চোখ ঝাপসা ক’রে ঠিক সামনেই এসে দাঁড়ায় তর্কপ্রিয় ভারতীয় হাত থেকে পড়ে যায় দিনগুলি রাতগুলি হাত থেকে পড়ে যায় আমার পায়ের দাগ ধরা যত মেঠোপথ কাছে এসে আমার সঙ্গে কথা বলে মৃদু ভাষায় বর্ষার পর ঘাসে মাঠ ভরে গেলে হঠাৎ হঠাৎ হাওয়া ঘুরে যাবার মতো এখন আর আমার কিছু বলবার নেই আমার নীরবতা এখন বলবে। কালের কষ্টিপাথর, ছেলেবেলা, ভ্রমণ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। তাঁর লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আর কিছু বলবার নেই অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
তোমরা ওই কাচের দূরত্বটা একটু সরিয়ে নাও যে শরীরটা বিবর্ণ হয়ে আছে মৃত্যুর কাছে--- অজস্র ঈশ্বর যে জীবনটায় সূর্য ফিরিয়ে দিতে পারেনি, একমুঠো সোনালি রৌদ্রে আমি--- স্বস্তিকে আবার দেখতে চাই। সমুদ্র, দেশ রাত্রির আকাশে কোনও এক, চলমান সৃষ্টির নূতন নাগরদোলায়। জীবিত মানুষের কাছে যেহেতু মৃত্যুর কোনও দর্শন নেই, সুতরাং---তোমরা আমাকে একটু কাঁদতে দাও জোরহাট কিংবা রাঙামাটির খোলা মাঠে, যে স্মৃতিগুলি জাবাল হয়ে আছে। সবুজ অরণ্যে ওর অনাবিল ঘুম, সোনাঝুড়ি পাতার মতো ঘনিষ্ঠ চোখ। ওই সব অতীতকে ভেবে আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। পিছুটান সংলগ্নতা কাকে বলে তারই অর্থ বুঝতে পারি, কাল ফেলে আসা রাতটাকে জেনে। ভগবান! তুমি আমাকে আর একবার বাঁচতে দাও, রাঙামাটির আকাশে এখনও যে জোনাকিরা ঘর বাঁধে--- এইসব অজস্র ‘আজান’ সহজেই ব্যর্থ হয়ে যায়, বিজন মানুষের বিপন্ন সমীকরণে। তুমি অনেক অনেক বছর থাকবে না জেনে, এইসব চিন্তার দুঃস্থ বেদনারা--- ঘর বাঁধে চেতনার গভীরে। কী যেন এক বিস্ময়ের তরে, যে বিস্ময় দু’এক বছরেই জন্ম নেবে, তোমারই রেখে যাওয়া শিশুটির স্বাদে গন্ধে আমাকে একদিন ফিরে যেতে হবে, শরীরের অন্য স্বাভাবিক নিয়মে--- যুদ্ধে হয়তো বা কোনও অপারেশন টেবিলে। শহরের কোলাহল, মানুষের ভিড়, বন্দরের ধূসর নাবিকেরা কেউ জানবে না--- কী হারিয়ে এলাম সুস্থির নিয়তির কাছে তোমার পুনর্জন্ম হয়েছে কিনা জানি না, প্রাচীন স্থাপত্যের মতো কোনও সবুজ উপত্যকায়। সময়ের আবর্তনে আমার ভুলে যাওয়া মন, এখন একঝাঁক সোনালি রৌদ্রে তোমারই অপেক্ষায়। কলকাতা নিবাসী কবি গদ্য ও কবিতা লেখা ছাড়াও জ্যোতিষশাস্ত্র ও আয়ুর্বেদ চর্চা করে থাকেন। সোনালি রৌদ্রে তোমারই অপেক্ষায় রামকৃষ্ণ সিন্হা মে মাসের দিল্লিতেও কোনও গরম নেই কেন যেন হাওয়ার সমুদ্রে ভেসে চলেছে পলাশের ঋতু আবার এ শহরে আমি কী করতে এলাম দিল্লির মসনদে কে নিল দখল, তা নিয়ে আমার কোনও হেলদোল নেই, দরিয়াগঞ্জের পুরনো বইয়ের দোকানে জামা মসজিদের দূরবর্তী আজানের সুরে কিংবা গালিবের বাড়ির বারান্দায় কাকে যেন দুলে উঠতে দেখি আমি সারাদিন সারাদিন কোনও এক ছায়া পাশে পাশে হাঁটে মাথার মধ্যে কথা চলে – উনিশশ�ো নিরানব্বইয়ের গান বেজে ওঠে আরাবল্লি পাহাড় কেটে বানানো লালচে পাথুরে রাস্তায় ধুলো ওড়ে, স্মৃতির রুমাল উড়ে যায় মে মাসের দিল্লিতে খরশান দিন নেই কোনও মায়াময় গোধূলির আলোয় বাণিজ্য মন্ত্রকের মিটিং অর্থহীন মনে হয় হ্যাবিটাট সেন্টারে হেঁটে যাওয়া হাল্কা তরুণী --- ওর নাম যদি প্রিয়াঙ্কা সাক্সেনা হয়, আমিও ছিপছিপে একুশ বছর হয়ে যাব দুহাজার চোদ্দতে, নিরানব্বইসাল লিখে ফেলে আটত্রিশ হাজার ফুট ওপরে, মেঘের ক্যান্টিনে মুখোমুখি আবার ব্ল্যাক কফি খাব বাকি যা হবার, তাই হবে --- রাতের ফ্লাইট ধরে কলকাতা পৌঁছে যাবে লোকে বাইপাসে আলোর ক্লান্তি বেয়ে আমার ডানাহীন, নীলচে লাগেজ বাড়ি ফিরে যাচ্ছে যখন মেঘের ক্যান্টিন থেকে আমাদের বাস কবেকার সিমলার দিকে চলে গেছে...... শূন্য দশকের কবি সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় । পেশায় ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর। লিখেছেন আজকাল, দেশ, কৃত্তিবাস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি কাগজে। মেঘের ক্যান্টিন থেকে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় 72 • June / July 2015
June / July 2015 • 73 দেবব্রত বিশ্বাসের স্মরণে রাতের আকাশে ফুটে ওঠে যত গভীর-গভীর তারা লোকটাও ছিল সেই বিস্ময়, কিছুটা ছন্নছাড়া; শুধু কেরাণীর চাকরি সেখানে সামান্য কিছু টাকা একে ওকে দিতে তাও চলে যায়, ছোট ঘরে একা থাকা। সঙ্গে একটা হারমোনিয়াম, জন্ম-মৃত্যু ও-ই কয়েকটা জামা, একজোড়া চটি, অনেক পুরনো বই। মাত্র একটা হারমোনিয়াম পৃথিবীর থেকে দূরে বসে থেকে কিছু গান গেয়ে গেল রবিঠাকুরের সুরে। নাকি সেই সুর অন্যরকম? হতে পারে...... আমরা কি নক্ষত্র কোথায় রয়েছে সেসব হিসেব রাখি? রাখিনা, শুধুই চোখ ভরে দেখি দূর-দূরতম তারা লোকটা কাউকে পরোয়া করেনি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। আধুনিক বাংলা কবিদের মধ্যে বীথি চট্টোপাধ্যায় এক উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই এর সংখ্যা ১১টি। এ ছাড়াও তিনি শিশুসাহিত্যিক হিসেবে জনপ্রিয়। মাত্র একটা হারমোনিয়াম বীথি চট্টোপাধ্যায় মাথার মধ্যে বৈশাখ তন্ময় চক্রবর্তী যেসব দিনে বৃষ্টি হ’ত, পিছল থাকত মাঠ ভিজে জামায় মা বকবে, বরাদ্দ তাই ছাদ। লুকান্তিচোর যে খেলাটা, খেলতে খেলতে রাত আবছা ঘরে হঠাৎ করে হাতের ওপর হাত। বয়স বাড়লে কি যেন হয়, ছেলেরা সব ছেলে টিউশনিতে মা ও মেয়ে, ব্যাপারটা গোলমেলে। দুপুর গড়ায় বিকেল গড়ায়, জল গড়ালে ছুঁই বয়স যে, সেও গড়ায়, বলিসনি তো তুই। চৈত্রমাসের সর্বনেশে যেসব কোকিল ডাকে সারা পাড়ার লোক জেনেছে, বলিসনি আমাকে। ঝিলের ধারে ডুবিয়ে দিলাম দিব্যি করা কথা ধানাকাটা মাঠ, পানা পুকু্র, এবং কচিপাতা। মনকে ভাসাই, শরীর ভাসাই, মাথার মধ্যে বৈশাখ ভুল, যদি করেই থাকি, থাক না সেসব থাক। দেখা হঠাৎ হতেই পারে, দিনকাল তো ভাল না প্রকাশ্যে হোক বাদবাকিটা,পরস্পরকে ছলনা। বিশিষ্ট তরুণ কবি, পেশায় উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, পূর্বভারত পুরস্কার। বেশ কয়েকটি প্রকাশিত কাব্যগন্থের প্রণেতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। হেমন্তের পোস্টার শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় শীতের আগে পর্ণমোচী অরণ্যে যাই আমি ও ঈশ্বর প্রতিটি গাছের গায়ে সাঁটা ‘সন্ধান চাই’ পোস্টার কে কাকে সন্ধান করে বারবার? দু’জনে হাত দিয়ে ছুঁই হেমন্তের পোস্টার সন্ধান চাই পোস্টারের নীচে বসে থাকি আমি ও ঈশ্বর এক লক্ষ নক্ষত্র ফুটে ওঠে আমাদের কোলে ঝরে পড়ে পাতা আমাদের বিপন্ন সাইকেলে আমাদের কেউ কি খোঁজে পর্ণমোচী বনে? বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির সচিব। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বর্ষাদুয়ার, নখের ডগার সঙ্গে কথোপকথন, জাগো রাঙালি বাজনা উল্লেখযোগ্য।
74 • June / July 2015 এখান থেকে লেখা যায় না যে সব জানলাগুলো বেঁচে আছে নিজের মতো ছায়া ফেলে সন্ধ্যাবেলা লম্বা হয়, জুড়িয়ে যায় ভাতস্বভাবের মতো। সব মেনে নিলে এখানে থেকে যাওয়া যায় কিন্তু তারপর নিজেকে আবার ঠেলতে ঠেলতে এমন কিছু আধখাওয়া পাঁউরুটি মাখনের কাছে- নিঃশব্দে জানলাগুলো দোলে, অথচ ছায়াগুলো কাঁপে না এমন একটা algorithm লিখে ফেলতে পারলে, সেখান থেকেও বোঝা যায় কিন্তু এখান থেকে লেখা যায় না। অনুপম আধুনিক যুগের একজন কবি, জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার এবং জাতীয় পুরস্কার-প্রাপ্ত সংগীত শিল্পী। এখান থেকে লেখা যায় না অনুপম রায় জল… স্থির, শান্ত শ্লোক। এই জলে দাঁড়িয়ে সময়। এ আমার মৃত্যুকাল, অন্য কিছু নয়… পোশাক রেখেছি খুলে। ওই পাড়ে কী কী পরিধান? তুমি কি নতুন করে আবার বাজাবে বাঁশি? হাতে দেবে শুদ্ধ পরিত্রাণ? যে-কোনও পাড়েই হোক দেবী, আমি তোমাকেই প্রতিবারে ফিরে পেতে চাই ধানের ভিতরে ধান, আগুনে আগুন কিংবা ছাই… জল… স্থির, শান্ত শ্লোক। এই জলে দাঁড়িয়ে সময়। এ আমার মৃত্যুকাল, অন্য কিছু নয়… রেহান কবি। আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, সানন্দা, অদ্বিতীয়া ইত্যাদি পত্রিকায় লিখেছেন। এ ছাড়া গান ও চিত্রনাট্য লেখেন। মৃত্যুকাল রেহান ক ৌশিক আস্ত এক ধু-ধু মাঠ মাথায় নিয়ে বসে থাকি রহস্যসমুদ্রের পাড়ে শ�োকের চেয়েও বড় ভূতগ্রস্ত পোতগুলি থামে এসে বন্দরের ধারে বুড়ো নাবিকটি খোঁজে অল্প আগুন আর সোমত্থ ডাকাবুকো মেয়ে আমার মাথার মাঠে কোলাহলে কালো যত মেঘ আসে ছেয়ে আমার খুলির ভিতর উন্মত্ত, মদ্যপ খালাসিরা গুগলি সেঁকে খায় মেয়েটি তখন ওড়ে মেঘ হয়ে বৃদ্ধের যাবতীয় হিমযৌনতায় নড়েচড়ে রহস্যসাগর, আমার মাথাটি ক্রমশ ভারী হয়ে আসে জাহাজও দুলছে ক্রমে, নোঙর ছিঁড়েছে তার, এই বুঝি ভাসে কে এক কাপ্তান, সে নিজেকে ভাবছে আজ সমুদ্রের ঈশ্বর কে এক দুঃস্থ নাবিক, তার কণ্ঠে শুনি মৃত যত সিগালের স্বর কে এক খালাসি, নিজেই বোতল হয়ে পড়ে আছে পিস্টনের ধারে মাঠভর্তি মাথা এক অস্তমিত হয়ে যাচ্ছে রহস্যসাগরের পাড়ে বিকাশ সরকার বিশিষ্ট কবি। ঊত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি দৈনিক পত্রিকার সহ সম্পাদক। ২০১০ সালে পেয়েছেন যুগশঙ্খ পুরস্কার। অলৌকিক জলযান বিকাশ সরকার
June / July 2015 • 75 আকাশভর্তি এত আলপনা। এসবের মাঝেও, কী দ্রুত এবং অবলীলায় কালপুরুষ এঁকে দিলে তুমি, সাথে অনুসরণরত লুব্ধক। যেভাবে নক্ষত্রমণ্ডলী এঁকেছ সেভাবেই আবছা সবুজ এক ঘষা কাচের দেওয়াল এঁকেছিলে একদিন। আমি জানি, সেটা কোথায় আছে। এই গ্রহেই, এই গ্রহেই। সেই অস্বচ্ছ আয়তক্ষেত্র থেকে তুমিও বেরিয়ে আসো মাঝে মাঝে, নতুন ছেপে আসা বইয়ের সুঘ্রাণ সাথে নিয়ে। তখনই বৃষ্টি শুরু হয় টিনের চালে এবং কী আশ্চর্য, তখনই ছেড়ে যায় হলদিবাড়ি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। কপালে জোনাকির টিপ, রূপশালি ধানের ছড়া, পছন্দের বৃষ্টি, দেওয়ালে বাল্মীকিপ্রতিভা রবি ঠাকুর। কী অব্যর্থ আবহ, কী সব অশৈলী ব্যাপার, এতদিন বাদেও। হরিণ শিকারের ব্রাহ্মমুহূর্ত। যাই বলো, শিকারি পুরুষের প্রতি তোমার একটা খুব সুক্ষ্ম টান আছে। কোমরবন্ধ এবং তরবারির জন্য এই একটা মৃদু অনুরাগ, সাদাচোখে বোঝা যায় না কিন্তু। এগারো হাত শাড়ির একপাশে গুহাচিত্রের মোটিফে আঁকা অবৈধ আঁচল যেমন। যে চাউনিতে পাশ ফিরে তাকাও মাঝেমধ্যে, তাতে কি বিভ্রম পুষে রেখেছ, নাকি অনুযোগ? পাখিধরা মানুষের দিকে ওভাবে তাকিও না। ছোটখাটো তির নিয়ে ঘুরে বেড়াই আদাড়ে বাদাড়ে। ঘরবাড়ি নেই, সেলফোন নেই, ইমেল আইডি নেই, লুকোনো পাসওয়ার্ড নেই, বিপদে আপদে ডাকার মতো তিন ডিজিটের কোনও সহজ টোল ফ্রি নম্বরও নেই। আমি তো আর অরণ্যদেব না, শূন্য স্থানাঙ্কের এক মানুষ, আমার ডায়না পামার নেই, ডেভিল নেই। সলোমন আর নেফারতিতির পিঠে চেপে পার হয়ে যেতে পারি না পিরানহা মাছে ভরা করতোয়া নদী। সামান্য কিরাত আমি, মার্জনা করো বেনে বউ, অন্তত তোমার মুখে শেখানো কৃষ্ণনাম শুনতে চাই না। এটা ফাইনাল। বিষণ্ণ কার্নিভাল সুজিত দাস সমগ্র তুমি রাখা আছে আমার কাছে। সেভিংস অ্যাকাউন্টে তোমাকে জমা রাখা- সমস্ত জীবন ধরে অল্প অল্প ভাঙাবকোনও আঙুলে পদ্ম রাখব কোনটিতে অকালবোধন পাপে, প্রকাশ্যে সমূহ জ্বলব দুজনে- আমাদের সর্বনাশে স্তম্ভিত হবে পড়শিরা ছিছিক্কারে আমার উঠোন ফাটবে জল ছাড়া মদ খেতে পারি না যেমন তেমনই তোমাকে চাই না সম্পূর্ণসোনালি বিষের মতো ঠোঁট চাই কখনও বা আমূল কর্ষণ পেশা সাংবাদিকতা, বর্তমানে অনুবাদক। সিগনেট প্রেস থেকে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। মূলধন অদিতি বসুরায় অপরিবর্তিত দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় শহর ছেয়ে বৃষ্টি নামে, তোমরা ভাবো মনখারাপ ভিজলেই কি শান্তি পাবো? আমার ছোঁয়ার মতন জল কার দু’চোখে ঝরবে? কার নরম সোঁদা পায়ের ছাপ ফিরিয়ে দেবে নদীর স্রোতে খুইয়ে আসা ছলাপছল? কার বিরহে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যাগুলো অপেক্ষায়? নিওনধোয়া গলির ভিড়ে গুলিয়ে যাচ্ছে ফেরার পথ বৃষ্টি এসে থেমেও গেছে, এইভাবে রোজ জীবন যায় স্তব্ধ শহর, সামনে পড়ে একলা হাঁটার ভবিষ্যত...।। দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজি সাহিত্যের এমএ ফাইনাল বর্ষের ছাত্র। এ যাবত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ‘ভোর রাতের এইট-বি’, শন্ূ যের পাঁচ (সম্মিলিত), ও রং ভাঙার শব্দ (সম্মিলিত) কবিদের সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মাঝে নন্দন চত্বরে, কফিহাউসের হাওয়ায় তাঁরা শেয়ারবাজারের দরদাম নিয়ে আলোচনা করে ঝোলা-ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের চাঁদ বার করে পাথরের আকাশে টাঙায় সময়ের শরীর খুলে রাত্রির স্তন পান করে দুধ-সায়রের খোঁজ না পেয়ে দিঘার সমুদ্রকেই অনন্ত তুলে খিস্তি দেয়… পাঞ্জাবি পরে, দাড়ি রাখে, মদ খায় অথবা খায় না কবিদের সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মাঝে কিন্তু বহুদিন কবিতার সঙ্গে দেখা হয় না আমার আকাশবাণী কলকাতার আমন্ত্রিত কবি কিশ�োর ঘোষ বর্তমানে একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মী। ২০১৪ সালে ‘দৌড় সম্মান’ পুরস্কার পান। একটি আয়না কিশ�োর ঘোষ পেশায় সরকারী আধিকারিক। নেশা ছবি তোলা, কবিতা লেখা এবং রান্না করা। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্বপ্নের হাতপাখা’।
76 • June / July 2015 এ কলেূ র কবিতা আমার দিন তারিখের লহমাগুলো খুব বেশি না একাকী জগতের নৈঃশব্দে তাদের পালন করেছি অবতারের মতো তনহার ডেকের উপর দাঁড়িয়ে মাঠ চিরে দেওয়ার হাওয়ায় ওকে মিলিয়ে দিতে দিতে কর্পূর হাতে নিয়ে প্রথম শ�োঁকার অনুভূতি তাকে পাখির চেয়েও সাহসী হাল্কা সিঁড়ি দিয়ে তার নিরবয়ব নেমে যায় এক অশরীরী তবু ছায়াময় মনে হয়েছিলো সে লহমার ছায়া আর নিরূপ ভিন্ন প্রতিফলক নয় একে অন্যের ভিতর বা বাইরের দিক নয় তুমি এসেছিলে কেবল আমার হাত ছুঁয়ে দেখতে বৃষ্টি ভেজা ঈষৎ বেগুনি লাইল্যাকের ভেতর দিয়ে দুই বালকের খেলার ভেতর দিয়ে খড়পাতা ছেঁড়া খাতা আমার টেনে চলা বাঁ-পাটা তোমার দিকে তোমার একান্তের দিকে চলে ‘এগনো’ বললে একটা দিকের কথা আসে আতসকাচের ওপাশের পৃথিবীর দিক রাত গড়িয়ে ঢুকছিলো মৌমাছির বরাদ্দ কাঠের বাক্সের ডালা খোলা সেখান দিয়ে তারারা বেরিয়ে যাচ্ছে সশব্দে আর অন্ধকার ঝকঝক করে তোমার অনবরত শরীরের কাঁচা তুমি এলিয়ে পড়ছে মুদ্রায় মাংসে রুটি দুধ চিনি কালো বেড়াল আর কাঠের টেবিলের চারপায়ার মধ্যে আমরা যৌথভাবে বসে সেই নিরবয়বের অপেক্ষায় আমরা খাচ্ছি আর খেলছি আমি জানতাম কী দুঃসাহসী কী অযাচিত আমার আত্মসান্ত্বনা তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে বেহালার পাশে বেহালার কালো গর্তে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলো বাদামী পূর্ণাঙ্গ যুবতী যে রসস্থ আঙুর তোমার বন্ধ চোখের ওপারে নীল নীলতর হচ্ছিলো অন্তরীক্ষের কল্পনা টেবিলের বোঁজা লাইল্যাকটাকে টেনে নিয়ে আমি টেবিল পুঁছে নিচ্ছিলাম সব শেষ হয়—লাইল্যাক তার রসের ওপর মরে ভেসে ওঠে সেই বেগনি রসের অতলস্পর্শে তোমার চোখের পাতা তোমার ছায়া আর্যনীল মুখোপাধ্যায় তোমার ঘরের কোণে একা জেগে একা দাঁড়ানো এক কোণ এক সরলরেখার সরলদেখা উষ্ণ পলি নরম গলিত লোহা তোমার হাতের জ্বর আর যাদের গল্প বলা হয়নি সেসব নদী স্ফটিক শহরের ফোকট দিয়ে ছুটছে পাহাড় ধূমপান করে সাগর ঘেমে নুন কোনও একটা কী যেন একটা গোলাকার স্তনিত তালুতে ধরা পালঙে শ�োয়ানো তোমার ঘুমন্ত নগ্নতা গোলাকার স্তনিত কাঠামোর ভেতর কাঁচা ফুলের কলি সব আমার জন্য যে তুমি তোমরা উঠে বসছো আর ভাষার শরীর ধারণ করছো – মানবভাষা শ�োনার ভাবার ভাষা আঁচড়বিহীন ভাষা যুক্তির ভাঁজের ভেতর দিয়ে স্রোতস্বিনী বয়ান সুশব্দে দ্রুত সংগঠিত তোমাকে ঘিরে যে তুমি তার শব্দ ও ভাবনাকে ঘিরে তাকে বদলে সংস্কার করে ছাই সরিয়ে আগাছা ছেঁটে মাছি তাড়িয়ে পুঁজ পুছে যে তুমি সামান্য সমস্ত সব যা তোমার আমার মধ্যে বস্তু ও স্পর্শ হয়ে উঠেছে হয়েছে জল স্থল বরফখন্ড ধোঁয়াশা যারা সবাই বইতে পারে বয়ে নিয়ে এসেছে তোমাকে আমাকে এমন কোনও মরীচিকার ওপর যেখানে পুনঃসৃষ্টি সৃষ্টির পরবর্তী নয় যে গ্রাম শহরের আগের অবস্থা নয় অসম্পৃক্ত একক নয় আমাদের পায়ের নিচে পুদিনা ঘাসের মহামারী ছড়িয়ে যায় পাখিরা পিছু নেয় ঝাঁকের কই নদীর বাঁকে ধেয়ে আসে কে জানে? আমাদের আকাশের চোখ খোলা না নিজেদের একে অন্যের পরিপূরক নিজেদের বোঝেনা অন্ধকারের পাতার নিচে তৈরি হয় জল আর্যনীল দ্বিভাষিক কবি, অনুবাদক। তাঁর কবিতা ইংরাজি ছাড়াও হিন্দি ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের পরীক্ষামূলক পত্রিকা ক ৌরবের সম্পাদক। বর্তমানে তিনি আমেরিকার সিনসিনাটি শহরের বাসিন্দা।
June / July 2015 • 77 এ কলেূ র কবিতা শীত বললেই আমার মনে পড়ে নিভিয়া ক্রীম ‘এই যাহ, একটু বেশী পড়ে গেল !’ বলে মুখে মাখিয়ে দিচ্ছে মা আর প্রবাস বললে, আমার মনে পড়ে এইসব রুক্ষতার দিন, ক্রিমের আস্তরে ঢেকে যাওয়া উদ্বৃত্ত শীত বা উদ্বৃত্ত উষ্ণতা, কোনটাই ভাগ করতে পারিনি যখন... আষিক কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে পি এইচ ডি করছেন। ‘ঘুম নামের পাহাড়’ ও ‘বরফবন্দীর ডায়েরি’ - প্রকাশিত কবিতার বই দুটি। সুরকার হিসেবে ভারতীয় মার্গসঙ্গীতধারার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নবীন শিল্পীর সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন।। প্রবাস আষিক সাক্ষাৎ মাসুদ খান আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে আজ বহুদিন পর। মন যেন আজ হাবল-পূর্ববর্তী উপদ্রবহীন মায়াময় রাতের আকাশ... নিরিবিলি নীরব নিঝুম। বহুকাল পর আজ দেখা হবে তোমার সহিত। জোনাকি-ফুটিয়ে-তোলা রাতের আকাশ ঝেঁপে নেমে আসবে বিলের পানিতে। ফুটে উঠবে অগণন তারামাছ। ধ্রুবকের মতো জ্বলবে তাদের প্রতিটি ক ৌণবিন্দু। কতদিন হলো তুমি নাই এই দেশে। উঠানে বরইয়ের গাছে চুপচাপ ঘনিয়ে-জড়িয়ে-থাকা স্বর্ণলতাগুলি এতদিনে বদলে গেছে জং-ধরা তামার তন্তুতে। মৌমাছিরা সেই কবে উড়ে গেছে দূরের পাহাড়ে ফাঁকা-ফাঁকা স্মৃতিকোষ হয়ে ঝুলে আছে এখনো মৌচাক, কৃষ্ণচূড়া গাছে। গুঞ্জনের রেশ, মধু ও মোমের অবশেষ-- কিচ্ছু নাই কোনোখানে। অভিমান করে নদী সরে গেছে দূরে নাইওর-নিতে-আসা নৌকাসহ। তবুও এখনো, সংসারে-হাঁপিয়ে-ওঠা, ক্রমশ-ফুরাতে-থাকা নাম-না-জানা কোনো গৃহবধূ বিরহবিলাপ সুরে খুনখুনিয়ে গেয়ে যাচ্ছে অস্ফুট কাকুতিগান-- ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও বাঁশি আল্লা’র দোহাই এ পরানের বিনিময়ে তোমার পরান দিয়ো হাসি আল্লা’র দোহাই...’ মাসুদ খান কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম বাংলাদেশে। বর্তমানে কানাডাবাসী। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ৬টি। [অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ - জীবনানন্দ দাশ] এসো সব, উল্লাস জানাই তবে মনোহর আঁধারের উদ্দেশে। আলোর দিশারীরা একে একে লুটোতে থাকুক পথে ও প্রান্তরে। নির্বিকার নগররক্ষীরা; জনতার অনেকেই মুঠোফোনে ভালবেসে দেখে যাক ধড় আর মাথা বিচ্ছিন্ন হয় কতটুকু সময়ান্তরে কিংবা চাবুকে চাবুকে ফালা ফালা হয় নরম সুঠাম শরীর, বুলেটবৃষ্টির শাস্তি নেমে আসে শব্দের অপরাধে কিংবা ছবির। নগরে, বন্দরে, গ্রামে ও প্রান্তরে বহে যাক জোয়ার-ভাঁটা। বিবরণে বিশ্লেষণে তৃপ্তি আসুক, যত্ন করে সাঙ্গ হলে নিতান্ত আবশ্যিক জৈবিক কাজ যত, চেঁছেপুঁছে চাটা - নিহতেরা মরেছিল জেনো, নিজেদেরই দোষ ছিল বলে। আমাদের প্রবল বিশ্বাস সমস্ত আয়নায় জানাতে থাকুক আমরা সুন্দর বড়। নিরুপায় খুনে অকলঙ্ক আমাদের মুখ। আমাদের লুকানো নখর বেয়ে নেমে আসা রক্তের ধারায় চালু থাকে নিরন্তর পণ্যের স্রোত, আঁধারের পাড়ায় পাড়ায়। পেশায় অমিতাভ চক্রবর্তী কেমিস্ট। থাকেন ন্যাশভিল টেনেসি তে। ‘এক লহমার ব্লগ’ নামে ওয়েবপাতায় তাঁর লেখা কবিতা, প্রবন্ধ পাঠকদের নজর কেড়েছে। অন্ধকারের আরাধনা অমিতাভ চক্রবর্ত্তী
78 • June / July 2015 একটা মানুষ সেরাম প্রোটিন, একটা মানুষ শ্লাঘ্য নারী। একটা মানুষ চলৎশক্তি- বুক ঠেকালেই বুঝতে পারি। একটা মানুষ হ্যালিস কমেট, একটা মানুষ রতিক্রিয়া। একটা মানুষ বারবিচুরেট, একটা মানুষ শূন্য হিয়া… রোদন ছিল, অরণ্য তার ভুল ভেঙেছে, ক্লেদের তাপে- অসময়ের সময় এখন ভুল করে পাপ পুণ্য মাপে। পুণ্য জানে, পাপের হিসেব, নিঃস্ব হাওয়ায় একলা চলার, ডাকছে বুকের যন্ত্রণারাও, অনেক কথা স্পষ্ট বলার… একটা মানুষ দরকারি কাজ, একটা মানুষ ক্রন্দসী নাও; হৃদয়লীনা সুর তোলে আজ- ‘ব্যর্থ বীণা, আবার বাজাও’। সময়বিহীন আখর ডাকে নরম আলোয়, দূরের চিতা, ভস্ম জীবন, উধাও মরণহাওয়ায় ভাসে অপাবৃতা। পেশায় বিজ্ঞানী। শিল্পী, কবি, সুগায়ক। বর্তমানে হিউস্টন-বাসী। অপাবৃতা উদ্দালক ভরদ্বাজ ঘন ঘন বাসা বদলানো মানে ফেলে আসা বাগান, বাগানের বুকে লাগানো গোলাপের চারা; গত গরমে ফুল হলো কী না? নরম মাটিতে হাঁটু গেড়ে আমি ঈশ্বর হয়ে গেছি কতদিন গোলাপ কে করেছি ব্রাহ্মণ, গাঁদাকে কে ক্ষত্রিয় বাকি সব বৈশ্য বা শূদ্র যারা বিজাতীয় | ফেলে আসা বাগানের খবর নিয়ে মাঝে মাঝে বৃষ্টিরা আসে, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে জানালার কাচে ওদের গায়ে জড়ানো মন খারাপের গন্ধ অজানা রয়ে যায় পুরনো বাগানের ক্ষমতার দ্বন্দ | ঘন ঘন বাসা বদলানো মানে ফেলে আসা দেওয়াল দেওয়ালে ঝোলানো ছাপোষা দুপুরের টুকিটাকি নতুন রঙের প্রলেপে মুছে গেলো নাকি? এসব দেওয়ালে কান পাতলে নিঃশ্বাস নিত বাস্তু সাপ: ফটোফ্রেমে গান্ধী লেনিন মুখোমুখি, কাঁচা হাতে আঁকা ছোট মেয়ের বেড়ে ওঠা মাপ | পুরনো দেওয়ালের খবর নিয়ে জ্যোৎস্নারা আসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে মুখ টিপে হাসে তারপর অগণিত গাছের ভিড়ে যে যার মতো জানিনা নতুন পর্দায় ঢেকেছে নাকি পুরনো ক্ষত। ঘন ঘন বাসা বদলানো মানে ফেলে আসা সময় সময়ের অলিন্দে খসে পরা অকারণ ঝগড়ারা, ক্ষণিক হরিণ ভালোবাসা | জন্মদিনের পায়েসের গন্ধ, ছুটির দিনের ঘর্মাক্ত দেহতত্ব টেবিলে সাজানো ফুলের রুদ্ধশ্বাস একাত্ম, দাম্পত্যের অপূৰ্ব অভিমানে বন্ধ স্নানঘর | ফেলে আসা সময়ের গল্প নিয়ে তারারা আসে, আমাকে সারা রাত জাগিয়ে তারপর মুছে যায়, অস্তিত্বের মত সব কিছুরই চলে যেতে হয় ঘন ঘন বাসা বদলানো মানে বৃথা কালক্ষয় | যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে অর্থনীতির গবেষক কবি তাপস রায়ের অন্য পেশা অভিনয় ও ছবি আঁকা। সিনসিনাটির বিভিন্ন ছোট-বড় নাট্যসংস্থার সাথে তিনি জড়িত।বর্তমানে তার আঁকা তেলরং Starbucks এ প্রদর্শিত হচ্ছে। বাসাবদল তাপস কুমার রায়
June / July 2015 • 79 কিছু শব্দ, কিছু অলিখিত শব্দ, কিছু অভাবিত শব্দ দিয়ে তৈরি হোক সেই কবিতা রূপ তার ভয়ঙ্কর --- যেন কুম্ভীপাকে নরক-দর্শন কান পাতা দায় মারণ-চিৎকারে। পিছনে থাকুক তার কালো মেঘের ঘনঘটা বিদ্যুৎ দিক চিরে-চিরে ফুটিফাটা আকাশের এ পার-ওপার, আর পৃথিবী কাঁপুক, যেন থুরথুরে গরিলার জ্বরো হাসি শুদ্ধ হোক অগ্নিপরীক্ষায়, জহরব্রতের রাজপুত রমণী আহা আজু কি আনন্দ। তারপর শেষ হোক শব্দের খেলা ম্লান গনগনে ভ্রূকুটি, ধারাপাতে অবিশ্রাম। যাক কেটে কলঙ্কিনী রাত অবশেষে এবার হোক না গাওয়া গান, বেণু-বীণে তারপর বসুক না সে এসে ল্যাজ গুটিয়ে দুষ্টুটমির মত যেন জানে না খেতে – ভাজা মাছটা উলটে নিয়ে। পেশায় বৈজ্ঞানিক ও অধ্যাপক রাহুল রায় দেশ, কৃত্তিবাস, নবকল্লোল, উৎসব ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখে থাকেন। কবিতা ছাড়াও গল্প, রহস্য গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ইত্যাদি লেখায় উৎসাহী। কবিতার জন্ম (ইনফার্নো) রাহুল রায় একে একে সবই গেছে ভেঙে ভাঙেনি সৈনিক---বাংলার মুখ সিরাজ, এক ধরণের স্বপ্নের সুখ মৃত্যু নিংড়ে পাওয়া স্বাধীনতা গৌড়বঙ্গের স্মৃতি তর্পণ # সময় এসেছে আবার, আবার ফিরে তাকাবার এবং ভুলিনি আমি, রক্তের সৈনিক---বাংলার মুখ প্রবীণ কবি আসাম শিক্ষাবিভাগে প্রিন্সিপাল ছিলেন। বাংলা ভাষা চর্চায় তাঁর গভীর আগ্রহ। পলাশীর তীর ইন্দুভূষণ পালচৌধুরী আমি কি নারী নই কৃষ্ণা চৌধুরী ঐ যে পুরুষটি বলছে যে মেয়েদের হাত ধরে সাবধানে খানা খন্দ পার করে গাড়ীতে তুলে দিতে হয় সাথে সাথে যেতে হয় ভাল ভাল জায়গায়। কই আমাকে তো ভাই কেউ কখনও করেনি তা। তবে কি আমি একজন নারী নই? তাকিয়ে দেখ হে পুরুষ আমার দুটি শক্ত হাতে সবলে খুঁড়েছি মাটি পুঁতেছি গাছ ফসল যা ফলিয়েছি তা সবই জমা করিয়েছি ভরেছি মরাই তবে কি আমি একজন নারী নই? তোমার চেয়ে ক্ষিদেও কিছু কম ছিল না, পিঠের ওপর বেতের ঘা পড়েছে কম কিছু না। তেরটি সন্তানের জন্ম দিয়ে চোখের জলে, দাসত্বের কবলে দিয়েছি তাদের বিকিয়ে। আমার সেই বুকভাঙ্গা কান্না ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই জানেনা দাসের সন্তান তো হল দাসই, তবে কি আমি একজন নারী নই? ঐ যে পুরুষটি বলছে যে নারীর অধিকার কখনই হতে পারেনা পুরুষের সমান যেহেতু জন্ম নিয়েছে কোলে আমার সন্তান। হে পুরুষ সন্তানের জন্ম যদি হয় ঈশ্বরের দান তবে ঈশ্বর আর আমার মাঝে কোথায় তোমার স্থান? পূজগতির প্রথম মাতা সন্তানের জন্ম দিয়ে এই সত্য প্রমান করিয়ে পৃথিবী ওলট পালট করে দিয়েছিলো প্রচন্ড ঝড় বইয়ে। তাহলে বাকী সমস্ত নারীদের মিলিত শক্তি দিয়ে অসাম্যের বিরুদ্ধে হাতে জেহাদের ঝান্ডা নিয়ে পারেনা কি এ ধরাকে দিতে কাঁপিয়ে? দীর্ঘকাল প্রবাসী এই কবি পেশায় পাবলিক স্কুলের গণিত শিক্ষিকা। শিক্ষাজগতের অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখনির অনুপ্রেরণা।
80 • June / July 2015 মেলানো যায় নি একটি সরবতা ও একটি নৈঃশব্দকে। নৈঃশব্দটি ছিল নদীর ধারে তার একলা ঘরে সজ্জিত, হালকা মেঘে ভেসে যেত তার সলাজ চোখের দৃষ্টি। হঠাৎই ঈশান কোণে একটা ঝোড়ো বাতাসে ধূলিসাৎ হয়ে সব ভেঙেচুরে ছড়িয়ে গেল। অনিশ্চিতের ঢেউয়ে দোলে ময়ূরপঙ্খী নাও। স্বর্ণ শুভ্র ওড়না আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত, অদূরে ডাহুক পাখিরা ডানা ঝেড়ে নিল। অন্ধকারে ভেসে যাওয়ার মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে আলেয়া এক ফুঁয়ে নিভে গেল। রসায়নে স্নাতকোত্তর ইন্দ্রাণী একজন দ্বিভাষিক কবি। আলেয়া ইন্দ্রাণী সরকার। খাঁচা ছেড়ে পাখী ডানা মেলে নীল দিগন্তে উড়ছে নেই কোন অন্ত, ফেলে আশা বন্দী জীবনের নেই কোন বেদনা, আছে শুধু স্বাধীনতার অব্যক্ত অনিশ্চয় যাতনা। মনের কামনা নীল গগনে উড়ছে অন্তহীন পুলকের কামনায়, সবকিছু থেমে যায় না পাওয়ার বেদনায়, চোখে পরে ভূমিতলে নিরাশার কালো ধোঁয়া। শীত আসে হতাশার তুষার কার্পেট বিছিয়ে, সবুজ সরল প্রাণের হয় অপমৃত্যু, হতাশ নব যুবতী অপেক্ষায় থাকে - প্রিয়তমের পদধ্বনি নিয়ে আসে নতুন জীবনের ইঙ্গিত – হৃদয়ে হৃদয়ের ঊষ্ণ স্পর্শ। শীতশেষে বসন্তের উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে পিয়াসী বুকের কোমল কম্পন, অপেক্ষায় থাকে কবে হৃদয় মিলন –সৃষ্টি হবে নব জীবনের অংকুর, ধরা হবে সবুজের কার্পেট আর যুবতীর কোলে জন্ম নেবে নব যুগের প্রতিনিধি এক সৎ সরল শিশু, সকলের প্রিয় এক নতুন মানব। দিলীপ চক্রবর্তী একজন সমাজসেবী ও সুলেখক। তাঁর লেখা উত্তর আমেরিকার ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে থাকে। নিউ ইয়র্কের “Rockland Journal”এ ও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। নবজীবন দিলীপ চক্রবর্ত্তী তোমার পায়ের শব্দ পেয়ে বৃষ্টিকে রাখলাম জানলার পাশে ছুটে এলাম তড়িঘড়ি তোমার কাছে দেখি আমাকে অবাক করে তুমি ঢূকেছ ঘরে তছনছ করছ আমার যা কিছু ছুঁড়ে ফেলেছ আমার বসন্তের ফুল শরতের নীল আকাশে ঢেলেছ বিষাদ ধূসর কালি ঝলসানো হলকা হাওয়ায় মুছে দিয়েছ শীতের আদুরে আবেশ তুমি মেতেছ তান্ডবে --- তোমাকে ঘিরে কেবলই গ্রীষ্মের দাবদাহ। পারলাম না আমি পারলাম না তোমার কাছে যেতে তোমায় কাছে পেতে। তখন সোনারোদ টিপ পরে ফিরে গেলাম জানলার ধারে বৃষ্টির কাছে দেখি, জানলা সেখানে একা বৃষ্টি কোথাও নেই। ন্যাশভিলবাসী কবি একসময়ে ‘থার্ড থিয়েটার’-এর নিয়মিত কর্মী। বেশির ভাগ লেখালেখি অনলাইন লেখক সমাবেশ ‘সচলায়তন’-এ, ছদ্মনামে। কবিতা লেখা - নিজের ব্লগে, আর দুকূল পত্রিকায়। তোমার পায়ের শব্দে স্বপ্না রায় নিজের ছায়ার সঙ্গী তুই দেবাঙ্গনা ব্যানার্জী বছরের প্রথম রোদ, সবুজ ঘাসে, ছোট মেয়ের ছায়ার সঙ্গে লুকোচুরি ছায়ার থেকে পালাতে গিয়ে কেবল হয়রান ছোট মেয়ে, তুই তো জানিস না ছায়া আর মেয়ে তোদের একই সঙ্গে কত ঝলমলে দিন, মেঘলা আকাশ যেই তুই দেখিস লম্বাটে এক ছায়া, বাসা বেঁধেছে বাগানে “মা” বাসার মাঝে লুকিয়ে, জড়িয়ে ধরলি এসে বুঝি নিজের ছায়া হারিয়ে গেছে --- কী ভীষণ হাসি মা’রও হাসি, চোখ ভিজে আসে ছোট মেয়ে তুই তো জানিস না এ সবুজ ছেড়ে অনেক দূরে, বড় হলে কেবল নিজের ছায়ার সঙ্গী তুই কত ঝলমলে দিন, মেঘলা আকাশ মা’র ছায়া, অপেক্ষায়, পড়ে রইবে বাগানের ঘাসে। দেবাঙ্গনা শান্তিনিকেতনে, বিশ্বভারতীর কলাভবন এবং ব্যাটন রুজে, লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ আর্টে এম.এফ.এ. যথাক্রমে ।আমেরিকা ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ফিনিশিং লাইন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবাঙ্গনার প্রথম কবিতার বইকাম ব্যাক রিভার। বড়গল্প
June / July 2015 • 81 ৩কড়ির কাল৪ শক সুজয় দত্ত ৫মিশেলি চিঠি শুনে মুখে আর বাক্যি সরে না তিনকড়ি মণ্ডলের। একটু আগেই ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিল বুড়ো। সন্ধের মুখে দাওয়ায় বসে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে হঠাৎ দেখে বেড়ার গায়ের দরজায় কে একটা লোক। গোধূলির আবছা আলোয় সিড়িঙ্গেপানা চেহারাটা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি, ভেবেছিল কোনও ছিঁচকে চোর মাচার ওপর থেকে চালকুমড়ো বা উঠোনের বেগুনগাছগুলো থেকে বেগুন চুরি করতে এসেছে। কিন্তু ‘চোর’ নিজেই সটান এসে পেন্নাম ঠুকে বলল, ‘এজ্ঞে আমি গোবিন্দ পিওন গো কত্তামশাই, একখান চিঠি আছে।’ চিঠি হাতে নিয়ে প্রথমটা একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল বুড়ো। ছোটশিবপুরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে কালেভদ্রে এক আধটা শুকনো ঝরাপাতার মতো পোস্টকার্ড আসে, আর বছরে বড়জোর দু’বার রানাঘাটে ছোটছেলের কাছ থেকে দুটো দিশি খাম---‘এবার পুজোয় ছুটি কম, আসতে পারব না।’ কিংবা ‘বাড়িতে অসুখবিসুখ যাচ্ছে, ধান বিক্কিরির টাকা একটু পাঠাও।’ ব্যাস, চিঠি বলতে এই। কিন্তু আজকের এটার ওপর তো ইংরেজিতে টাইপ করা ঠিকানা, গায়ে অচেনা ডাকটিকিট। খাম ছিঁড়তে বেরোল মজবুত, মসৃণ কাগজে সুন্দর হরফে ছাপানো একপাতার চিঠি। কে পাঠাল? কী বক্তব্য? বোঝার উপায় নেই, ইংরেজিতে লেখা যে। এ জিনিসের পাঠোদ্ধার এ বাড়িতে একমাত্র করতে পারত যে, সে তো রানাঘাটে। ছোটছেলে ছ’কড়িই এ-বংশে প্রথম কলেজ গ্র্যাজুয়েট। যদিও চাকরি বাকরি তেমন ভালো জোটেনি। বড়ছেলে বা বড়বউমা- কেউই ‘পেরাইমারি’ ইস্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। বড়নাতিটা অবশ্য মাদারিহাটের ইস্কুলে যায়, কিন্তু সেও তো সবে ক্লাস সিক্স। অতএব ভরসা বোসেদের বাড়ির গজেন ডাক্তার। তেঁতুলতলির মাঠটা যেখানে শেষ হয়েছে, ঠিক তার পাশেই দোতলা বাড়ি তাঁর। সকালবিকেল চেম্বার দেন। কিন্তু তাঁকে কি এই ভর সন্ধেবেলায় ফাঁকা পাওয়া যাবে? গাঁয়ের পোস্টমাস্টার রতন বাঁড়ুজ্জ্যেকে পেলেও হত, কিন্তু পোস্টাপিস এখন বন্ধ আর সে থাকে সেই জয়নগরে। তাহলে উপায়? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গায়ে ফতুয়াটা গলিয়ে নিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করে বাইরে বেরোয় বুড়ো। হাতে সেই চিঠি। আর দু-পা যেতে না যেতেই দুম-দড়াম-ধপাস। পেছন থেকে এসে মেরেছে এক সাইকেল। মেরে টাল সামলাতে না পেরে সোজা বটগাছের গুঁড়িতে গিয়ে ধাক্কা। আর বুড়ো সোজা রাস্তার পাশের নালায়। ‘উহ্ উহ্ উরিবাবারে মেরে ফেললে রে’ বলে কাতরাতে কাতরাতে নালায় শুয়েই শাপ-শাপান্ত করতে থাকে সাইকেল-আরোহীকে। আর আরোহীরও বেসামাল অবস্থা। বইখাতা সব ছড়িয়ে ছত্রখান, হেডলাইটের কাচ ভেঙেছে, স্পোক বেঁকেছে। কোনওরকমে প্যান্টের ধুলোটুলো ঝেড়ে এককড়িকে টেনে তুলে বলে, ‘সরি দাদু, সরি সরি, খুব লাগেনি তো? আসলে গোয়াল থেকে বাছুরটা এমন হুট করে বেরিয়ে এল, ওকে কাটাতে গিয়েই…’ তখন নজর পড়ল তার মুখের ওপর, আর পড়তেই ব্যথাবেদনা ভুলে একগাল ফোকলা হাসি বুড়োর। ওমা, এ যে রাজেন! গজেন ডাক্তারের বড়ছেলে, মাদারিহাট হাইস্কুলে বারো কেলাসে পড়ে। এ পথ দিয়ে রোজ সাইকেলে চেপে পড়তে যায়। এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া! ‘এট্টা কাজ করে দিবি বাপ? উহুহুহু। এই চিঠিটা এট্টু… ও মাগো’ বলতে বলতে কোনওরকমে বটতলার পাথরটায় এসে বসে। নালার নোংরা জলে আধভেজা খামটা হাতে নিয়ে হেডলাইটের আলোয় ধরে পড়তে থাকে ছেলেটা--- টু মিস্টার তিনকড়ি মণ্ডল, ভিলেজ ধুচনিখালি, পোস্ট অফিস অ্যান্ড পোলিস স্টেশন মাদারিহাট, ডিসট্রিক্ট –’। অধৈর্য হয়ে বুড়ো বলে, ‘ও সব ছাড়, মোদ্দাকথা কী কয়েচে সেটাই বল।’ ছেলেটা পড়তেই থাকে আর বিস্ময়ে তার চোখ ক্রমশ ছানাবড়া হতে থাকে, ‘ডিয়ার মিস্টার মণ্ডল, গ্রিটিংস ফ্রম চিকাগো ইল্-লি-নইস, ইউএসএ। হোপ দিস লেটার ফাইন্ডস ইউ ইন গুড হেলথ। দিস ইজ টু ইনফর্ম ইউ দ্যাট ইওর রিসেন্ট পারফরম্যান্স অ্যাট দ্য বড়গল্প
82 • June / July 2015 শান্তিনিকেতন পৌষমেলা অ্যান্ড লোকশিল্প উৎসব ইন বাঁকুড়া ডিড নট এসকেপ আওয়ার অ্যাটেনশন। উই ফাউন্ড দেম ফ্যাসিনেটিং। সো উই আর ডিলাইটেড টু-।’ ‘ওরে আমি কি তোর মতো ইনজিরি জানি বাপ? এট্টু সোজা করে বল না।’ ক ৌতূহলে কঁকিয়ে ওঠে বুড়ো এবার। সম্বিৎ ফিরতে ছেলেটা কোনওরকমে হাঁ-মুখ বন্ধ করে বলে, ‘ও দাদু এ তো ফাটাফাটি কাণ্ড! বাবাকে গিয়ে বললে বোমকে বিয়াল্লিশ হয়ে যাবে। তিনকড়ি কাকার তো হিল্লে হয়ে গেল! এইরকম একটা খবর---এইরকম একটা খবর তোমায় পড়ে দিচ্ছি, এবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমাদের ক্লাবকে একটু বেশি চাঁদা দিতেই হবে। বলে রাখলাম কিন্তু!’ বুড়ো এখনও ভ্যাবলা মুখ করে তাকিয়ে আছে দেখে ব্যাখ্যা করে, ‘তোমার বড়ছেলে গো, তিনকড়ি কাকা, তাকে আমেরিকা থেকে ডেকে পাঠিয়েছে।’ চমকে উঠে বুড়ো বলে, ‘কে-কে- কেন, ওর তো কোনও দোষ নেই বাপ! ছাপোষা মানুষ, চাষবাস আর বউছেলে নিয়ে থাকে। শুধু গেল বছর শীতে যখন রাতের পর রাত চোরে এসে খেজুর রসের হাঁড়িগুলোরে সাবার করে দিচ্চিল, পাড়ার ছেলেছোকরাদের নিয়ে থানায় গেছল নালিশ কত্তি। পইপই করে বল্লুম থানায় গিয়ে অত চোটপাট করিসনি, এখন বোঝ ঠ্যালা।’ মুচকি হেসে রাজেন বলে, ‘আরে দূর, ওসব নয়। তোমার ছেলেকে ওখানকার বাঙালিরা দুর্গাপুজোয় গাইতে ডেকেছে। প্লেনে করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে গো, ড্যাং ড্যাং করে আমেরিকা ঘুরে আসবে তিনকড়ি কাকা। উহ্, কী লাক মাইরি তোমার!’ ৭কাহন লাক জিনিসটা ঠিক কী, এককড়ি বুঝলই না সারাজীবন। যতটুকু যা পেয়েছে, সবকিছুর জন্যি চড়া দাম দিতে হয়েছে। ছেলেবেলায় ওলাওঠার মড়কে বাপ-মা মরল যখন, একরত্তি বোনটাকে নিয়ে অনাথ হল। বয়স তখন কত আর--- তেরো কি চোদ্দো। আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই ত্রিসীমানার মধ্যে। সম্বল বলতে কয়েক ছটাক জমি। তারপর কম ঘামরক্ত ঝরাতে হয়েছে পায়ের নীচে একটু মাটি পাবার জন্য? খেতমজুরি, দিনমজুরি, মুটেগিরি, বাবুদের ফাইফরমাশ---কোনও কিছুই বাদ রাখেনি। কিন্তু বোনটাকে কোনওদিন লোকের বাড়ি ঝিগিরি করতে পাঠায়নি। যত্ন করে আগলে রেখেছিল। সাধ ছিল ডাগর ডোগর হলে একটা মোটামুটি ভালো ঘর দেখে পাত্রস্থ করবে। হায়, নিয়তির এমনই খেলা, শালুকদিঘিতে চান করতে গিয়ে একদিন পায়ে শামুক ফুটিয়ে বাড়ি ফিরল মেয়ে। নেহাতই ছোটখাটো ব্যাপার, কিন্তু সেই থেকেই সেপ্টিক হয়ে সাতদিনের মাথায়…। এ ঘটনার পর কেমন যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে দিনরাত একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত এককড়ি। কেউ ডাকলেও সাড়া দিত না, বাচ্চারা পাগল ভেবে ঢিল ছুড়ত। সত্যিই হয়তো পাগল হয়ে যেত শেষমেশ, যদি না গাঁয়ের কামারবাড়ির বড় বউ তাকে ছেলের আদরে ঠাঁই দিত নিজের ঘরে। কামারের ছেলে ছিল তার ছেলেবেলার খেলার সাথী। রাঢ় বাংলার গ্রাম বলে কথা, সম্বৎসর কত বাউলের আসা যাওয়া। শীতকালে তারা টুংটাং একতারা বাজিয়ে মিঠে রোদে হলুদ সর্ষে খেতের আল ধরে গাইতে গাইতে যেত, আর দুই বন্ধু যেত তাদের পিছু পিছু। এভাবেই আস্তে আস্তে বাউলগান শেখা। একতারা বাজানোয় হাতেখড়ি ওই বাউলদের কাছেই, তাদের ডেরায় গিয়ে তাদের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে। যাই হোক, সেই টালমাটাল অবস্থা কাটিয়ে ঘরসংসারে মন ফেরানোর রাস্তা কামার বউই করে দিয়েছিল। কামারবাড়ির ছোটমেয়ের তখন সবে বিয়ের বয়স হয়েছে। দাদার বন্ধুকে দেখলে লজ্জায় আড়ালে চলে যায়, হাজার প্রশ্ন করলেও মুখে রা কাড়ে না। সেই কমলীর হাত একদিন তার হাতে সঁপে দিয়েছিল কামারগিন্নি, বলেছিল, ‘আমার এই আদুরে, মা-ন্যাওটা মেয়েটাকে যত্নে রাখিস বাবা, দেখিস তোর ঘর আলো করে থাকবে।’ তা ছিল সে---যতদিন বেঁচে ছিল, স্বামীর ঘরে মঙ্গলময় লক্ষ্মীর মতোই ছিল। সত্যি, ‘লাক’ বলে তার জীবনে যদি আদৌ কিছু থেকে থাকে, সে হল কমলী। ক্রমে কুঁড়েঘরের দেয়াল পাকা হল, মাথায় টালির চাল হল, আর কোল আলো করে এল তাদের প্রথম সন্তান। বংশের ধারা অনুযায়ী নাম রেখেছিল তিনকড়ি। তিনজনে মিলে তখন সুখের সাগরে ভাসছে। কমলার তখন কী দাপট! এক হাতে ছেলে সামলাচ্ছে, অন্য হাতে হেঁসেল। আস্তে আস্তে বড় হল ছেলে, চাষবাসের কাজে বাপের হাতনুরকুর হল। ইতিমধ্যে অবশ্য তার একটা ছোটভাই হয়েছে। তো বাপের সঙ্গে সঙ্গে খেতে কাজ করতে করতে তার গলাতেই শুনে শুনে একদিন তিনকড়িও শিখে ফেলল বাউলগান। শুধু শেখা নয়, তার কচি মিষ্টি গলা যে শুনত তার প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কতরকমের গান যে গাইত তারা দু’জনে মিলে। ‘ভোর হইল জগৎ জাগিল চেতনে চাহিল নারীনর’, ‘ওরে বনের পাখি গান গেয়ে যাস মনের খাঁচাতে’, ‘ও দয়াল আজ আছি কাল নাই পদ্মপাতার জল’, ‘এই রাঙামাটি সোনা খাঁটি, এরে লয়েই প্রেমপিরীতি এরে লয়েই ঝগড়াঝাঁটি’ ইত্যাদি হরেক কিসিমের বাউলগানে কেটে যেত তাদের সকালগুলো। মাঝে মাঝে এককড়ি ভাবত, যে ছেলের এরকম গলা তাকে আর লাঙ্গল-জোয়াল- কাস্তে ধরতে হবে না, সে গানেই মন দিক। কিন্তু তারপরেই নিজেকে বোঝাত, শুধু বসে বসে গান করলেই পেট চলবে? বাপ আর কদ্দিন? নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সংসারী হতে হবে না ছেলেকে? তাই হল সে। জোয়ান হতে না হতেই একটা টুকটুকে বউ দেখে তার বিয়ে দিয়ে দিল এককড়ি। বছর না ঘুরতেই নাতির মুখও দেখে ফেলল। তবে ওই যে বলে না, নিয়তি যেমন দেয় তেমনই আবার কেড়েও নেয়? তার জীবনের সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, তার চির-আদরের কমলা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেনি। মেয়েটা হবার সময় কী সব জটিল স্ত্রীরোগে ভুগছিল, প্রসবের পর আর চোখ মেলেনি। এখানেই শেষ নয়। সংসারের ঘানি পিষতে পিষতেও গানের শখটা দিব্যি বাঁচিয়ে রেখেছিল তিনকড়ি। প্রতিবছর অঘ্রাণে নবান্নের সময় মাদারিহাট বটতলায় বাউলগানের আসর বসত। সেখানে সে গাইত। এভাবেই বছর দুয়েক আগে কৃষ্ণদাস বাউলের চোখে পড়ে যায়। অতঃপর তার দলের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় আর বিষ্ণুপুরের লোকশিল্প উৎসবে গাইতে যাওয়া। সাইকেলের গুঁতোয় মচকানো আর কাটাছেঁড়া জায়গাগুলোয় চুনহলুদ দিতে দিতে এককড়ি ভাবে, আচ্ছা, ওই সব মেলায় আর মোচ্ছবে যে শহুরে বাবুরা মেয়েদের মতো লম্বা-লম্বা চুল বা কানে দুল নিয়ে, আর পাশে ব্যাটাছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্টালুন পরা মা জননীদের নিয়ে, তার ছেলের গান শুনে ‘ওয়াও ওয়াও’ করে আর মোবাইলে ফটাস ফটাস ছবি তোলে, তারা এতকিছু ইতিহাস জানে? না বোধহয়। জানলে ছেলের সঙ্গে বাপেরও কদর করত, সুখ্যেত করত। সে যাকগে যাক, এখন আবার মাথায় নতুন দুশ্চিন্তা ঢুকল। আমেরিকা। কোথায়, কোন চুলোর দোরে সে দেশ---কে জানে! সেখানকার বাবুদের এত লম্বা কান যে বোলপুর-বিষ্ণুপুরে বসে তার ছেলে কী গান গাইল বা না গাইল, সব শুনে ফেলল? গজেন ডাক্তারের ছেলেটা বলছিল আমেরিকায় যারা যায় তারা নাকি আর ফেরে না! এ আবার কী অলক্ষুণে কথা। ওটা কি তবে ছেলেধরা, জহ্লাদ বা রাক্ষস-খোক্কসের দেশ? নাহ্, ওই চিঠির কথা ছেলের কানে এক্কেবারে তোলা চলবে না। থাক ওটা শেতলপাটির তলায় লুকোনো। নতুন জীবন পেয়ে এককড়ির তখন কী জোশ! তাগড়া জোয়ান চেহারায় বাপের রেখে যাওয়া দো-ফসলি জমিতে লাঙল দিচ্ছে, একাই গরুর গাড়ি বোঝাই করে সে-ফসল তুলে দিয়ে আসছে ‘গরমেন্টের’ গুদামে বা হিমঘরে, কড়ুঁ েঘরটার চারদিকে বেড়া দিয়ে বাগান করে লাউটা কমড়োট ু া ঝিঙেটা মলোট ু া ফলাচ্ছে, শালুকদিঘি তোলপাড় করে গামছায় ধরে আনছে ইয়া বড় বড় মাছ। somehow I cannot highlight this word. please put জন্যই instead of জন্যি
June / July 2015 • 83 গল্প ৯, সত্যি শীতলপাটি কেন, মাটি খুঁড়ে তার তলায় পুঁতে রাখলেও চিঠি-প্রসঙ্গ গোপন রাখা যেত না তিনকড়ির কাছ থেকে। গঞ্জের বাজার থেকে ফেরার পথে তেঁতুলতলির মাঠে ছেলেদের জটলায় কথাটা প্রথম তার কানে যায়। তারপর সে ছুটতে ছুটতে এসেছে বাকিটা পথ, উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। ধপাস করে বাজারের থলিফলি নাবিয়ে রেখেই বলে, ‘কই দাও, একবার দেখি, দেখে চক্ষুসাথ্থোক করি।’ অন্যমনস্ক হবার ভান করে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে এককড়ি একথা সেকথা তোলে---বাগানের দিকের দরমার বেড়াটা ভেঙে আজও ছাগল ঢুকেছিল, পাঁচুগোয়ালাটা রোজ দুধে এত্তটা করে জল মেশাচ্ছে, এইসব। ছেলে আর ধৈর্য রাখতে পারে না, ‘ধ্যাত্তেরি, চুলোয় যাক ওসব, চিঠিখান আগে বার করো।’ ‘কীসের চিঠি?’ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে এককড়ি। ‘মানে? আমার নামে একখান চিঠি তুমি গজেন ডাক্তারের ছেলেকে দিয়ে পড়াওনি?’ বলে বুড়োর বালিশের তলা, ফতুয়ার পকেট, শীতলপাটি হাতড়াতে থাকে ছেলে। ‘ও-চিঠি নিয়ে খবরদার মাতামাতি করবিনি তিনু, তোর মায়ের দিব্যি, ও এক সব্বোনেশে চিঠি।’ ‘কী আবোলতাবোল বকছ? সাতজম্মো ধরে পুণ্যি করলে, চোদ্দোপুরুষের ভাগ্যি হলে তবে লোকে আমেরিকা যেতে পারে। সে-ডাক দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে, আর তুমি বলছ সব্বোনেশে?’ ‘চুপ কর! ছেলেপুলে বড় হলে তারা এমনি অকেতজ্ঞ হয়ে যায়। ঘরে সতীলক্ষ্মী বউ, চাঁদপানা ছেলে, কোলেপিঠে করে মানুষ করা বাপ---তাদের ফেলে তিনি চললেন নিরুদ্দেশে।’ ‘আচ্ছা ফ্যাসাদ তো, আমেরিকা নিরুদ্দেশ হতে যাবে কেন? বুড়োমানুষের কাণ্ডজ্ঞান বলে যদি কিছু থাকে? এই তো পেয়েছি,’ বলে চিঠিখানা শীতলপাটির তলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে খাম খোলে তিনকড়ি। জলে ভিজে ফুলেফেঁপে ওঠা কাগজটায় পরম আদরে হাত বোলাতে বোলাতে আপনমনে বিড়বিড় করে, ‘তা ছাড়া যাব বললেই কী আর যাওয়া যায়! কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, এখানে ওখানে ছোটাছুটি করতে হয়, টেরেনিং লাগে। জিজ্ঞেস করো না ও পাড়ার বিষ্টু ধরকে! তার ভায়রাভাইয়ের মেজোপিসির ছোটননদের বড়ছেলে দু’বচ্ছর লেখাপড়া করেছে ওদেশে। হুঁ হুঁ বাবা অত সস্তা নয়।’ বাপ তখনো গোমড়া মুখে গোঁজ মেরে বসে আছে
84 • June / July 2015 দেখে তার কাছে গিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ‘দেখো না, একবারটি যদি ওখানকার বাবুদের খুশি করে আসতে পারি, বরাত খুলে যাবে। এ ঘর দোতলা হবে, ছেলেটারে একখান সাইকেল কিনে দেব, ওর মায়ের কদ্দিনের শখ একজোড়া মুক্তো বসানো দুলের, তোমার ওই হাড় মড়মড়ে খাটিয়াটা বাতিল করে ভালো একখান চৌকি…’। ‘হুহ্, সব হবে তোর! গুষ্টির পিণ্ডি হবে,’ বলে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায় বুড়ো। রূপনারায়ণপুরে বিষ্টু ধরের ভায়রাভাইয়ের বাড়ি যেতে-আসতে সময় লাগে অনেক। সকাল সকাল দুটো পান্তাভাত নাকে-মুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েছিল তিনকড়ি, ফিরল সেই মাঝবিকেলে। দাওয়ায় কাঁধের ঝোলাটা নাবিয়ে পা থেকে চটিটা খুলতেই বউ এসে বলল, ‘কী এমন জামাই আদর কল্লে গো তারা যে সারাদিন তাদের ওখানে হত্যে দিয়ে পড়ে রইলে?’ ‘ওসব তুই বুঝবি নে, অনেক দরকারি কথা ছিল। এখন কত কাজ! আগে পাসপোট করাতে হবে, তারপর বিছা।’ ‘হ্যাঁগো, পুঁটির মা গজেন ডাক্তারের বাড়ি কাজ করে তো, ও বলছিল ডাক্তার গিন্নির মুখে শুনেছে ওদেশে নাকি মেমসাহেবরা রাস্তায় হিরের গয়না পরে ঘুরে বেড়ায়?’ ‘ওহ্, সব মেয়েমানুষের মুখে সেই এক রা, গয়না আর গয়না। এদিকে আমার এখন হাজার জ্বালা। ওখানকার বাবুদের একখান খবর অবধি দেওয়া হয়নি যে আমি যাচ্ছি। কী করে যে দিই…’ ‘কেন, মাদারিহাট পোস্তাপিস থেকে একখান পোস্তকাঠ ছেড়ে দাও না।’ ‘উহ্, অত্ত সোজা, এখানকার পোস্তকাঠ ওখানে ঢুকতে পাবে? দেখি কাল মাদারিহাট ইস্টিশানের কাছে সুজন মাস্টারের বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে। জেলেপাড়ার খেন্তিপিসির যখন পা পিছলে কোমরের হাড় ভেঙে গেছল, সিউড়ির জেলা হাসপাতালে ঠাঁই হল না, কলকাতার হাসপাতালের সঙ্গে খবরাখবর সব সুজন মাস্টারই করেছিল।’ এমন সময় লাঠি ঠুকঠুক করে বাপকে ঢুকতে দেখে এবার তাকে নিয়ে পড়ে তিনকড়ি। বিষ্টু ধরের ভায়রাভাই বলে দিয়েছে, পাসপোর্ট করতে লাগবে বার্থ সার্টিফিকেট আর ভিসা করতে জমিজমা বসতবাড়ির দলিল-দস্তাবেজ। বাপকে জিজ্ঞে করে, ‘আচ্ছা, আমার জন্মের কোনও প্রমাণপত্তর আছে?’ ‘এ আবার কী বেআক্কেলে কতা!’ আকাশ থেকে পড়ে এককড়ি, ‘জম্মো না হলে এখন এখেনে দাঁড়িয়ে কপচাচ্ছিস কী করে?’ ‘ধূর ছাই, সে কথা নয়, কোনও সাট্টিফিট-টাট্টিফিট আছে, কবে কোন সময়ে জন্মেছিলাম কার গভ্ভে, বাপের নাম কী…’ ‘কী! এই ভর সনঝেবেলা এত বড় কতা বলতে পাল্লি?’ রাগে ফেটে পড়ে এককড়ি, ‘কার গভ্ভে জন্ম, বাপের নাম কী! হতচ্ছাড়া জানোয়ার! আজীবন অনেক লোকে অনেক কতা কয়েচে এই এককড়ি মণ্ডলেরে নিয়ে, কিন্তু কারও বাপের খ্যামতা হয়নি তার ধম্মোপত্নীরে নিয়ে কোনও অপবাদ…’ ‘ওহ্, ভগবান! মুখ্যু লোকের সঙ্গে কথা কওয়াও ঝকমারি! যাকগে, ছাড়ো ওসব। এখন বলো আমাদের এই একতলা কোঠাঘর আর লাগোয়া জমি--- এসবের দলিল-টলিল কিছু আছে, নাকি সে সবেরও পাট নেই?’ ‘বলি ব্যাপারখানা কী ঝেড়ে কাশ তো! সাতসকালে রূপনারায়ণপুরে উকিলের বাড়ি ছুটলি, সেখান হতে ফিরে এসেই দলিলের খোঁজ কচ্ছিস। মতলব তো ভালো ঠেকচে না! একটা কতা পোষ্কার শুনে রাখো চাঁদ, আমি বেঁচে থাকতি যদি বাপের সম্পত্তি নিয়ে মায়ের পেটের ভাইবোনের সাথে কামড়াকামড়ি করো, আমি সোজা জয়নগরের নারায়ণ মন্দিরে সব দেবোত্তর সম্পত্তি করে দিয়ে আসব। আমারে চেনোনি তুমি! হুঁহ্।’ সেই সন্ধের এমনতরো কথোপকথনের পর বার্থ সার্টিফিকেট বা দলিলের ব্যাপারে আর বাপকে না ঘাঁটিয়ে তিনকড়ি গেল মাদারিহাটে সুজন মুখুজ্যের বাড়িতে। পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে মাস্টারমশাই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘হুমম, অফারটা তো বেশ ভালোই পেয়েছ হে। গানটা তোমার ঈশ্বরপ্রদত্ত স্কিল, এখানে কে আর তেমন অ্যাপ্রিশিয়েট করে? বিদেশে যে এর একটা মার্কেট ভ্যালু রয়েছে, শুনে ভালো লাগল। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কমপ্লিকেটেড---প্রতিটা স্টেপে প্রবলেম। আচ্ছা, দেখা যাক কী করা যায়। আপাতত তুমি চিঠির একটা রিপ্লাই তো পাঠিয়ে দাও। বাই পোস্ট পাঠালে অনেক সময় লাগবে। তার চেয়ে টুকুনকে বলছি, ও ইমেল করে দেবে। অ্যাড্রেসটা দাও।’ ‘আজ্ঞে, এই যে’ বলে ছেঁড়া খামটা বাড়িয়ে দেয় তিনকড়ি। ‘না, না, ওই অ্যাড্রেস নয়, ইমেল অ্যাড্রেস,’ হেসে ফেলেন মাস্টার। ‘ভেতরের চিঠিতে সে সব কোনওকিছু ছিল না? দাঁড়াও, আমি দেখছি। এই তো – বিএজিসি অ্যাট দি রেট অফ ইয়াহু ডট কম। মাদারিহাটে তো ইমেলের ব্যবস্থা নেই, টুকুন কালই আবার কলেজে ফিরছে, ওখান থেকে করে দেবে। অ্যাই টুকুন, টুকুন রে…’ বলতে বলতে বাড়ির ভেতর সেঁধোন মাস্টার, আর তিনকড়ি মনে একরাশ চিন্তা নিয়ে বসে থাকে। টুকুন, অর্থাৎ সুজনবাবুর ছেলে দেবাশিস, পড়ে বিশ্বভারতীতে। ওখান থেকে ওই ‘ইমেল’
June / July 2015 • 85 না ‘ফিমেল’ করলে পৌঁছোতে কত দিন লাগবে? সে-জিনিস কি কলকাতা হয়ে যাবে? তাহলে কলকাতায় মাস্টা্রমশাইয়ের যিনি জানাশ�োনা আছেন, তালতলা ইস্কুলের হেডমাস্টার, তাঁকে টেলিফোন করে বলে দিলেই তো পারতেন। তিনি পাঠালে হয়তো দু-এক দিন কম লাগত। যাই হোক, একজন বিদ্বান লোকের মুখের ওপর তো কথা বলা যায় না, তাঁর সিদ্ধান্তই শিরোধার্য। মাস্টারমশাই খানিক বাদে গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে আর হাতে ব্যাগ-ছাতা নিয়ে বললেন, ‘খেয়েদেয়ে বেরিয়েছিলে তো বাড়ি থেকে? চলো, তোমায় নিয়ে একবার সিউড়ির সদর দপ্তরে ঘুরে আসি। সন্ধের আগেই ফিরব।’ সিউড়ি সদরে যাবার কারণ মাস্টারমশাইয়ের ছোট শালা ওখানে মোটামুটি উঁচু পোস্টে কাজ করেন। তিনি যদি এই বার্থ সার্টিফিকেট আর দলিলের ব্যাপারে কোনও সুরাহা করতে পারেন। এখন মুশকিল হচ্ছে, এ পোড়া দেশে যে কোনও সমস্যার সমাধানের ‘রাহা’-কে ‘সু’ করতে গেলে হয় পকেটে মালকড়ির জোর থাকতে হবে, নয়তো পলিটিক্যাল কানেকশন, অথবা দুটোই। থাকলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়, না থাকলে গরুও বলে দুধ দেব না। তিনকড়ির সেসব আর কোথায়? সদরে গিয়ে মাস্টারমশাইয়ের শালার মুখে শুনল, হ্যাঁ, বার্থ সার্টিফিকেট হয়ে যাবে, শুধু জন্মদিন বা জন্মস্থান কেন---বাপ-মায়ের নামও ইচ্ছেমতো বেছে নেওয়া যাবে। কিন্তু অনেকদিন আগেকার ব্যাপার তো, প্রমাণ-টমাণ নেই, সাক্ষীসাবুদ নেই, তাই কয়েকটা বিশেষ বিশেষ জায়গায় কিছু ‘মাল্লু’ ইনভেস্ট করতে হবে। টাকার অঙ্কটা শুনে চমকে উঠলেও তিনকড়ি মনে মনে ভাবে, বাহ্, বেড়ে মজা তো! টাকার জোর থাকলে সে কি তাহলে কলকাতায় জোড়াবাগান না জোড়ামন্দির---কোথায় যেন রবি ঠাকুরের ভিটে---সেখানে ঠাকুর বংশে জন্মেছে বলেও দাবি করতে পারত? নাকি পদবিটা নিদেনপক্ষে ঠিক রাখতে হবে? যাই হোক, জমি-বাড়ির দলিলের ব্যাপারে অবিশ্যি আশাভরসা তেমন পাওয়া গেল না। ওটা নাকি ‘ভেতর’ থেকে বের করে আনতে হয় আর, পার্টির ওপরমহলের লোকজনের হস্তক্ষেপ চাই। জানাশ�োনা না থাকলে জেলার সদর দপ্তরে বসে চট করে কিছু করা শক্ত। শেষে মাস্টারমশাইয়ের অনুনয়ে আর বোধহয় তিনকড়ির করুণ মুখ দেখে দয়াপরবশ হয়ে শালাবাবু কলকাতায় পার্টি অফিসের এক চেনাজানা লোকের নামঠিকানা দিলেন আর বার্থ সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কিছু কমে রফা করলেন। ঝামেলা এড়াতে বাপকে গোপন করে সারা মাসের সংসার খরচের টাকা থেকে কিছুটা আর গেল অঘ্রাণের ধান বিক্রির টাকা থেকে কিছুটা ‘ম্যানেজ’ করে বার্থ সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা কিছুটা সামলেছিল তিনকড়ি। আর দলিলের ব্যাপারটার শেষ অবধি যদি ফয়সালা না-ই হয়, তাহলেও কী করে ‘বিছা’ করার সময় দেশে ফেরার পিছুটানের প্রমাণ দেবে সাহেবদের- --সে বিষয়ে ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বার করেছিল। কিন্তু তার আগে তো পাসপোর্ট হাতে পাওয়া চাই। এমনিতে তার জন্য কলকাতা যাওয়ার দরকার নেই, জেলা সদরে বসেও করা যায় অ্যাপ্লিকেশন। কিন্তু সুজন মাস্টারের পরামর্শে তিনকড়ি ঠিক করল কলকাতাতেই যাবে, কারণ তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। দলিলের ব্যাপারে সেই পার্টির বাবুর সঙ্গেও দেখা করে আসবে, আবার পাসপোর্টটাও একটু তাড়াতাড়ি মেলবার সম্ভাবনা। এখন সমস্যা হল দুটো। প্রথমত, কলকাতা যাবার নাম শুনেই বাচ্চা ছেলেটা নেচে উঠেছে, সে টেরামে চড়বে আর গঙ্গার নতুন বিরিজ দেখবে। বউও ছাড়বার পাত্রী নয়, তার বায়নার তালিকায় কালীঘাটে মায়ের মন্দির দর্শন আর ঠান্ডা মেশিনঅলা সিনিমা হলে সিনিমা দেখা। তিনকড়ি এখন কী করে বোঝায় সে ফূর্তি করতে যাচ্ছে না, যাচ্ছে জরুরি কাজে, আর ওসবের জন্য সময় বের করা অসম্ভব? শেষে অনেক তর্জন গর্জন কান্নাকাটির পর রফা হল ও কলকাতা থেকে ফিরে এসেই সিউড়ির ফ্যান্সি মার্কেটে বউকে কেনাকাটা করতে নিয়ে যাবে আর ছেলেকে চালধানি ট্যাঙ্কে নৌকা চড়াবে। দ্বিতীয়ত, সে নিজেই চিরকাল অজ পাড়াগাঁয়ে জীবন কাটিয়েছে, শহর বলতে বড়জোর বোঝে মাদারিহাট আর সিউড়ি। কলকাতার অথৈ জনসমুদ্রে উত্তুঙ্গ ব্যস্ততার ভিড়ে অজানা-অচেনা রাস্তাঘাটে একা একা সামলাতে পারবে? থাকবে কোথায়? খাবে কী? রানাঘাটের ভাইকে বলল সঙ্গে যেতে, তার নাকি আবার সেই ক’টা দিনই লালগোলায় জরুরি কাজ। আসলে হিংসে, হিংসে! দাদার ভালো কোনওদিন দেখতে পারে ওই কুচুটে ছেলে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল হয় তিনকড়ির, রূপনারায়ণপুরের সেই উকিলবাবুর মেজোপিসির ছোটননদ তো কলকাতাতেই থাকে, যার ছেলে আমেরিকায় পড়েছে। শুনেছে অবস্থাপন্ন ঘর, বড় বাড়ি। একবার উকিলকে গিয়ে ধরলে হয় না, যদি ক’টা দিন ওই বাড়ির এককোণে একটু ঠাঁই হয়? ‘বিছা’র ব্যাপারে সেই আমেরিকা-ফেরত সাহেবের কাছ থেকে একটু জেনেটেনেও নেওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সুজন মাস্টারের ছেলে তো কলেজ থেকে ফর্ম-টর্ম সব ডাউনলোড করে ছাপিয়ে এনে দিয়েছে। সেগুলো আর অন্য সব দরকারি নথিপত্র ঝোলা ব্যাগে নিয়ে একদিন সকালে আবার হাজির রূপনারায়ণপুরে। উকিলবাবু ব্যস্ত মানুষ, তাঁর তো টিকিটিও দেখা গেল না সারাদিন। তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ের সাহায্য না পেলে ওই ফর্ম ঠিকঠাক ভর্তি করা কি আর ওর সাধ্যে কুলোত? এখন শুধু মাদারিহাটের শ্রীমা স্টুডিও থেকে দুটো ছবি তুলিয়ে সেঁটে দিলেই ব্যাস। সন্ধের মুখে বাবু বাড়ি ঢুকতে তাঁর কাছে আমতা আমতা করে কলকাতার কথাটা পাড়ল। আর কী ভাগ্য, শুনল ও বাড়ি এখন ফাঁকা, তারা সবাই দার্জিলিং বেড়াতে গেছে, আছে শুধু এক কেয়ারটেকার। উকিলবাবুর চিঠি নিয়ে গেলে কেয়ারটেকারের ঘরে দু-চারদিন থাকার কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু তাই নয়, এই হপ্তাতেই উকিলবাবুর ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট কলকাতা যাচ্ছে একটা দরকারি কাজে, ও চাইলে সঙ্গে যেতে পারে। খুশিতে ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল ও সে- রাতে, যেন তখনই আমেরিকার আদ্ধেক পথ পৌঁছে গেছে। আমেরিকার সেই পথই আবার লক্ষ কোটি যোজন দূর মনে হল হাওড়া ইস্টিশনে নেমে। সেই কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, সারাদিন ট্রেনেই কাটল। কামরায় কী ভিড়, কী ভিড়! দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। শুধু এরই মধ্যে একবার মনটা একটুখানি নেচে উঠেছিল, যখন একজন ভিক্ষে করতে উঠে গাইছিল, ‘ও তুই প্রেমসাগরের নাইয়া, কোন কূলে ভিড়াবি তরী কোন দ্বীপেতে যাইয়া’। তার ছেলেবেলার অতি পরিচিত গান, ভরা বর্ষায় টইটম্বুর অজয় নদের বুকে দাঁড় বাইতে বাইতে মাঝিরা গাইত। এখন বিকেল, পেটে দানাপানি নেই, ছুঁচোয় ডনবৈঠক দিচ্ছে। কিন্তু খাওয়ার চিন্তা মাথায় উঠেছে, আগে তো সেই বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। প্ল্যাটফর্মের গিজগিজে জনস্রোত ঠেলে অতি কষ্টে নিজের বেঢপ ট্রাঙ্কটাকে মাথায় নিয়ে সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরার সঙ্গে যখন প্রিপেড ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পৌঁছোল, দেখল স্ট্যান্ড ফাঁকা। কী ব্যাপার? না সবাই ‘নবান্নে’র মাঠে গেছে ‘দিদি’র ডাকে। ‘দিদি’ কে তা আর বলে দিতে হবে না, এই বঙ্গের প্রতিটি মশামাছি জানে। কিন্তু ওই ‘নবান্ন’র ব্যাপারটা তিনকড়ির ঠিক বোধগম্য হল না। এই ভরা চৈত্তির মাসে আবার নবান্ন কী? সে তো হয় অঘ্রাণে। কে জানে বাবা, জাঁদরেল এই শহরের নিয়মকানুনই বোধহয় আলাদা। বেশি পয়সা নেওয়া বেআইনি ট্যাক্সি ছিল কিছু, গন্তব্যস্থলের ঠিকানা দেখাতে তারা বলল, ওখানে এখন যাওয়া যাবে না, ‘দাদা’কে জেলে পোরার প্রতিবাদে ধর্ণা আর পথ অবরোধ চলছে। হাত-পা টনটন করছে, গায়েগতরে ব্যথা, তবু তিনকড়ি ভেবে খুশি হয়---এ শহরের লোকের হৃদয়ে অনুভূতি বলে এখনও কিছু আছে তাহলে। দিদি-দাদা-ভাই-বোন এদের সুখ-দুঃখে বিপদে আপদে মানুষ পাশে না দাঁড়ালে আর কে দাঁড়াবে? অগত্যা সঙ্গের সেই ছোকরার বুদ্ধিতে একটা আধখালি বাসে টুক করে উঠে জানলার ধারের সিট দখল করে বসে। আর বাস চলতে শুরু করলে অবাক বিস্ময়ে দু’চোখ ভরে দেখতে থাকে শহরের রূপ। এত মানুষ! এত গাড়ি! এত হইচই! এত বিরাট বিরাট বাড়ি! ‘দাদা, টিকিটটা বাড়াবেন, টিকিটটা। একী, এই ধাম্বাল বাক্সটা নিয়ে অফিসটাইমের বাসে উঠেছেন? কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই? এক্সট্রা ভাড়া লাগবে’---কন্ডাক্টরের ধমকানিতে চমক ভাঙে তার। বাড়তি ভাড়া গুনে দিতে দিতে নিজের মনে হাসে---মফস্সলের হাড়
86 • June / July 2015 জিরজিরে বাসগুলোয় সবজির ঝুড়ি, মাছের ঝুড়ি মায় মুরগি, ছাগল অবধি নিয়ে যারা নিত্য যাতায়াত করে, ডেরাইভার না তুলতে চাইলে চোটপাট করে, তারা এখানে এলে করত কী! প্রায় দেড় ঘণ্টা ঢিকির ঢিকির করে চলে সেই বাস যখন যশ�োর রোডের টার্মিনাসে তাদের উগরে দিয়ে নিশ্চল হল, তখন প্রায় সন্ধে নেমেছে। রাস্তার দু’ধারের ত্রিফলা আলোগুলো সার দিয়ে জ্বলে উঠছে, বিশাল বিশাল সাইনবোর্ডে রঙিন নিয়ন ঝলমল করছে। তেমাথার মোড়ে গান্ধির স্ট্যাচু, তিনদিকের তিন রাস্তার ফুটপাথের গা ঘেঁষে হরেক রকমের দোকান---খাবারের, ওষুধের, মুদিখানার, জামাকাপড়ের। ইস্, এখন মনে হচ্ছে বউ-ছেলেটাকে যদি একটিবারের জন্যও আনতে পারত! কোথায় লাগে এর কাছে রাণাঘাট? কোথায় লাগে সিউড়ি? ‘কী দাদা, কেমন বুঝছ? একটু চা-টা খাবে? এখনও কিছু রাস্তা বাকি’, পাশ থেকে বলে ওঠে ছোকরাটা। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনকড়ি বলে, ‘নারে ভাই, বরঞ্চ পেটটা একটু খালি করতে পারলে আরাম পাই।’ ‘এই মরেচে, এখন এই বড় রাস্তার মোড়ে পাবলিক টয়লেট কোথায় পাই? খুব জোর পেয়েছে? বড় না ছোট?’ ‘আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আমরা গাঁয়ের মানুষ, আমাদের ওসব লাগে-টাগে না। ওই তো, ওই দেয়ালের ধারে অন্ধকার জায়গাটায়…’ ‘খেপেছ? দেখছ না বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’? পাশে আবার মহাপুরুষদের ছবি। রাস্তায় খোঁচড় ঘোরে এখানে, দেখতে পেলে ক্যাঁক করে ধরবে।’ ‘কী ঘোরে?’ ‘যাক গে বাদ দাও, এসো পা চালিয়ে, একটা অটো ধরি,’ বলে রাস্তার প্রায় মাঝখানে চলে গিয়ে হাত নেড়ে ছুটন্ত অটো থামানোর চেষ্টা করে সে। অধিকাংশই দুরন্ত গতিতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেও একটা এসে থামে খ্যাঁচ করে। গন্তব্য শুনে রুক্ষভাবে বলে, ‘ওই গলিতে অটো ঢোকে না। মৃণালিনীর মোড়ে নামতে হবে আর মাল নিয়ে উঠেছেন, ডবল ভাড়া লাগবে’। ক্লান্তি, খিদেবোধ, প্রকৃতির ডাক---সব মিলিয়ে এমন অবস্থা ওদের যে দরাদরি বা তর্কবিতর্কের প্রশ্নই ওঠে না। যেতে যেতে তিনকড়ি ভাবে, মাদারিহাট আর সিউড়িতে অটো আর টুকটুক তো কম দেখেনি। তারা কি কেউ আশপাশের লোকজনকে তোয়াক্কা না করে এমন ঝড়ের বেগে বেপরোয়া চালায়? কলকাতার ব্যাপারই আলাদা। সারাদিনের জার্নির ধকলে মড়ার মতো ঘুমিয়েছিল ওরা সে রাতে। কেয়ারটেকারের ডাকে ধড়মড় করে উঠে তিনকড়ি দেখে সে ভাঁড়ে করে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা গাঁয়ের বাড়িতে তার বউয়ের মতোই। তফাতের মধ্যে এই যে, জানলার বাইরে সবুজ গাছগাছালির বদলে ইট-কাঠ-সিমেন্টের জঙ্গল আর পাখির কিচিরমিচিরের বদলে গাড়িঘোড়ার হর্ন। লোকটা ভালোই করল থেকে দিয়ে, দশটার মধ্যে পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছোতে হবে। এখান থেক কম দূর নয়। বাস বদলে বদলে যাওয়া। তার ওপর আবার অফিস টাইমের ভিড়ভাট্টা। যাই হোক, ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে, সেদিন সকালে কিন্তু জ্যামে পড়তে হল না ওদের। রাস্তাঘাটেও কোনও গণ্ডগোল ছিল না। বরং একটা মজার অভিজ্ঞতা হল---আকাশপথে যাওয়া। যশ�োর রোড দিয়ে ভিআইপি রোডে পড়ে বাসটা খানিকক্ষণ বাদেই হুস করে উঠে গেল একটা উড়ালপুলে। সেই উড়ালপুল থেকেই ডাইনে- বাঁয়ে শাখা বেরিয়েছে, তারই একটা ধরে বেরিয়ে গেল ইস্টার্ন বাইপাসে। আশপাশের পাঁচতলা-ছ’তলা সব বাড়ির ছাদের চিলেকোঠা আর মাথায় বসানো জলের ট্যাঙ্কি অবধি এমন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, যেন ওগুলোর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনকড়ি। বাইপাসের অগুনতি ট্র্যাফিক লাইট আর গাড়িঘোড়ার ভিড় পেরিয়ে ওদের বাসটা যখন রুবির মোড়ে পৌঁছোল, ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়ে গেছে। ব্যস্ত সেই চৌমাথার মোড়ের একদিকে এক বিশাল হাসপাতাল, আর একদিকে নির্মীয়মাণ আকাশচুম্বী হোটেল। রাস্তা পার হয় কার সাধ্যি! বহুকষ্টে অনেকবার এগিয়ে পিছিয়ে অনেক অসহিষ্ণু গাড়ির হর্ন খেয়ে শেষমেশ একটা বহুতল বাড়ির একতলায় পাসপোর্টের কাউন্টারের সামনে এসে দেখল লম্বা লাইন। লোকজন সক্কাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে সঙ্গের সেই ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট তো আর তিনকড়ির ব্যাগার খাটতে আসেনি, তার নিজেরও কাজকর্ম আছে। সেও চলে যাবার জন্য উসখুস করছে। কিন্তু এই অবস্থায় একটা গেঁয়ো লোককে একা ফেলে চলে যায় কী করে? দোটানায় পড়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে ওরা, এমন সময় একটা ফচকে মতন ছোঁড়া কোত্থেকে উদয় হয়ে বলে, ‘কী দাদা, দু’জনের পাস্পোট হবে তো? যা যা ডকুমেন্ট এনেছেন সব দু’কপি করে জেরক্স লাগবে, আর ওই কোণের টেবিল থেকে একটা সিলিপ লিখিয়ে আনতে হবে।’ হাতে চাঁদ পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরা তাড়াতাড়ি তিনকড়িকে গছিয়ে দেয় তার হাতে, বিদায় নিতে নিতে আশ্বাস দেয় বিকেলে ঠিক সময়ে আবার হাজির হবে। ‘আরে, ঘাবড়াচ্ছেন কেন কাকা, আমি আছি, সব ম্যানেজ করে দেব’ বলতে বলতে তিনকড়িকে ভিড় কাটিয়ে ভেতরে নিয়ে যায় ছোঁড়াটা। সারাদিন তার ‘ম্যানেজ’ করার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে চমৎকৃত তিনকড়ি। লম্বা সর্পিল লাইন এড়িয়ে টুক করে একফাঁকে তাকে সামনের দিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার ‘ছোট বাইরে’ পেলে তার জায়গায় ‘প্লেস হোল্ডার’ হয়ে দাঁড়ানো, যা যা জেরক্স দরকার সব ঝট করে তিনতলায় গিয়ে করিয়ে আনা, এমনকী একঠায় অনেকক্ষণ দাঁড়ানোয় তার পা ব্যথা করছে দেখে ‘সরুন তো দাদা, এনাকে একটু বসতে দিন, এনার হার্টের ব্যামো আছে’ বলে বসার সিট খালি করে দেওয়া---একেবারে ‘ফাস্টোকেলাস’ সার্ভিস। তারপর সব কাজকর্ম মিটে গেলে দু’জনে যখন বাইরে বেরিয়ে আসছে, ছোঁড়াটা নিচুগলায় ‘পানবিড়ি’ চাইল। ‘এহেহে, এমন জিনিস চাইলি রে ভাই, দিই কী করে বল তো? পান সঙ্গে করে যা এনেছিলুম বাসেই শেষ হয়ে গেছে, আর বিড়ির বান্ডিল তো সেই বাক্সপ্যাঁটরার মধ্যে---বার করাই হয়নি’, আক্ষেপ করে তিনকড়ি। ‘না না, সেকথা নয়, এত খাটাখাটনি করলাম, একটু চা-মিষ্টি খাইয়ে দেবে না কাকা?’ ‘ও, তা বলবি তো সেকথা’, একগাল হাসে তিনকড়ি, ‘আমারও কি কম চা-তেষ্টা পেয়েছে রে? চ, বাইরে বেরিয়ে একটা খাবার দোকানে চ, দু’জনে মুখে কিছু দিই।’ ‘ধ্যাত্তেরি, কোত্থেকে যে আসে এসব গেঁয়ো মাল। আরে বাবা, সারাদিন যে এত হেল্প-টেল্প নিলে, তার একটা ফি আছে তো!’ কথা বলার ছিরি দেখ ছোঁড়ার! মনে মনে বেজায় চটে তিনকড়ি। টাকা চাইবি প্যান্টের বাঁ পকেটটা এত্তখানি ছিঁড়ল কখন? ছেড়ঁ া তো নয়, নিপুণ হাতে কাটা! সব্বোনাশ, ওতেই যে ছিল মাদারিহাটের মণিহারি দোকান থেকে কেনা সস্তা প্লাস্টিকের মানিব্যাগটা। মানি তাতে নেই ঠিকই, কিন্তু সুজন মাস্টারের শালার লিখে দেওয়া দু-ছত্তর চিঠি আর নেতার বাড়ির ঠিকানা---দুটোই ছিল ওর মধ্যে। তার সঙ্গে পাসপোর্টের কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে পাওয়া রশিদ! হা রে অদৃষ্ট! এখন উপায়?
June / July 2015 • 87 তো সোজাসুজি চা। আলু চাইতে গিয়ে আলুবখরা আর জল চাইতে গিয়ে জলপাই বললে লোকে বুঝবে কী করে? যাই হোক, ‘ফি’-এর অঙ্ক শুনে তো চক্ষু চড়কগাছ। এটা তো হিসেবের মধ্যে ছিল না, জানলে বেশি করে টাকা নিয়ে বেরোত। ঠিক এই সময় ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্টটা হাজির হওয়ায় এ যাত্রা ঝামেলা থেকে বেঁচে গেল ও। দরদাম করে ফি-ও একটু কমল, আর দু’জনের টাকা মিলিয়ে সেটা মেটানোও গেল। অতঃপর ফুটপাথের ধারের দোকান থেকে একটু জলখাবার খেয়ে নিয়ে আবার বাসের খোঁজে বাসস্ট্যান্ডে। গন্তব্য সেই পার্টির নেতার বাড়ি, যার সঙ্গে দেখা করার কথা। সন্ধের আগে না গেলে বাবু বেরিয়ে যাবেন। শহরের একেবারে উলটো দিকে থাকেন তিনি, অতএব লম্বা জার্নি। অফিসটাইম, গুঁতোগুঁতি ভিড়, বাসের ভেতর কোনওরকমে একটা হাতল ধরে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঝিমুনি আসে তিনকড়ির। চোখদুটো জুড়ে আসে। একসময় সঙ্গের ছোকরাটার ডাকে সম্বিৎ ফিরতেই বুঝতে পারে নামতে হবে এবার। আর নেমেই মাথায় হাত। একী! উপায় একটা হল, কিন্তু আখেরে তাতে কোনও লাভ হল না। নেতার নামটা মনে ছিল, তাই লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধে হয়নি। আর সঙ্গের ছোকরাটি বর্ধমানের ছেলে, শহরেই মানুষ, তাই শহুরে হাবভাব। পকেটে সবসময় মোবাইল। অনেকক্ষণ বাইরের একটা ঘরে বসিয়ে রাখার পর নেতাবাবু যখন দেখা দিলেন, ওই মোবাইল থেকেই সুজন মাস্টারকে ফোন করে তাঁর শালার নম্বর নিয়ে নেতার সঙ্গে সরাসরি কথা বলিয়ে দিয়েছিল সে। সব শুনে-টুনে অবশ্য নেতাবাবু খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না। বললেন, সামনেই পঞ্চায়েতের ইলেকশন, তা ছাড়া কী একটা কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পার্টি এখন একটু ব্যাকফুটে রয়েছে, তাই এক্ষুনি কিছু করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে অবশ্য কথায় কথায় জেনে নিয়েছেন তিনকড়িদের ওখানে পঞ্চায়েত আর বিধানসভার সিট কার দখলে। দুটোই অপোনেন্ট পার্টির শুনেই হয়তো আর গা লাগালেন না। ওখান থেকে ফেরার পথে তিনকড়ির হতাশ আর ব্যাজার মুখ দেখে সঙ্গের ছোকরাটি তার দিল খুশ করে দেবার জন্য একটা ধাবায় নিয়ে গিয়ে পেট ভরে রুটি-তড়কা- কষা মাংস খাওয়াল। ততক্ষণে সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি গুছিয়ে টুছিয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তে হবে, কাল সক্কালবেলা ট্রেন। কিন্তু বাস থেকে নেমে সাইকেল রিকশা করে বাড়ির পাড়ায় ঢুকতেই ওরা বুঝল সে গুড়ে বালি। লোকাল পার্টি অফিসের সামনে ম্যাড়াপ বেঁধে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে দুঃস্থ পল্লিবাসীর মধ্যে সাইকেল আর সেলাইকল বিতরণ চলছে। ‘দিদি’র জয়গানে কানের পর্দা ফেটে যাবার জোগাড়। ওদিকে আবার বাড়ির গ্রিলের গেটে তালা মারা, হাজার ডাকাডাকিতেও কেয়ারটেকারের সাড়া নেই। অথচ তার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। এ আবার কী! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? তাই বা কী করে সম্ভব? এই শব্দে তো মড়াও জেগে উঠবে। অনেকক্ষণ উঁকিঝুঁকি মারার পর হঠাৎ তিনকড়ির নজরে পড়ল বাড়ির পাঁচিলের কোণ দিয়ে একটা নারকোল গাছ উঠেছে। সঙ্গীকে গেটের সামনে রেখে প্যান্ট গুটিয়ে চটপট অ্যাকশনে
88 • June / July 2015 নেমে পড়ে ও। সেই ছোটবেলায় বাপের কাছে শিখেছিল নারকোল গাছে উঠে ডাব পাড়া। সে-বিদ্যে যে এভাবে কাজে আসবে, স্বপ্নেও ভাবেনি। একটু ভয় ভয় যে করছিল না তা নয়। একবার চোর সন্দেহে আশপাশের বাড়িগুলোর কেউ চেঁচিয়ে উঠলেই সর্বনাশ! তরতর করে উঁচু পাঁচিলটার মাথা অবধি উঠে ধপাস করে লাফিয়ে ভেতরে নামল ও, আর নেমে যা দেখল তা কহতব্য নয়। তার খাটিয়ায় খালি গায়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে কেয়ারটেকার, সম্পূর্ণ বেহুঁশ! চারপাশে ছড়ানো কয়েকটা দেশি মদের বোতল। ঘরটা মোদো গন্ধে ভরে আছে, বমি এসে যায়। ব্যাটাচ্ছেলের সাহস তো কম নয়! বাবুরা নেই বলে ভর সন্ধেবেলা নেশা করছে? আর করবি তো কর, তিনকড়ির পোঁটলাটাকে বালিশ করে শুলি কোন আক্কেলে? এঃ”। এখন এই গন্ধঅলা পোঁটলা নিয়ে গাঁয়ের বাড়ি হাজির হলে বউ ভাববে কী! ঘরের কোথাও গ্রিলের গেটের চাবিটা পাওয়া গেল না, লোকটার প্যান্টের পকেটেও না। শেষমেশ ঘরের কোণের কুঁজোটা এনে মাথায় উপুড় করে দিতে হুঁশ ফিরল তার। এইসব হুজ্জুতির ফলে সে-রাতে আর ঘুম হয়নি ভালো, তাই সারাটা ট্রেনের পথ পালা করে ঝিমোল ওরা দু’জন। ভাগ্যিস বসতে পেয়েছিল। মাদারিহাট ইস্টিশানে নেমে ভ্যানরিকশায় চড়ার পর অবশ্য রাস্তার ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা নিমেষে উধাও। তেঁতুলতলির মাঠে নেমে বাড়ির দিকে হেঁটে আসতে আসতে তিনকড়ি দেখে কীসের যেন জটলা তাদের বেড়ার সামনের বটগাছটাকে ঘিরে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে গাছের ডাল লক্ষ্য করে ক্রমাগত ঢিল মেরে যাচ্ছে, পড়শি বৈকুণ্ঠ খুড়ো একটা লম্বা নিমগাছের লাঠি নিয়ে কাকে যেন তাড়া দিচ্ছে আর এককড়ি একটা ভালোমানুষ মার্কা ছেলেকে হাত-পা নেড়ে খুব তড়পাচ্ছে। কাছে এসে আসল ঘটনা শুনে তার তো আক্কেল গুড়ুম। সুজন মাস্টারের ছেলের মাধ্যমে আমেরিকার বাবুদের সে যে ‘আসছি’ বলে খবর পাঠিয়েছিল, তার উত্তরে তারা নাকি কী সব দরকারি চিঠিপত্র পাঠিয়েছে। গাঁয়ের নাপিত সুবল পরামানিকের ছেলে মাদারিহাটে গিয়েছিল কী একটা কাজে, সুজন মাস্টার তার হাতে সেই চিঠিগুলোর ছাপানো কপি দিয়ে বলে পৌঁছে দিতে। এখন নাপিতের ছেলের হাতে চিঠির রোল আর বাজারের থলি ছাড়াও ছিল ভজু ময়রার দোকান থেকে কেনা একঠোঙা জিলিপি-সিঙাড়া। তিনকড়িদের বাড়ি পৌঁছে তাদের বেড়ার দরজার আগল খোলার জন্য যেই সে ঠোঙাটা মাটিতে নামিয়ে তার ওপর চিঠির রোলটা রেখেছে, অমনি তাক বুঝে একটা কাক হুশ করে এসে ঠোঙাসুদ্ধুচিঠি নিয়ে সোজা বটগাছের ডালে! ছেলেটা হইহই করে উঠতে আশপাশের লোক জড়ো হয়ে তখন থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিঠি উদ্ধারের। কিন্তু কাকের নাগাল পাওয়া কি অতই সোজা? সে সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে বসে দিব্যি তারিয়ে তারিয়ে জিলিপি-সিঙাড়া খাচ্ছে আর ছানাপোনাদের খাওয়াচ্ছে। পড়তে জানলেও অবশ্য তার এ চিঠি ফেরত দেওয়ার কোনও গরজ থাকত না---এ তো আর তার জাতভাইয়ের আমেরিকায় ‘কা-কা’ শ�োনাতে যাবার আমন্ত্রণ নয়। অগত্যা তিনকড়িকেই আবার জামা-টামা খুলে প্যান্ট গুটিয়ে বটগাছে উঠতে হল। বেচারা তিনকড়ি---কলকাতার নারকোল গাছের পর এবার ধুচ্নিখালির বটগাছ! কিছুদূর উঠে একটা জুতসই ডালে পা রেখে কাঁকড়া ধরার লোহা লাগানো আঁকশিটা দিয়ে বাসায় দু-একটা খোঁচা দিতেই বাসার মালিকের ডানা ঝাপটানি আর সরব প্রতিবাদ। একসময় চিঠির রোলটা টুক করে মাটিতে পড়তে দেখে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে আসে ও। গা-হাতের ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় থুতু মাখাতে মাখাতে ভাবতে থাকে, পাসপোর্টের ফর্মে ডেলিভারির ঠিকানাটাও দেওয়া আছে সুজন মাস্টারের বাড়ির। ওটা এলে আর কোনও ঝুঁকি নয়, সে নিজেই আনতে যাবে। অন্য কাউকে পাঠালে যদি আবার শ�োনে মাছরাঙা মাছ ভেবে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে বা কাঠঠোকরা কাঠ ভেবে ঠুকরে দিয়েছে। পাসপোর্ট শেষ অবধি এল অনেকদিন হা-পিত্যেশ করে বসে থাকার পর। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তিনকড়ি সুজন মাস্টারের ওখানে খবর নিয়েছে একে-তাকে পাঠিয়ে। আর প্রতিবারই হতাশ হয়েছে। নিজে অবশ্যি বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও নড়েনি। মোটেও বিশ্বাস নেই তার বাপ-বউকে। বিষ্টু ধরের ভায়রাভাই বলেছিল পাসপোর্ট আসার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। তার অবর্তমানে বাড়িতে যদি পুলিশ-টুলিশ আসে? পুলিশের ‘প’ শুনলেই ভয়ে পেটের ভেতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায় তার বুড়ো বাপের, বলে পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। যদি জেরা-টেরা করলে ভয়ের চোটে বলে দেয় এ বাড়িতে তিনকড়ি মণ্ডল নামের কেউ থাকে না? তাহলেই তো চিত্তির। যাইহোক, বাস্তবে সে সব কিছুই হল না। কে জানে, নিয়নকানুন বদলে গেছে বোধহয়। সুজনবাবুর বৈঠকখানায় বসে নতুন পাসপোর্টখানা হাতে নিয়ে তার সে কী স্বর্গীয় অনুভূতি---বলে বোঝানো যাবে না। অশ�োকস্তম্ভ আঁকা চকচকে কালো বইটা হাতে নিয়ে বারবার পাতা উলটে দেখে আর পরম যত্নে হাত বুলিয়ে আদর করে। মাস্টারমশায়ের কাছে ইতিমধ্যেই শুনেছে কলকাতার ছিনিমিনি সরণি না কোথায় যেন আমেরিকার ‘বিছা আপিস’। মাস্টারমশায়ের ছেলের কাছে আমেরিকার বাবুরা খবর পাঠিয়েছেন, তাঁদের কে একজন এজেন্ট নাকি ‘বিছা’র সব জোগাড়যন্ত্র করে দেবে, মায় কলকাতায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা অবধি। কাগজপত্র যা লাগে সব তো তাঁরা আগেই পাঠিয়েছেন। তিনকড়িকে শুধু ঠিকঠাক ইন্টারভিউটা দিতে হবে। সুজনবাবুর ফোন থেকেই সেই এজেন্টের সঙ্গে একপ্রস্থ কথা হয়ে গেল ওর। অভিজ্ঞ, পোড়খাওয়া লোক। ফোনেই পাসপোর্টের নম্বর-টম্বর সব নিয়ে নিলেন তিনি, বললেন আজকালের মধ্যেই একটা জরুরি কাজ সেরে রাখবেন---কম্পিউটারে একটা ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লিকেশন ফাইল করে ইন্টারভিউয়ের ডেটটা নিয়ে নেওয়া। তিনকড়ি তো অত বোঝে না, সে শুধু শুনে রাখল কাল-পরশু ইন্টারভিউয়ের তারিখ জানিয়ে মাস্টারমশায়ের কাছে খবর এলেই সে খবর পাবে, আর তাকে যাবার তোড়জোড় করতে হবে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে ও, ইন্টারভিউ মানে কি সাহেবদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলা? তাহলে কি গজেন ডাক্তারের হাতে-পায়ে ধরে তাঁর ছেলেটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে? নাকি ওই এজেন্টবাবুই সঙ্গে থেকে ইংরিজি প্রশ্নের মানে-টানে বুঝিয়ে দেবেন? আর বাড়ি-জমির দলিলের ব্যবস্থা যখন হল না, পাড়ার গণেশ সাঁপুই আর হরিশ সামন্তকে নিয়ে গেলে তারা অন্তত সাক্ষীটুকু দিতে পারবে। হায়, তখন যদি সে জানত আমেরিকান কনসুলেট কি চিজ! সেখানে দলবল নিয়ে হাজির হওয়া দূরে থাক, কাকপক্ষীও তার ত্রিসীমানার মধ্যে আসতে পারে না। দিন দুই বাদে তিনকড়ি যখন শুনল তার ইন্টারভিউয়ের তারিখ সামনের মাসের পয়লা, সত্যিসত্যিই গজেন ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে প্রস্তাবটা পাড়ল। ডাক্তারের ছেলেটা টিভিতে কলকাতা দেখলেও যায়নি কখনও, তাই সেও এক পায়ে খাড়া। কিন্তু ফোনে এজেন্টবাবুকে কথাটা বলতেই তিনি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। মাথা খারাপ নাকি! যার ইন্টারভিউ সে ছাড়া আর কারওর ওখানে ঢোকার অনুমতি নেই। আর তিনি তো শুধু তিনকড়ির এজেন্ট নন, ওরকম আরও জনাদশেক শিল্পীকে বিলেত-আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তের পুজোয় ‘রপ্তানি’ করার দায়িত্ব তাঁর। বাড়তি লোকজন নিয়ে এলে থাকতে দেবেন কোথায়? শুনে শুকনো আঙুরের মতো চুপসে গেল তিনকড়ি। এ যাত্রা আর তার বোধহয় বিদেশ দেখা হল না। সে কি আর অমন কপাল করে জন্মেছে যে গটগট করে সাহেবদের সামনে দাঁড়িয়ে চোস্ত ইংরিজিতে তাদের মন ভুলিয়ে দেবার এলেম রাখে? ধুর ছাই, তার চেয়ে গাঁয়ের ছেলে গাঁয়েই থাক চাষবাস-লাঙল-বলদ নিয়ে। কিন্তু আবার এতদূর এসে হাল ছেড়ে দিতেও মন চাইছে না। এই দোনামোনার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে বউছেলের কাছে যেই না বলেছে আবার তাকে একাই যেতে হবে কলকাতা, ব্যাস। এবার আর গান্ধির অহিংস অসহযোগ নয়, এক্কেবারে নেতাজির সশস্ত্র আন্দোলনের স্টাইলে থালাবাসন ছুড়ে হাতের চুড়ি আছড়ে ভেঙে বউ বলে কালই বাপের বাড়ি চলে যাবে। আর ছেলেটাও হয়েছে তেমনি, কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে ঠাকুদ্দার কানে কথাটা তুলে দিল! অমনি বুড়ো লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে এসে বউমা-নাতির পক্ষ নিয়ে গা-জ্বালানো চিমটি-
June / July 2015 • 89 কাটা বাক্যবাণে তাকে বিঁধতে শুরু করল। এই দ্বিমুখী আক্রমণের সামনে অসহায় তিনকড়ি। ‘ধ্যাত্তেরি, নিকুচি করেছে সংসারের, যাহ্, যা খুশি কর তোরা’ বলে দড়াম করে বেড়ার দরজা খুলে বেরিয়ে হাঁটা লাগায় গাঁয়ের চণ্ডীমণ্ডপের উদ্দেশে। ওখানেই রাত কাটাবে ও। মাটিতে চট পেতে শ�োবে, তবু বাড়ি ফিরবে না। বিশ্বযুদ্ধও একদিন শেষ হয়। তিনকড়ির গৃহযুদ্ধও রাত পেরিয়ে সকাল হতেই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। ছেলে এসে ডেকে নিয়ে গেছিল বাড়িতে, বউ অপেক্ষা করছিল চা আর মুড়ি-নারকোল নিয়ে। তার নিজের মনটাও একটু নরম হওয়ায় সেও রাজি হয়ে গিয়েছিল ওদের নিয়ে মালদার বকুলপুরে শালির বাড়ি ক’দিন কাটিয়ে আসতে। ওখানে এসময় একটা মেলা হয়। সেখান থেকে ফিরে কলকাতায় যাবার আগে যে ক’টা দিন পেয়েছিল, বউয়ের সঙ্গে একটু বেশিই সোহাগ করল তিনকড়ি। আর ছেলেটাকে বেশি বেশি আদর। কলকাতায় যাবার কথা যেদিন, ঠিক তার দু’দিন আগে সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ রাজেন এসে হাজির। কলকাতার সেই এজেন্টবাবু ফোন করেছেন তার বাবাকে, পরশু নাকি কলকাতায় কারা বনধ্ ডেকেছে। তিনকড়ি যেন পরশু নয়, কালই কলকাতা রওনা দেয়। শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বাক্সপ্যাঁটরা কাগজপত্র গোছাতে শুরু করে সে। ভেবেছিল কাল সারাদিন ধরে গোছাবে। যাকগে, কাল সকাল আটটার ট্রেনটা ধরা না গেলেও দুপুরের রামপুরহাট লোকালটা পেলে রাতের মধ্যে পৌঁছে যাবে। এবার ট্রেনজার্নি মোটামুটি আরামের হল, হাওড়ায় পৌঁছে বাস-ট্যাক্সির ধান্দাও করতে হয়নি। এজেন্টবাবু ম্যাটাডোর ভ্যান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তার ড্রাইভারই ওকে খুঁজে নিল। অনেকক্ষণ ধরে শহরের আলো ঝলমলে রাস্তায় ভিড়ভাট্টা কাটিয়ে আস্তে আস্তে চলার পর গাড়ি এসে থামল একটা পুরোনো লাল ইঁটের দোতলা বাড়ির সামনে। সোঁদাসোঁদা গন্ধঅলা, জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার ওঠা আর টিমটিমে আলো জ্বলা সেই বাড়ির একতলার একটা ঘরে ঠাঁই হল ওর। এটা আসলে একটা মেসবাড়ি, অন্য ঘরগুলোয় এজেন্টবাবুর আরও সব ‘ক্লায়েন্ট’রা রয়েছে। রাতের দিকে যখন একটা টাকমাথা বুড়ো সব ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে ভাত-রুটি-ডাল-সবজির বাক্স বিলি করতে এল, পড়শিদের সঙ্গে আলাপও হয়ে গেল সেই সুযোগে। একজন পুরুলিয়া থেকে এসেছে, ভালো খোল আর মাদল বাজায়, সেও যাবে আমেরিকায়। আরেকজন মুর্শিদাবাদের গঙ্গাপাড়ের লোক, তার তলব পড়েছে বিলেতের পুজোয় ভাটিয়ালি গান শ�োনাবার। খাওয়াদাওয়ার পর তাদের সঙ্গেই খানিক গল্পগুজব করে শুতে গেল তিনকড়ি। একে জুন মাসের গরম, তায় ঘরে একটা জানলা নেই। একটা ভাঙা টেবিল ফ্যান ছিল, তাই চালিয়েই ঘুমোল সারারাত। সকালে চা দিতে আসা বাচ্চা ছেলেটার চিল্লামিল্লিতে ঘুম ভাঙতে বাইরে এসে দেখে যাদের সেদিনই ভিসার ইন্টারভিউ, তারা চান-টান করে পোশাকটোশাক পরে রেডি হচ্ছে। এজেন্টবাবু নাকি তাদের ‘ক্লাস’ নিতে আসবেন। যথাসময়ে উদয় হলেন তিনি। কোট-প্যান্ট পরা কেতাদুরস্ত মাঝবয়সি ভদ্রলোক, এটাই তাঁর পেশা। অন্যদের ক্লাস নেওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনকড়ির সব ফর্ম-টর্ম চেক করলেন, ছবি সাঁটলেন, ব্যাঙ্ক ড্রাফটের টাকা নিলেন আর ওর উদ্বিগ্ন মুখ দেখে চওড়া হেসে বললেন, ‘আরে ভাই, ফি বছর তোমার মতো কতজনকে পাঠায় আমার কাছে জানো? বললাম তো, কাল সকালে সব ইনস্ট্রাকশনস দিয়ে দেব। আর ইংরিজি নিয়ে কোনও চিন্তা নেই, ওদের বাঙালি এমপ্লয়ি আর ট্রানস্লেটর---দুই-ই আছে’। ‘কেন যাচ্ছ’ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে শিকাগোর বাঙালি সমাজের ডাকে তাদের দুর্গাপুজোয় গাইতে যাচ্ছি, ‘কতদিন থাকবে’-র উত্তর হল চারদিন, আর ‘কোথায় থাকবে’ বা ‘যাওয়া-আসা-থাকা-খাওয়ার খরচ কে দেবে’ জানতে চাইলে আমেরিকার বাবুদের পাঠানো কাগজপত্রগুলো দেখাতে হবে। ম্যাটাডোরে বসে মিজের মনে বারবার আউড়াতে থাকে তিনকড়ি। জীবনে এতবড় পরীক্ষা সে দেয়নি। এজেন্টবাবুর ‘ক্লাস’ করেও তার আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে। পথের দু’ধারে দেখার মতো অনেক কিছুই ছিল---পার্ক স্ট্রিটের জাঁদরেল সব দোকানপাট, শহিদ মিনার, জাদুঘর, প্ল্যানেটোরিয়াম-- -কিন্তু সে ফিরেও তাকায়নি। সিগন্যাল সবুজ হতে গাড়ি একসময় ঢুকে পড়ে হোচিমিন সরণিতে, খানিকদূর গিয়ে একটা গাছপালা ঘেরা ছায়া ছায়া জায়গায় ওদের নাবিয়ে দিয়ে বলে বাকি পথটা হেঁটে যেতে হবে। ‘ওদের’ মানে ও, নদিয়ার নবদ্বীপ থেকে আসা দুই ঢাকি আর এজেন্টবাবুর এক অল্পবয়স্ক চেলা। চেলার পিছু পিছু গিয়ে ওরা দেখে, একটা বিরাট বড় জানলাবিহীন বাড়ি, চারদিকে কাঁটাতার দেওয়া উঁচু পাঁচিল, ধারেকাছে যাতে কোনও যানবাহন না আসে তার জন্য রাস্তার এদিকে ওদিকে অনেকটা দূর অবধি ‘নো এন্ট্রি’, মজবুত লোহার গেটের বাইরে ভেতরে উর্দি পরা বন্দুকধারী রক্ষী। দেখে তো বুকের ধুকপুকুনি মুহূর্তে দ্বিগুণ, গলা শুকিয়ে কাঠ। চেলার নির্দেশমতো একটা ছাপানো কাগজ গেটের পাহারাদারদের দেখাতে তারা শুধু তিনকড়িকে ঢুকতে দিয়ে বাকিদের বাইরে দাঁড়াতে বলল। করুণ চোখে তাদের দিকে একবার তাকিয়ে ভেতরপানে হাঁটা লাগায় ও, চেকপয়েন্টে মেটাল ডিটেক্টর আর তল্লাশির টেবিলে গিয়ে দাঁড়ায়। রক্ষীর তাগাদায় তাড়াতাড়ি ব্যাগে আর পকেটে যা যা ধাতুর জিনিস ছিল সব টেবিলে জমা রেখে মেটাল
90 • June / July 2015 ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে যেতেই প্রবল ট্যাঁ ট্যাঁ। চমকে পিছিয়ে এসে আবার ওটা দিয়ে যেতে আবারও একই জিনিস। রক্ষী বলল হাতদুটো দু’দিকে ছড়িয়ে দাঁড়াতে, তল্লাশি হবে। কীসের আবার তল্লাশি---ভেবে পায় না তিনকড়ি। পকেটে খুচরো পয়সা, মেসঘরের চাবি, খৈনির ক ৌটো---যা যা ছিল সবই তো টেবিলের ওপর রাখা! রক্ষীর দু’হাত প্রায় জাপটে ধরার ভঙ্গিতে তার দেহ সার্চ করতে করতে কোমরে এসে আটকে যায়, কী একটা ধরে টেপাটেপি করতে থাকে। জোরগলায় ‘ইয়ে ক্যায়া হ্যায় দিখাইয়ে’ বলাতে হঠাৎ তার খেয়াল হয়, কোমরে কালোসুতোয় বাঁধা পীরবাবার মাদুলি। সেই কোন ছোটবেলায় মা পরিয়ে দিয়েছিল। সে সব এখানে বলে অবশ্য কোনও লাভ নেই, খুলে রেখেই ঢুকতে হল। আর ঢুকতেই ঠান্ডা মেশিনের একরাশ হাওয়া এসে শরীর জুড়িয়ে দিল ওর। আহ্! গালচেয় মোড়া সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো অফিস, দেয়ালে বিরাট বিরাট সব ছবি টাঙানো। একজন নীল স্যুট পরা সুন্দরী মহিলা তাকে নিয়ে গেল কাগজপত্র জমা দেবার জানলায়। সব জমা-টমা নেওয়ার পর পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি সই করবেন, না টিপসই দেবেন?’ এই একটি কথা শুনলে তিনকড়ির মেজাজ গরম হয়ে যায়। কেন রে বাবা, তার চেহারা চাষাভুষোর মতো বলেই কি তার ক-অক্ষর গোমাংস? না হয় পাঁচ কেলাসের বেশি পড়েনি, কিন্তু সইটাও করতে পারবে না? যাকগে, ও চুপচাপ বাংলায় নিজের নাম সই করে ওয়েটিং এরিয়ায় এসে বসে। খানিকক্ষণ বাদেই ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়বে। এখানে যে অন্তত নিজের মাতৃভাষায় কথাটুকু বলা যাবে, সেটা বোঝার পর মনের পাথরচাপা ভয়টা একটু কমেছে। চোখ বন্ধ করে এজেন্টবাবুর শেখানো প্রশ্নোত্তরগুলো শেষবার ঝালিয়ে নেবার চেষ্টা করে ও। এমন সময় টুংটাং বাজনার সঙ্গে কী একটা ঘোষণা হল। ও বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে একজন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল ইন্টারভিউ উইন্ডোয়। নাহ্, এজেন্টবাবু সকালবেলা অত সময় ধরে ক্লাস না নিলেই পারতেন। কারণ ইন্টারভিউয়ে থোড়াই ওই সব প্রশ্ন করল! লম্বাপানা লালমুখো সাহেবটি তো তার সঙ্গে স্রেফ গল্পই করলেন মনে হল। অবশ্য তার বিন্দুবিসর্গও ও বুঝত না, যদি না সাহেবের একজন বাঙালি সহকর্মী সেগুলোর বাংলা তর্জমা করে দিত। ‘So, you’re travelling to Chicago, right? Do you know anybody there?’ ‘আজ্ঞে না স্যার, ওই চিঠিতেই যা যোগাযোগ ওখানকার বাবুদের সঙ্গে, আর মাঝে মাঝে হিমেল না কী যেন বলে…’ ‘I see. Have you ever performed overseas before?’ ‘আজ্ঞে না স্যার, বীরভূমের বাইরে বলতে একবার বিষ্ণুপুরে আর একবার বহরমপুরে…’। ‘Do you have your own home and family in Beer Bhoom?’ ‘আজ্ঞে না স্যার, মানে হ্যাঁ স্যার, ওখানে ধুচনিখালি গাঁয়ে আমার একটা কোঠাবাড়ি আর কিছু জমিজমা আছে, বউ-ছেলে আর বুড়ো বাপও আছে, ভাই থাকে রানাঘাটে, সে তো কিছু দেখে টেখে না, আমিই সব…’ ‘OK, OK, now explain to me what exactly you sing? Bowl songs… does it mean that you bang on metal bowls to creat music, like Caribbean steel drums?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার, ইয়ে, না স্যার, আমরা একতারা বাজিয়ে আমাদের সুখ-দুঃখের কথাগুলোই গান গেয়ে গেয়ে বলি। শুনবেন স্যার? মন রে-এ-এ-এ-এ, ঘরছাড়া তুই পাগল একজনা-আ-আ…’। ‘Oh Jesus! Oh my! Hah Hah Hah… he is the funniest guy I have ever interviewed…’ ১৬ কলা ভিসা ডেলিভারি নিয়েছিলেন এজেন্টবাবুই। প্লেনের টিকিটও করে দিয়েছিলেন তিনিই, তাঁর চেনাশ�োনা ট্রাভেল এজেন্সি থেকে। কলকাতা- দুবাই-শিকাগো। একেই এবার সেপ্টেম্বরে পুজো, তার ওপর ওখানকার বাবুরা করছেন আসল পুজোরও আগের শনি-রোববার। তাই দু’মাসও পায়নি তিনকড়ি আসন্ন আমেরিকা যাত্রার প্রস্তুতি নিতে। এর মধ্যে তার দু’সেট নতুন জামাকাপড় আর একজোড়া নতুন জুতো কেনা হয়েছে সিউড়ির ফ্যান্সি মার্কেট থেকে, কেনা হয়েছে রেক্সিনের বড় সুটকেস, সুজন মাস্টার দিয়েছেন একটা সুদৃশ্য শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ আর গজেন ডাক্তার তাঁর পুরোনো একখানা স্যুট। তার বাউলগানের গেরুয়া পোশাক মাদারিহাটের লন্ড্রি থেকে কেচে মাড় দিয়ে একেবারে যেন নতুন হয়ে এসেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, যে বুড়ো বাপ পিওনের হাতে আমেরিকার প্রথম চিঠিটা পাওয়া-ইস্তক তার ওপর খিঁচড়ে ছিল, সে নিজে এসে যত্ন করে তুলে রাখা পুরোনো একতারাটা তার হাতে দিয়ে ছলছল চোখে বলেছে, ‘বাপ-ঠাকুদ্দার মান রাখিস তিনু।’ সেটা বাজিয়ে প্রতিদিন নিয়ম করে গান প্র্যাকটিস করেছে ও। বউ প্রতিদিন রাতে বিছানায় কেঁদেছে। হাজার হোক তার সোয়ামি এই প্রথম তাকে ছেড়ে এতদূর যাচ্ছে। আর ছেলে গলা জড়িয়ে আবদার করে বলেছে আমেরিকা থেকে তার কী কী চাই। ভাই সব খবরই জানে, কিন্তু হিংসের কারণেই হোক কি ব্যস্ততার জন্য, সে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। তবে বোন-ভগ্নীপতি ছোটশিবপুর থেকে এসে একদিন দেখা করে গেছে। বিশ্বকর্মা পুজো গেল। দিগন্ত কাশফুলে ভরে উঠল। বাদল মেঘের কালো আস্তরণ সরে গিয়ে আকাশের মুখে হাসি ফুটল। এল মহালয়া। কিন্তু এবার আর গাঁয়ের অন্য লোকেদের সঙ্গে তিনকড়ি গেল না পিতৃপুরুষ তর্পণে। কালই যে তার আমেরিকার ফ্লাইট। আজ তৃতীয়বারের জন্য সে কলকাতা পাড়ি দেবে। গত ক’দিন বাড়িতে তাই সাজো সাজো রব। গাঁয়ের লোকজন সব দফায় দফায় দেখা করে শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ জানিয়ে গেছে। বলেছে তিনকড়ি এ গাঁয়ের গর্ব। আসন্ন বিদায়ের বিষণ্ণতার মধ্যেও বউ-ছেলের মুখে হাসি, কারণ বহু অপেক্ষার পর তাদের কলকাতা দেখার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। তাও পুজোর ঠিক আগে। তিনকড়িকে একেবারে পেলেনে তুলে দিয়ে তারা আসবে, সঙ্গে থাকবেন সুজন মাস্টার। রাতটা ওনারই এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার কথা। সাতসকালে ভ্যানরিকশায় মালপত্র তুলে বাপকে পেন্নাম করতে গেল যখন তিনকড়ি, দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে বুড়ো বাড়ির ভেতর সেঁধোল। ভ্যানরিকশা মাদারিহাট ইস্টিশানের ধারে পৌঁছোতেই ওরা দেখে মাস্টারমশায় সুটকেস হাতে রেডি হয়ে অপেক্ষা করছেন। আটটার গাড়িটা রোজ লেট থাকে, আজ এল এক্কেবারে সময়ে। রওনা দিল ওরা। ছেলেবেলায় মুখে মুখে মহাভারতের গল্প বলত মা। তখন শুনেছিল ময়দানবের তৈরি প্রাসাদের কথা, যে প্রাসাদে চোখ ধাঁধিয়ে রাজকুমাররাও দিশেহারা হয়ে পড়তেন। কাল সন্ধেয় গাড়ি করে যে দুটো শপিং মলে নিয়ে গিয়েছিলেন মাস্টারমশায়ের কলকাতার আত্মীয়, সেখানে ঢুকে তিনকড়ি আর তার ছেলে-বউয়েরও একই অবস্থা। আর আজ কলকাতা এয়ারপোর্টটাকেও মনে হচ্ছে যেন একটা শপিং মল। কী বিশাল! সঙ্গের লোকজন যেহেতু ভেতরে ঢুকতে পারে না, তাই ফুটপাথের ওপরেই কান্নাকাটি, বিদায় জানানোর পালা চলল কিছুক্ষণ। তারপর লাগেজ ট্রলি নিয়ে ঢুকে তিনকড়ি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ভাগ্যিস এটা বিদেশ নয়, লোকে বাংলা বোঝে। চেক ইন করাতে গিয়ে যখন শুনল হাতের ঢাউস সুটকেসটা ওরা নিয়ে নেবে, ও বেঁকে বসল। ওতেই তো স্বর্বস্ব রয়েছে, মায় একতারা অবধি। ও-জিনিস হাতছাড়া হতে দেওয়া যায়? কই, ট্রেনে বাসে তো কখনও এরকম মালপত্র কেড়ে নেয় না! কাউন্টারের কর্মীরা অনেক বোঝানোর পর একতারাটা বার করে নিয়ে বাক্সটা দিল বটে ওদের হাতে, কিন্তু ওটা ফিরে পাবার ব্যাপারে মোটেও আশ্বস্ত হল না। সিকিউরিটির লাইনে আবার সেই একতারা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। পাঞ্জাবি আর দক্ষিণ ভারতীয় সুরক্ষাকর্মীদের বোঝানোই মুশকিল যে ওটা একটা নিরীহ বাদ্যযন্ত্র। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কিছুটা ব্যাখ্যা করে আর ওদের সামনে কয়েকবার বাজিয়ে দেখিয়ে ছাড়া পেল বটে, কিন্তু তারপরেই যেতে হল মেটাল ডিটেক্টরের মধ্যে দিয়ে। সেই আমেরিকান কন্সুলেটের পুনরাবৃত্তি এবং শরীর হাতড়ে সার্চ। এবার অবশ্য
June / July 2015 • 91 আর মাদুলি খুলতে হয়নি কোমর থেকে। পাসপোর্ট কন্ট্রোলে যে ভদ্রলোক ছিলেন তিনি বাঙালি। পাসপোর্টে ধপাধপ ছাপ মারতে মারতে এটা ওটা প্রশ্ন করছিলেন। কথায় কথায় জানালেন তিনিও ছোটবেলায় ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন কিন্তু সে সব এখন কোথায় হারিয়ে গেছে। ওখান থেকে ডিপার্চার লাউঞ্জে যেতে গেলে এস্ক্যালেটরে চড়তে হয়। এই চলমান সিঁড়ির সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়টা কাল মলেই হয়ে গিয়েছিল, না হলে আজ বিড়ম্বনায় পড়তে হত। জিনিসটা মোটেও সুবিধের নয়, খালি মনে হয় টলে পড়ে যাব। ডিপার্চার লাউঞ্জে কত লোকের ভিড়। বেশিরভাগই সাহেবি পোশাকে, তবে আলখাল্লা আর বোরখা পরা লোকজনও রয়েছে। চারপাশে অনর্গল হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব আর পকেট ফোনে ছবি তোলা দেখতে দেখতে নিজেকে বড় একা মনে হয় ওর। যেন একদল ময়ূরের মাঝে সে একটা কাক। একসময় ডিপার্চার অ্যানাউন্সমেন্ট হল, সকলের দেখাদেখি ও-ও বোর্ডিং পাস হাতে লম্বা এরোব্রিজের মধ্যে হাঁটা দিল। কিন্তু এরোব্রিজের কাচের জানলা দিয়ে যে জিনিসটা নজরে আসছে, ওটা কী? ওটাই কী তবে তার প্লেন? অসম্ভব! ওরকম বিরাট, ধাম্বাল চেহারার একখানা জিনিস কখনও আকাশে উড়তে পারে? আকাশে সাদা ধোঁয়ার দাগ কেটে প্লেন উড়ে যেতে ও কম দেখেনি। অত উঁচুতে থাকে বলে সেগুলোকে পাখির মতো ছোট লাগে। মাটিতে নামলে আর কত বড় হবে-- -একটা ম্যাটাডোর ভ্যান বা একটা মিনিবাসের মতো? অবশ্য তাই যদি হয়, তাহলে তার সঙ্গে এতগুলো লোক ব্যাগপত্তর নিয়ে কোথায় হেঁটে যাচ্ছে? এরা তো মনে হয় তারই সহযাত্রী। সব ক ৌতূহলের অবসান হল, যখন সেই ধাম্বাল জিনিসটার পেটের ভেতরেই সেঁধোল ও, আর ফরসা সুন্দরী এয়ার হস্টেস ওকে সিট দেখিয়ে দিল। জানলার ধারে সিট। বিস্ময়ে তখন ওর মুখ হাঁ। সেই হাঁ-মুখ বন্ধ হল আরেকজন এয়ার হস্টেস এসে ওকে ‘সিটবেল্ট প্লিজ’ বলাতে। ও মানে বুঝতে পারছে না দেখে সে নিজেই বেঁধে দিল বেল্ট আর হাতের একতারাটা নিয়ে মাথার ওপরের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রাখল। একে এই বিস্ময়ের ওভারডোজ, তার ওপর কাল রাতে উত্তেজনার চোটে ঘুম না হওয়া আর প্লেনের ভেতরের স্নিগ্ধ-শীতল সুগন্ধী পরিবেশ---সব মিলিয়ে কেমন যেন অবশ হয়ে আসে ওর অনুভূতি, চোখের পাতা বুজে আসে। মনে শুধু একটা অজানা আশঙ্কা---ছোটবেলায় একবার মাদারিহাটের গাজনের মেলায় নাগরদোলায় চড়ে ভীষণ ভয় পেয়েছিল ও, মা’কে আঁকড়ে ধরে বসেছিল, জীবনে আর চড়েনি। প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতাও কি সেরকম? চোখ যখন খুলল, জানলার বাইরে স্বচ্ছনীল আকাশ আর তার অনেক নীচে মাটিতে রুক্ষ পাহাড় ঘিরে ধু-ধু মরুভূমি। দুবাই বিমানবন্দরে নামতে আর একঘণ্টাও বাকি নেই। কিন্তু প্লেনটা কি আকাশে থেমে আছে? জানলা দিয়ে তাকালে তো তাই মনে হয়। তা ছাড়া ঝাঁকুনিও নেই। প্লেনের ভেতর খাওদাওয়ার পর্ব মিটেছে, এয়ার হস্টেসরা ট্রলি করে উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করছে। তা যাকগে, ওর খুব একটা খিদে পায়নি। কিন্তু একবার টয়লেটে যেতে পারলে ভালো হয়। ওই তো, সামনেই টয়লেটের ছবি আঁকা আলো জ্বলছে। ওকে উসখুস করতে দেখে আর সিটবেল্ট নিয়ে ব্যর্থ টানাটানি করতে দেখে ওর পাশের সিটের ভদ্রলোক মুচকি হেসে বেল্টটা খুলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ওকে বেরোবার জায়গা করে দিতে। সে তো হল, কিন্তু টয়লেটের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আরেক বিড়ম্বনা। একে তো পাখির খাঁচার মতো পুঁচকে ঘর, নড়াচড়ার জায়গা নেই,
92 • June / July 2015 তার ওপর কোথায় কী করতে হবে বা কোথায় জল ঢালতে হবে কিস্যু বোঝা যাচ্ছে না। একটা নীল রঙের বড়মতো বোতামের ওপর লেখা ‘পুশ’। একটু ইতস্তত করে সেটাই দিল টিপে। সঙ্গে সঙ্গে এমন এক পিলে চমকানো শব্দ, যেন এক বিরাট রাক্ষস শিঙ্গায় করে সাগরের সব জল শুষে নিচ্ছে। ভয় পেয়ে ছিটকে বেরিয়ে আবার সিটে বসে ও। দরকার নেই বাবা, টয়লেট- ফয়লেট সব মাটিতে নেমে হবে এখন। মাটিতে নেমে আবার আরেক বিপত্তি। কলকাতা এয়ারপোর্ট যদি হয় ময়দানবের প্রাসাদ, দুবাই এয়ারপোর্ট সাক্ষাৎ ইন্দ্রপুরী। যেন এই জগতেরই নয়। তার ওপর ভাষার সমস্যা। সব সাইন-টাইন লেখা আরবি আর ইংরেজিতে। চারদিকে মাথায় গামছা বাঁধা শেখ আর দাড়িঅলা মৌলবিদের ছড়াছড়ি। স্যুট-টাই পরা সাহেবেরও অভাব নেই। শুধু ওর মতো দেখতে, ওর মতো পোশাক-আশাক পরা লোকই খুঁজে পাওয়া দায়। সুতরাং কাকে, কীভাবেই বা জিজ্ঞেস করবে টয়লেটের কথা? এর পরের প্লেনটা ছাড়তে বেশ কয়েকঘণ্টা দেরি---সেকথা কলকাতা এয়ারপোর্টেই বুঝিয়ে দিয়েছিল পরিষ্কার করে। আস্তে আস্তে টার্মিনাল ধরে হাঁটতে থাকে ও। দু’পাশে ঝলমলে সব দোকান, উঁচু ছাদের গায়ে বড় বড় কাচের জানলা দিয়ে বাইরের রোদ ঠিকরে আসছে, টার্মিনালের ভেতরেই সারি সারি খেজুরগাছ, মেঝেতে মোজাইকের অপূর্ব কারুকাজ। দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেছে, এমন সময় চমকে উঠল একটা গলা শুনে---‘কী দাদা বাঙালি নাকি?’ মরুভূমিতে হঠাৎ মরূদ্যান খুঁজে পেলে বা ঘোর অমাবস্যার রাতে জোনাকির আলো দেখলে মন যেমন পুলকে নেচে ওঠে, ওরও তাই হল। ঘুরে দেখে দুটো অল্পবয়সি ছেলে, শ্যামলা রং বেঁটেখাটো চেহারা, ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ‘আজ্ঞে আপনারা?’ ‘আমরা মেদিনীপুর হতে আসতিছি। ঝাড়গ্রামের লোক।’ কথায় কথায় জানা গেল ওরা ছৌ নাচের শিল্পী, শিকাগো হয়ে মিশিগান না কোথায় যাচ্ছে সেখানকার পুজোয় নাচ দেখাতে, এর আগেও একবার এখান দিয়েই আমেরিকা গেছে। ব্যাস, তাহলে তো তিনকড়ির সমস্যা মিটেই গেল। আলাপ হয়ে গেছে, এখন তিন বাঙালিকে আর পায় কে? শুরু হল গল্প---দেশগাঁয়ের, পরিবার-পরিজনের, দৈনন্দিন সমস্যার, প্রথম বিদেশে আসার অভিজ্ঞতার। দেখতে দেখতে কখন পরের প্লেনের সময় হয়ে গেছে, খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ঘড়ি দেখে চমকে উঠে হনহন করে হাঁটা লাগাল ডিপার্চার গেটের দিকে। ভাগ্যিস ওদের একটু আধটু জানা আছে এয়ারপোর্টটা। গেটে পৌঁছে দেখে লম্বা লাইন, যাত্রীদের প্রতিটি ব্যাগের আনাচ কানাচ উলটে পালটে তল্লাশি হচ্ছে, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চালিয়ে চালিয়ে দেখা হচ্ছে। এখানেও একতারার ‘লাইভ ডেমনস্ট্রেশন’ দিয়ে তবে পার পেল তিনকড়ি। প্লেনে উঠে দেখে কী ভাগ্য, ওদের সিট প্রায় পাশাপাশি। আইলের এধারে আর ওধারে। প্লেন ছাড়তেই ঝোলা থেকে তাস বার করল ওদের একজন। কখনও তাস, কখনও সামনের টিভি স্ক্রিনে ধুমধাড়াক্কা বলিউডি সিনেমা, কখনও বা স্রেফ ঘুম---এইভাবে কেটে গেল অতগুলো ঘণ্টা। আর প্লেনে কী খাওয়ায়, বাপরে বাপ! একটা হজম না হতেই আরেকটা। ইংরেজি বুঝতে না পেরে ভুল করে গোমাংস নিয়ে ফেলেছিল একবার, ডেকে বলতে বদলে দিল। এখন আর তিনকড়ি অত আনাড়ি নয়, কী করে বোতাম টিপে মাথার ওপরের আলোটা জ্বালিয়ে এয়ার হস্টেস ডাকতে হয় তা ভালোই জানে। চকোলেট, বিস্কুট, শুকনো কেক-টেক যা দিয়েছিল সব ঝোলায় ভরল। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে দেবে। কিন্তু বিনি পয়সায় এমন অঢেল কোকাকোলা? ওহ্, জবাব নেই। কতবার যে চেয়ে চেয়ে খেল, গুনে শেষ করা যাবে না। কুয়োর ব্যাঙ মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়লে কী হয়, সেটা ও টের পেল শিকাগোর ওহেয়ার এয়ারপোর্টে নেমে। প্লেন যখন মাটি ছুঁল, প্রথমে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। নিজেকে বার বার চিমটি কেটে দেখতে হল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে প্রায় শ-চারেক সহযাত্রীর সঙ্গে টার্মিনালে পা দিয়েই বুঝতে পারল, এ বেশ কঠিন ঠাঁই। সঙ্গী দুই মেদিনীপুরিয়ার জারিজুরি এখানে খাটবে না, তাদেরও শিকাগোয় এটা প্রথমবার। চারপাশে সব বিরাট বিরাট চেহারার লোকজন। সাদা চামড়ার, কালো চামড়ার। ওর মতো দুবলা চেহারার মানুষকে তো তারা একহাতে তুলে আছাড় মারতে পারে! তাদের কারো কারো কথাবার্তা বেশ রুক্ষ, অনেকটা গজেন ডাক্তার তাঁর মুখ্যুসুখ্যু রুগীদের সঙ্গে যেমন ধমকে কথা বলেন, সেরকম। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এতদিন জানত আমেরিকায় সবাই ইংরেজিই বলে, কিন্তু এরা যেটা বলছে সেটা যদি ইংরেজি হয় তাহলে গাঁয়ে থাকতে সুজন মাস্টার বা হারাধন উকিলের মুখে যা শুনে এসেছে সেটা কী? একটা বিশাল বড় হলঘরের মতো জায়গায় অনেকগুলো লম্বা, সর্পিল লাইনে ভাগ হয়ে ওরা দাঁড়াল। ভয়ে ওর সঙ্গী দুজনকে প্রায় আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ও। এক পা এক পা করে লাইন এগোতে এগোতে একসময় আসে ওদের পালা। কাউন্টারে বসে থাকা একজন ষণ্ডাগুণ্ডা চেহারার মাথাকামানো লোক আঙুল নেড়ে ডাকতে ওরা তিনজনেই একসঙ্গে হাজির হয়ে পাসপোর্ট বাড়িয়ে ধরে। “One by One, One by One” বলে তিনকড়ির পাসপোর্টটা নিয়ে উলটে পালটে দেখে তাতে নানারকম ছাপ্পা মারতে থাকে সে, তর্জনীর ইশারায় ওকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে বলে ফটাস করে ছবি তোলে। শেষে কাউন্টারের ওপর রাখা একটা চৌকোমতো কাঁচের জিনিসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে লোকটা ডানহাতের বুড়োআঙুল দেখাতে তিনকড়ি বুঝতে পারে, আবার সেই ‘বিছা আপিসের’ মতো তাকে নিরক্ষর ভাবছে আর টিপসই দিতে বলছে। ‘নো নো’ বলে সে পকেট থেকে একটা পেন বার করতেই ধমক, ‘What are you doing, man?
June / July 2015 • 93 Do as I say!’ চমকে চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে লোকটার নির্দেশ মতো দুহাতের দশ আঙুলের ছাপ দেয়, তারপর ছাড়া পেতেই ছিটকে বেরিয়ে আসে। সঙ্গী দুজনের জন্য অপেক্ষা করে তাদের পিছু পিছু হাঁটা লাগায় লাগেজ নেওয়ার ক্যারুসেলের দিকে। গোটা দুই ফুটবল মাঠের সাইজের একটা জায়গায় পাশাপাশি অনেকগুলো ক্যারুসেল, তাতে অসংখ্য ছোট বড় লাগেজ ঘুরপাক খাচ্ছে, আর প্রায় প্রতিটাকে ঘিরে মানুষের ঠেলাঠেলি ভীড়। এরমধ্যে কোথায় খুঁজবে তার নতুন রেক্সিনের স্যুটকেস? এই জন্যই কলকাতা এয়ারপোর্টে পই পই করে ওদের বলেছিল না নিয়ে নিতে। দিশেহারা হয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ দেখে একটা বড়সড় চারচাকার ঠেলাগাড়িতে বেশ কিছু ডাঁই করা মালপত্র নিয়ে একজন লম্বা চওড়া লোক পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভাল করে তাকাতেই একগাল হাসি, আরেঃ, ঐ তো তার সবুজ রঙের স্যুটকেস! গায়ে সাদা খড়ি দিয়ে বড় বড় করে নাম লিখে দিয়েছিল ছেলে, এখনো পড়া যাচ্ছে। উত্তেজনার চোটে বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় ‘ও দাদা, ও দাদা, দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে ছুটে গিয়ে দাঁড় করায় তাকে। দেখা গেল শুধু তার নয়, দুই মেদিনীপুরিয়ার জিনিসপত্রও ওটাতেই রয়েছে। আসলে তারা ইমিগ্রেশন থেকে ছাড়া পাবার আগেই ফ্লাইটের লাগেজ টাগেজ সব ক্যারুসেলে ঘুরে চলে গেছে। কেউ যেগুলো নেয়নি, সেগুলোই ওই লোকটা অফিসে জমা দিতে যাচ্ছিল। ওরা তো আর সেটা জানেনা, ভাবল খুব মোক্ষম সময়ে ধরেছে ব্যাটাকে, নাহলে নিয়ে কেটে পড়তো! যাইহোক, যেযার স্যুটকেস টেনে টেনে কাস্টমসের গ্রীন চ্যানেল পেরিয়ে বাইরে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে এসে ওরা অপেক্ষমান কাউকে দেখতে পেলনা। তিনটে ফাঁকা চেয়ার দখল করে তিনজনে বসতেই সামনে দেখে একটা খাবারের দোকান। একটু গরম চা পাওয়া গেলে মন্দ হতনা, তাই একজনকে পাহারায় রেখে দুজন গিয়ে দাঁড়ায় লাইনে। কাউন্টারে পোঁছে আঙুল দেখিয়ে বলে ‘থ্রি টী’। ‘Anything else? For here or to go?’ নাও, এখন কী বলছে তার মর্মোদ্ধার কর! হিয়ার্টুগো বস্তুটা কোনো খাবার টাবার হবে ভেবে তিনকড়ি জানায়, ‘নো হিয়ার্টুগো, ওনলি টী।’ ‘Excuse me? I don’t understand!’ ঠিক সেই সময় কাঁধে একটা মৃদু টোকা। ‘মিস্টার মন্ডল?’ ঘুরে দেখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা এক সাহেব বাঙালি তার দিকে হ্যান্ডশেকের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন- ‘সরি, আসতে একটু দেরী হয়ে গেল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? চলুন, গাড়িতে ফ্ল্যাশার দেওয়া আছে, পার্ক করে আসিনি।’ বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়। এয়ারপোর্টের ভিড় কাটিয়ে ইন্টারস্টেট হাইওয়ে ১৯০ দিয়ে ছুটে চলেছে একটা দুধসাদা টয়েটা রাভেনা। স্টিয়ারিং হুইলে ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট শিকাগোর অর্থনীতির অধ্যাপক ড. দিবাকর সেন। পাশের সিটে রাঢ়বঙ্গের বীরভূম জেলার মাদারিহাট ব্লকের ধুচনিখালি গ্রামের তিনকড়ি মণ্ডল। চালক একসময় আরোহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে প্লিজ বাবু বলবেন না। মিস্টার সেন বলতে পারেন। দিবাকরদা বললে তো আরওই ভালো।’ আরোহী তখন একটু অন্যমনস্ক ছিল, জানলা দিয়ে আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম শহরের অপার্থিব জৌলুস দেখতে দেখতে ভাবছিল সে কি এই মুহূর্তে এই চেনা পৃথিবীতেই আছে, নাকি কোনও ভিনগ্রহে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলে, ‘আজ্ঞে আপনিও আমাকে আপনি করে বললে এট্টুকীরম লাগে…’। ঘণ্টাখানেক বাদে ড. সেনের রকফোর্ডের বাড়িতে যখন গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল, তখন তাঁরা একে অপরের কাছে হয়ে গেছেন যথাক্রমে ‘দিবাকর দাদাবাবু’ আর ‘তিনকড়ি’। অতএব স্থানীয় মিডল স্কুলের শিক্ষিকা মিসেস সেন হলেন ‘বউদিমণি’ আর তাঁর হাইস্কুল-পড়ুয়া ছেলে হল ‘ছোট দাদাবাবু’। তিনকড়িকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে ড. সেন বললেন, ‘মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নীচে এসো। ডিনারের দেরি আছে, আরও কিছু লোকজন আসবে, তার আগে একটু স্ন্যাক্স হয়ে যাক।’ তিনকড়ি অবাক বিস্ময়ে বাড়িটা দেখছিল। এই রাজবাড়ির রাজপালঙ্কে আজ রাতে তার ঘুম হবে? ধীরপায়ে গালচে মোড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে সে কলঘর খুঁজতে থাকে। যে দরজা ঠেলে সেটাই দেখে দারুণভাবে সাজানো একটা জমকালো ঘর। একটা ছোটমতো ঘরে অবশ্য জলের কল আর বেসিন রয়েছে, কিন্তু তার দেয়ালে ফুল আঁকা দেয়ালঘড়ি আর বিরাট তেলরঙের ছবি, আর মেঝেতে নরম নরম পাপোস পাতা। এ কী করে কলঘর হবে? যাইহোক, তার তো মুখহাত ধোয়া নিয়ে কথা, চান তো আর করছে না। ভেতরে ঢুকে কলের হাতল এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে কিছুতেই জল পড়ে না। আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখে সুইচ টেপাই আছে, কিন্তু আলো জ্বলছে কই? মাদারিহাটের মতো এখানেও কি তবে ‘কর্পোশানে’র কলের জল, টাইম ধরে আসে আর টাইম ধরে চলে যায়? নাকি ‘ডিপ টিউকলে’র জল, এখন লোডশেডিং আছে বলে পাম্পে জল উঠছে না? নীচে গিয়ে বউদিমণিকে বলতেই অবশ্য তিনি একই সঙ্গে ‘কর্পোশানে’র মেয়র আর বিদ্যুৎমন্ত্রী হয়ে সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কলের হাতল ওপর-নীচ উঠিয়ে-নামিয়ে জল পড়াতে হয় আর কেন আলোর সুইচ আসলে টেপা ছিল না, বন্ধই ছিল। কারণ কলকাতায় যেটা ‘অন’, এদেশে সেটা ‘অফ’। সুসজ্জিত ডাইনিং স্পেসের লাগোয়া কাচের স্লাইডিং ডোর পেরোলেই প্রশস্ত কাঠের ডেক। তার ওপর পাতা আউটডোর টেবিলে মুড়ি-চানাচুর, বাদাম-আখরোট-কিসমিস ইত্যাদি স্ন্যাক্সের সঙ্গে গরম গরম সিঙাড়া। সে সব ঘিরে সন্ধের আধো অন্ধকারে গোটাদশেক ওয়েদারপ্রুফ চেয়ারে বসে আছেন শিকাগোর বঙ্গসমাজের কিছু পরিচিত মুখ। প্রায় সকলেই এবারের দুর্গাপুজো কমিটিতে ড. সেনের সহকর্মী। চান-টান সেরে নতুন ফতুয়া-পাজামা গায়ে তিনকড়ি সেই আড্ডার আসরে হাজির হতেই গৃহকর্তা সকলের সঙ্গে তার পরিচয়পর্ব শুরু করলেন। কিন্তু নিজে সে তখন রীতিমতো কাঁপছে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে---সারাজীবন মেছোচিল, শঙ্খচিল, গাংচিল অনেক দেখেছে। কিন্তু শিকাগোয় সেপ্টেম্বরের শেষের উইন্ড চিল সম্বন্ধে তার কোনও ধারণাই ছিল না। থাকলে লোকের কাছে গরম কাপড় ধার করে নিয়ে আসত। বউদিমণি তাড়াতাড়ি একটা লাইট জ্যাকেট এনে ওর ফতুয়ার ওপর জড়িয়ে দেন, গলায় জড়াবার জন্য দেন একটা উলের স্কার্ফ। একথা সেকথার পর একজন হঠাৎ বলল, এবার একটু গান-টান হলে মন্দ হয় না। মিস্টার মণ্ডলের কি এনার্জি আছে? সবাই হইহই করে সায় দিয়ে ওঠায় ড. সেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওয়েল, তিনকড়ি, পপুলার ডিম্যান্ড…’ জেটল্যাগে অবসন্ন শরীর, তবু উঠে দাঁড়ায় তিনকড়ি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় বৈঠকখানার সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা তার একতারাটার দিকে। সেটাকে আঁকড়ে ধরতেই অনেক কিছু ছবি ভেসে ওঠে তার মনে---সেই কোন ছেলেবেলায় একতারাটা হাত থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য বাপের চড়চাপড়, গাঁয়ের মাঠে লাঙল দিতে দিতে বাপের কাছে গান শেখা, বড় হয়ে মাদারিহাট-শান্তিনিকেতন-বিষ্ণুপুর-বহরমপুর গান শুনিয়ে নামডাক, চৈত্রমাসের এক চিঠিতে আমেরিকার প্রথম হাতছানি, তারপর ছ’মাস ধরে কত বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, কত আশা আশঙ্কার দোলায় দুলে, কত বন্ধন আর পিছুটান অগ্রাহ্য করে আজ এখানে পৌঁছানো। সেই গান আজ তার স্বপ্নের দেশের শ্রোতারা শুনতে চাইছে, আর সে না গেয়ে থাকতে পারে? প্রাণভরে গাইবে সে আজ। গাইবেই। অলংকরণ প্রণব হাজরা দুকূলের সহ সম্পাদক সুজয় দত্ত পেশায় ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাক্রন ওহাইওর স্ট্যাটিস্টিক্সের অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যের চর্চা তাঁর কাছে অধ্যাপনার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। গল্প, কবিতা ছাড়াও বিজ্ঞান-সম্পর্কিত উপভোগ্য রচনায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
94 • June / July 2015 আমাদের সংস্কৃতি ডাঃ আনিসুজ্জামান সংস্কৃতি বলতে মূলত দুটো ব্যাপার বোঝায়, বস্তুগত সংস্কৃতি আর মানস সংস্কৃতি। ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, আহারবিহার, জীবনযাপন প্রণালী---এসব বস্তুগত সংস্কৃতির অন্তর্গত। আর সাহিত্য-দর্শনে শিল্পে-সঙ্গীতে মানসিক প্রবৃত্তির যে বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তাকে বলা যায় মানস-সংস্কৃতি। বস্তুগত আর মানস- সংস্কৃতি মিলিয়েই কোনও দেশের বা জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে আমরা যে সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করছি, তা অনেক পুরোনো। এই সংস্কৃতির কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে মেলে, কিছু বৈশিষ্ট্য আলাদা করে শনাক্ত করা যায়। নৃতাত্ত্বিক বিচারে, কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক বিকাশে, ধর্মানুপ্রেরণায়, বর্ণপ্রথায়, উৎপাদন পদ্ধতির অনেকখানিতে বাঙালি সংস্কৃতির মিল পাওয়া যাবে গোটা উপমহাদেশের সঙ্গে। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষা--- এই গোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষা ছড়িয়ে আছে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে। বাংলার অনেক রীতি- নীতিরও মিল খুঁজে পাওয়া যায় সেই এলাকায়। আবার ধান-তেল-হলুদপান-সুপারির ব্যবহারের মিল পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে। সেলাই ছাড়া কাপড় পরার বিষয়েও বেশি মিল ওই এলাকার সঙ্গে, এর কারণ বাংলার আদি জনপ্রবাহ ছিল প্রাক-আর্য নরগোষ্ঠীসম্ভূত। পরে এর ওপরে আর্য জনগোষ্ঠীর ও তাদের প্রভাব এসে পড়ে। সে প্রভাব এত তীব্র ছিল যে, তা-ই দেশজ উপকরণে পরিণত হয়। পরে মুসলমানরা যখন এদেশ জয় করলেন, তখন তাঁরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এলেন, তাতে তুর্কি-আরব-ইরান-মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতির উপাদানের মিশেল ছিল। সেখান থেকে অনেক কিছু এল বাঙালি সংস্কৃতিতে। তারপর এদেশে যখন ইউরোপীয়রা এলেন, তখন তাঁরা এদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ ঘটালেন আরও একটি সংস্কৃতির। এভাবে বাংলার সংস্কৃতিতে অনেক সংস্কৃতি-প্রবাহের দান এসে মিশেছে। আর নানা উৎসের দানে আমাদের সংস্কৃতি হয়েছে পুষ্ট। বাংলার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিকে দান করেছে স্বাতন্ত্র্য। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের দরুন বাংলায় বিভিন্ন রাজত্ব যেমন স্থায়িত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনই বাংলার এই বিচ্ছিন্নতার ফলে ধর্মমতের ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ও উদ্ভাবন দেখা দিয়েছে। বাংলার সাহিত্য- সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বৈচিত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য গান করে লেখা মনসামঙ্গল কাব্যের উদ্ভব পূর্ববঙ্গের জলাভূমিতে, পশ্চিমবঙ্গের রুক্ষ মাটিতে বিকাশ বৈষ্ণব পদাবলীর। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গে ভাটিয়ালি গানের বিস্তার, শুষ্ক উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়ার আর বাংলার পশ্চিমাঞ্চলে কীর্তন আর বাউলের। শিল্পসামগ্রীর লভ্যতাও প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তাই বাংলার স্থাপত্যে পাথরের চেয়ে ইট বা মাটির প্রাধান্য, মৃৎফলক এখানকার অনন্য সৃষ্টি। বাংলার ভাস্কর্যেও মাটির প্রাধান্য আর সেই সঙ্গে দেখা যায় এক ধরনের সামগ্রীর ওপরে অন্য ধরনের সামগ্রীর উপযোগী শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস। অন্যদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বাংলার মানস-সংস্কৃতি প্রধানত আশ্রয় করেছে সাহিত্য ও সঙ্গীত, আধ্যাত্মচিন্তা ও দর্শনকে। স্বল্প হলেও স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার দান আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও গণিতের সাধনার তেমন ঐতিহ্য বাংলায় গড়ে ওঠেনি। ফলিত বিজ্ঞানের একটি ক্ষেত্রে, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বাংলার একটা ভূমিকা ছিল, তাও ছিল সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলার অগ্রগতি দেখা দিয়েছিল মূলত কারুশিল্পে। তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই শিল্প প্রবন্ধ
June / July 2015 • 95 বিকশিত হলেও এর প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হয়েছে ইংরেজ আমলে। তবে সে প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব সৃষ্টি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে ধার করা। বাংলার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হতে থাকে খৃস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে। এই স্বাতন্ত্র্য দেখা যায় শাসন ব্যবস্থায়, সেই স্বাতন্ত্র্যকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। বহিরাগত মুসলমানেরা এদেশ জয় করেন ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে। মুসলমান শাসকেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে তার বিকাশে সহায়তা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষে মুঘলরা বাংলাদেশ জয় করেন। মুঘল আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আগের মতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেনি। তবে একটা বৃহত্তর পরিবেশের সঙ্গে তখন বাংলার সংস্কৃতির যোগ ঘটে। তারপর আঠারো শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হলে যোগাযোগের পরিধি আরও বিস্তৃ হয়; বিশ্বসংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার যোগ সাধিত হয়। ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে উচ্চবর্গের সংস্কৃতির সঙ্গে নিম্নবর্গের সংস্কৃতির কিছু কিছু ভেদ ছিল। কারুশিল্পের ক্ষেত্রে ভেদটা খুব চোখে পড়ে। এর একটা ধারা ছিল উচ্চশ্রেণির ভোগ্য রুপোর কাজ, হাতির দাঁতের কাজ, রেশমি ও উঁচু মানের সুতি কাপড়ের শিল্প; অন্য ধারাটা ছিল সাধারণের ভোগ্য শাঁখের ও পিতলের কাজ, নকশি কাঁথা, পাটি, আলপনা। সমাজের উঁচু পর্যায়ে সংস্কৃত বা ফারসির যে চর্চা হত তা নিচু স্তরকে স্পর্শ করেনি। ধ্রুপদী সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত চর্চার মধ্যেও এমনি পার্থক্য ছিল। লোকসাহিত্য ও শিল্প-সাহিত্যের ভেদও ছিল। তবে বাংলার সাহিত্য ও সঙ্গীত সমাজের বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা প্রায় সকল স্তরকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছিল। এই জন্য বাংলার মানস সংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রাধান্য সাহিত্য ও সঙ্গীতের। ইংরেজ আমলে যে নতুন সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে, তার প্রেরণা এসেছিল প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে। পাশ্চাত্য শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের যোগ ঘটেনি, তারা এর বিকাশ এবং এর উপভোগ্যতায় অংশ নিতে পারেনি। একালের সাহিত্য- সঙ্গীত-নাটক-চিত্রকলা প্রধানত নগরের সৃষ্টি। এই অর্থে আমাদের মানস সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপ নির্মিত হয় উচ্চ ও মধ্য শ্রেণির মুষ্টিমেয় ইংরেজি শিক্ষিতদের হাতে। ঔপনিবেশিক ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে তা ছিল অপরিহার্য। বাংলাদেশের সমাজ আজ ঔপনিবেশিক নয়, কিন্তু আগের মতোই শ্রেণিবিভক্ত। তাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সকলের অধিকার সমান নয় এবং এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতিতে অন্য শ্রেণির প্রবেশাধিকার নেই; আবার এক শ্রেণির সৃষ্ট সংস্কৃতি অন্য শ্রেণির পক্ষে রুচিকর নয়। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলে এই অবস্থার কোনও বদল আশা করা যায় না। আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলার সংস্কৃতিকে এক অর্থে ধর্মমুখী বলা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্য বা মঙ্গল কাব্য, ইসলাম ধর্মবিষয়ক রচনা বা নবীজীবন, কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত তার উদাহরণ। এমনকী অধ্যাত্ম-তত্ত্বাশ্রিত প্রণয়োপাধ্যানও এর মধ্যে ধরা যায়। তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়; প্রথমত, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে নানা ধর্মসম্প্রদায়ের বক্তব্য একই সঙ্গে স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, ধর্মকলহের পাশাপাশি এক ধরনের সমন্বয়চেতনা কাজ করেছে যোগ ও সুফিবাদের সমন্বয়ে, আর বাউলজান তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তৃতীয়ত, এর সব ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় বস্তুর চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানবিকতা। বৈষ্ণব কবিতা বা আধ্যাত্মিক প্রণয়কাহিনি তত্ত্বের চেয়ে প্রেমের কাহিনি রূপেই আদৃত হয়েছে, মঙ্গলকাব্যে দেবতার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষ। অবৈষ্ণব কবি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ লিখেছেন, অমুসলমান কবি লিখেছেন কারবালা- কাহিনি। এই মানবিকতাকে যদি বাঙালি সংস্কৃতির একটা মুখ্য প্রকাশ বলে গণ্য করি, তাহলে উনিশ-বিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতিতে সেই মানববাদের বিচিত্র রূপ প্রত্যক্ষ করি। পুরোনো ধারার সংস্কৃতিতে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ আছে। একালের সংস্কৃতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা সরবে শ�োনা যায়। এই দিক দিয়ে দেখলে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় মানবকল্যাণ ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি সুস্পষ্ট পক্ষপাত ফুটে উঠেছে। আমাদের সংস্কৃতির বিচিত্র রূপ নিয়ে যেমন আমরা গর্ব করতে পারি, তেমনই তার এই ভাববস্তু আমাদের গৌরবের বিষয়। প্রফেসর আনিসুজ্জামান ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলা সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা আকাদেমি পুরস্কার ও আনন্দ পুরস্কার পান। ২০১১ সালে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তিনি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বর্ণ-পদক লাভ করেন। প্রবন্ধ
96 • June / July 2015 এক দোকানদারের মৃত্যু হর্ষ দত্ত নিল পাল দু’তিন দিন আগে চমকে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, এবার আমাদের দিন আসছে। দোকান মালিকগুলোর যেটুকু রোয়াব ছিল, এখন থেকে তা আর থাকবে না। রস নিংড়ে বের করে নেব। তারপর দ্যাখ শালা কেমন লাগে? বিশ্বেশ্বরকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনিল গলা তুলে কথাগুলো বলছিল। অন্য হকাররা ওর বলার ভঙ্গিতে খ্যাক খ্যাক শব্দে হেসেছে। কেন যে হঠাৎ অনিল এ সব বলছিল বিশ্বেশ্বর বুঝতে পারেনি। প্রতিদিনের মতো চুপচাপ একা বসেছিল মানুষটা। ফুটপাথে এখন চৈত্র সেলের বিপুল ধামাকা আর কানফাটা কলরব চলছে। সন্ধে থেকে ক্রেতাদের ভিড় ক্রমশ বাড়তে বাড়তে রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত বিক্রির আগুন ছড়িয়ে যায়। সস্তা, কাঁচা রঙে ছোপানো, তিন-চার মাসের আয়ু---এমন সব রেডিমেড পোশাক বাজারটাকে ছেয়ে ফেলেছে। ফুটপাথের হকাররা যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, তাতে পুড়ে মরা ছাড়া কাস্টমারদের আর নিষ্কৃতি নেই। পরিত্রাণ নেই বিশ্বেশ্বরদের মতো দোকান মালিকদের, যারা আর নিজেদের অস্তিত্ব প্রাণপণ চেষ্টাতেও ধরে রাখতে পারছে না। যে দোকানটা ছিল জীবিকার অবলম্বন ও উপায়, সেটাই এখন গলগ্রহ, খাদ্যনালীতে আটকে থাকা কাঁটা। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার এই যন্ত্রণা একদিন ভোগ করতে হবে---বিশ্বেশ্বর কখনও চিন্তাও করেনি। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হকাররা এইভাবে যে একতরফা জিতে যাবে, কোনও দোকানি কি ভেবেছিল? কেউ কেউ ভেছিল হয়তো বা, প্রতিরোধের চেষ্টাও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু তা ফুটপাথ দখলকারী হকারদের সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে নিতান্তই নগণ্য। এরা অগণন, এরা রক্তবীজের বংশ, এদের পাশেই প্রশাসন, রাজনীতি, এমনকী সংশ�োধিত আইন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে বিশ্বেশ্বর এক মৃত্যুপথযাত্রী দোকানের মৃতপ্রায় মালিক ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্বেশ্বরদের হারিয়ে দিয়ে অনিল পালেরাই আজ জয়ী। সন্ধে হওয়ার আগে তখন বিকেলের শেষ প্রান্তটুকু পশ্চিমে মিলিয়ে যাচ্ছে। দু’টাকা দামের ট্যাবলয়েড সাইজের সান্ধ্য দৈনিকটা লাল্টুদোকানে ছুড়ে দিয়ে গেল। ওখানেই খবরটা দেখল বিশ্বেশ্বর। রাজ্য সরকার ফুটপাথের হকারদের ট্রেড লাইসেন্স দেবে। রাস্তায় যারা বসে ব্যবসা করছে তাদের আর কেউ উৎখাত করতে পারবে না। হ্যাঁ, হকারদের আইন মেনে রাস্তায় বসতে হবে। পাবলিকের যাতায়াতের অসুবিধে ঘটানো চলবে না। জনপ্রিয় সরকার হকারদের সরকারি স্বীকৃতি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাখনের মতো পেলব, পাউঁরুটি কাটার ছুরির মতো মসৃণ খবর। তিরিশ বছরেরও কিছু আগে দোকানের সামনের ফুটপাথটা যখন একটু একটু করে বেদখল হচ্ছিল, প্রথমে তিরপল, তারপর প্লাস্টিক এবং শেষে স্থাবর টিনের শেডের নির্মাণে বড় রাস্তাটা আড়ালে চলে যাচ্ছিল, সেই হকারদের বিশ্বেশ্বর কিছুতেই মানতে পারত না। তীব্র প্রতিবাদ করত। একা বা অন্যদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে। কিন্তু আজ দু’বার খবরটা পড়ার পরও বুকের ভেতরে কোথাও রক্ত চলকে উঠল না। কী অদ্ভুত নিস্তেজ হয়ে রইল মাথার ভেতরটা! বিশ্বেশ্বরের মন বলল, ওহে, এটাই ভবিতব্য। তুমি দেখতে পাওনি কিংবা দেখতে চাওনি। কিন্তু এটাই হওয়ার ছিল। চোখ মেলে দেখ, অনিল, পালান, শিবেশ, রঞ্জিত, ভুতো, কালাচাঁদরা শুধু বোমার মতো ফেটে পড়ার অপেক্ষায়। সেই ব্লাস্টিং-এ তোমার মতো বিপণি-মালিকরা উড়ে যাবে, স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাবে। পূর্ণগ্রাসটুকু বাকি ছিল। এবার সেটুকুও সম্পন্ন হল। ট্যাবলয়েডটাকে ইচ্ছে করে কাউন্টারের ভেতরে পায়ের কাছে ফেলে দিল বিশ্বেশ্বর। ছিঃ, নোংরা রাজনীতি। একজনকে ভাতে মেরে আর একজনকে বাঁচিয়ে রাখার জঘন্য খেলা। বিড়বিড় করে উঠল বিশ্বেশ্বর, অরুণা, তুমি শেষ পর্যন্ত জিতলে। আমি হেরে গেলাম। একটু পরে টিভিতে এই খবরটা দেখতে দেখতে অরুণার ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে আসা মুখটায় কি রক্তের লাল আভা ফুটে উঠবে? অন্তত এক ঝলকের জন্য! একদিন দুপুরে খেয়ে ওঠার পর বিশ্বেশ্বরের হাতে এক চিমটে লেবু-বিটনুন মাখানো জোয়ান তুলে দিতে দিতে অরুণা বলেছিল, আমি জানি, আজও সকাল এগারোটা থেকে এই দুপুরে দোকান বন্ধ করে খেতে আসা পর্যন্ত একটা লোকও দোকানে ঢোকেনি। অনিল ও আশপাশের হকারগুলো জানোয়ারের মতো হামলে পড়ে খদ্দের টেনে নিয়েছে। ঠিক কি না বলো? তুমি অবশ্য স্বীকার করবে না। কেউ শুনে ফেললে বিপদে পড়ে যেতে পারে, এমনভাবে সতর্ক কণ্ঠে বিশ্বেশ্বর বলেছিল, আহ্, এ সব জানোয়ার ফানোয়ার কেন বলছ? ওদের কত পাওয়ার তোমার ধারণা নেই। ফিকে হেসে অরুণা বলেছিল, নেই বলেই তো এ সব শব্দ মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। শুনছ, ওগো শ�োনো, দোকানটা বিক্রি করে দাও। তুমি জেদ ধরে থেকো না। কিছুতেই ওদের সঙ্গে পারবে না। তোমার অমন রানিং দোকানটা হকাররা একটু একটু করে মেরে ফেলছে! মরিয়াদের মতো বিশ্বেশ্বর প্রতিবাদ করে উঠেছিল, এখনও মারতে পারেনি। ঝঙ্কারে বেজে উঠেছিল অরুণা, আর মারতে কোথায় বাকি রেখেছে! আগে অ ছোটগল্প
June / July 2015 • 97 দিনে তোমার চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার সেল হত। আর এখন মাসে কুড়ি হাজার টাকাও ছাড়ায় না। এর পর আরও কমবে। তুমি দেখে নিও। তা ছাড়া… একটু চুপ করে থেকে অরুণা অদ্ভুত করুণ স্বরে বলেছিল, শরৎ নন্দী কি পারলেন! দোকানে তালা তো পড়লই, নিজেও সুইসাইড…! আর বলতে পারেনি অরুণা। মশলার ক ৌটোটা হাতের মুঠোয় জোরে চেপে ধরে বিশ্বেশ্বরের সামনে থেকে চলে গেছিল। শরতের আত্মহত্যা করাটা বাড়াবাড়ি। অন্তত বিশ্বেশ্বর তাই মনে করে। মরে গিয়ে কোন সুরাহাটা হল! সাটার টানা বন্ধ দোকানের সামনে দিয়ে খদ্দেররা চলে যায়। কেউ ফিরেও তাকায় না। কারও কোনও হেলদোল নেই। শরতের শাড়ির দোকানটা খারাপ চলত না। দু’জন কর্মচারী ছিল। দোকানের দরজার বাঁ দিকে কাচের শ�োকেস, তাতে ম্যানিকুইন, দামি শাড়ির ঝুলন্ত প্রদর্শনী, সাইনবোর্ডের ওপর সার্চলাইট---সব মিলিয়ে বাসবী বস্ত্রমন্দির খদ্দেরদের নজর কাড়ত। নারায়ণ কুণ্ডু নামের হকারটা প্রথম এসে বসল ওই শ�োকেসটার তলায়। ফুটপাথে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে ব্লাউজ, ছোটদের প্যান্টি, বেবি ফ্রক, রুমাল ইত্যাদি ঢেলে বিক্রি করত। প্রথমে অতটা গা করেনি শরৎ। কিংবা করলেও রুজি রোজগারের প্রশ্নে তেমন পজেসিভ হতে পারেনি। একবছর বাদেই একটা মাঝারি সাইজের চৌকি পেতে ফেলল নারায়ণ। বৃষ্টির হাত থেকে মাল বাঁচাতে একটা প্লাস্টিক ছাউনিও রাতারাতি টাঙিয়ে দিল। বৃষ্টি না হলে অবশ্য গুটিয়ে রাখত। শরতের টনক নড়িয়ে দিল ওই চৌকি আর ছাউনিটা, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিশ্বেশ্বরের দুটো দোকান আগেই বাসবী বস্ত্রমন্দির। প্রায় চোখের সামনেই ও দেখেছে ভালো করে বুঝিয়েও নারায়ণকে ঠাঁইনাড়া করতে পারেনি শরৎ। হম্বিতম্বিতে কোনও কাজ তো হয়ইনি, উপরন্তু নারায়ণ কুণ্ডু নিজের পাশে পেয়ে গেছিল অন্যান্য হকারদের। হকাররা রীতিমতো শরৎকে শাসিয়েছিল, নারায়ণকে যদি ফুটপাথের এই জায়গা থেকে তুলে দেওয়ার চেষ্টাও করেন, তা হলে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। দোকান আপনার, কিন্তু ফুটপাথ কর্পোরেশনের। রাস্তায় আমরা কীভাবে বসব, সেটা আপনাকে দেখার ভার কেউ দেয়নি। আপনার শ�োকেস একটু গার্ড হলে কিচ্ছু হবে না। গেটের সামনে তো আর বসেনি। বড় দরজা দিয়ে দোকানের ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেশি ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করলে শ�োকেসের কাচ গুঁড়িয়ে যেতে পারে। খুঁচিয়ে ঘা করবেন না বলে দিচ্ছি! মেজাজি শরৎ এ সব শাসানি গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। শপওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কমলকৃষ্ণ দত্তকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় থানায় ডায়েরি করতে চলে গিয়েছিল। থানার সাব ইন্সপেক্টর নাকি ডায়েরি লেখার আগে বিরক্তি ঝরিয়ে বলেছিলেন, সারা কলকাতাটাই তো হকারদের দখলে চলে গেছে। আপনি মশাই পায়ের তলায় পেরেক কেন ফুটেছে---এই নিয়ে কমপ্লেন লঞ্চ করতে এসেছেন। কোনও মানে হয়! ওই হকারের বিরুদ্ধে ইললিগ্যাল এনক্রোচমেন্টের চার্জ প্রমাণ করতে পারবেন? কী চুপ করে আছেন কেন, বলুন! কমলকৃষ্ণ সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে এবং ঠেস দিয়ে বলেছিলেন, আপনারা যদি বসতে না দেন, তা হলে এ সব সমস্যা, এ সব প্রবলেম হওয়ার কথা নয়। আপনাদের হেল্প ছাড়া… এস আই ভদ্রলোক তীব্র ব্যঙ্গে কপাল নাচিয়ে বলেছিলেন, হকারদের ইউনিয়ন নেই! পলিটিক্যাল লিডাররা নেই! তোলাবাজরা নেই! কী বলতে চান আপনি? পুলিশই কেবল বাবা-মা! আশ্চর্য! সব দায় আমাদের! বিষয়টা জানতে পেরে হকাররা মোটেই ভয় পায়নি, উলটে চরম তাচ্ছিল্য আর উপহাসে দোকান-মালিকদের উপেক্ষা দেখিয়েছে। খবরের কাগজের ওপর আলতা দিয়ে লেখা পোস্টার বস্ত্রমন্দিরের শ�োকেসে সেঁটে দিয়েছিল হকাররা। তাতে পুনরায় শাসানি, সঙ্গে হুঁশিয়ারি: ‘ফুটপাথ কারও বাবার নয়। ফুটপাথে বসা হকারদের রাইট, সাবধান, এই রাইটে হাত দিলে পরিণাম খারাপ হবে। দোকান মালিক হুঁশিয়ার, আমাদের পেটে হাত দিলে করে দেব পগার পার।’ কমলকৃষ্ণের কাছ থেকে এ সব পরে শুনেছিল বিশ্বেশ্বর। ততদিনে আরও দুটো ঘটনা ঘটে গেছিল। প্রথম ঘটনা, কলকাতা কর্পোরেশনে অভিযোগ জানাতে গিয়ে শরৎ নন্দীর হতাশ হয়ে ফিরে আসা। কেউ ওকে পাত্তা দেয়নি। উলটে একজন কেরানি জ্ঞান দিয়েছে: ও সব দিন ভুলে যান দাদা। ছয়ের দশক পর্যন্ত আপনাদের একচেটিয়া রাজত্ব চলেছে। তারপর সাতের দশক থেকে সব ওলট-পালট। হকারদের সঙ্গে এখন আপনাদের কম্পিটিশন লড়তে হবে। কাস্টমারদের চেহারা-চরিত্রও বদলে গেছে, খেয়াল করেছেন কি? গালে রুজ পাউডার, পমেটম মাখা খদ্দের আর নেই। এখন শুধু দুটো ক্লাস---মিডল ক্লাস মানে মধ্যবিত্ত আর খেটে খাওয়া মানুষ মানে প্রলেতারিয়েত। এরাই বায়ার। এরাই জিনিসপত্রের টার্গেট। আইন আছে, শিওর আছে। কিন্তু আইনের কোনও ইমপ্লিমেন্টেশন দেখতে পাবেন না। ধরা যাক চেষ্টা-চরিত্র করে আপনি একজন হকারকে তুলে দিলেন। কিন্তু সেই শূন্যস্থান সাতদিনে ভরে যাবে। কোর্ট তো আর আপনার দোকানের সামনে একশ�ো চুয়াল্লিশ ধারা বলবৎ করবে না! শরৎ নন্দীকে এই সময় থেকে হতাশা গ্রাস করতে শুরু করেছিল। বিশ্বেশ্বর তার সাক্ষী এবং এটাই দু’নম্বর ঘটনা। খদ্দের হু হু করে কমে গেল সব দোকানেই। দোকানগুলোর আলাদা আইডেন্টিটি, এস্টাব্লিশমেন্ট কস্ট, সেল ট্যাক্স, কর্মচারীর মাইনে এবং অন্যান্য খরচ নিয়ে কেউ আর মাথাই ঘামাচ্ছে না। প্রতিটা দোকান সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খোলা আছে অথচ খদ্দের নেই। কিংবা যেটুকু আছে তা আনুবীক্ষণিক। এই অসহনীয় অবস্থা দিনের পর দিন চলতে চলতে আজ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তার আগেই অবশ্য শরৎ নিজেকে শেষ করে দিল। আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটা শরৎ কবে নিয়েছিল, বিশ্বেশ্বর আজও বুঝে উঠতে পারেনি। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার বেশ কিছু আগে, আশপাশের দোকান মালিকদের সঙ্গে খোসগল্প করার জন্য হুটহাট দোকানগুলোয় শরৎ চলে আসত। বিশ্বেশ্বরের পি কে গারমেন্টস স্টোর্সেও এসেছিল। একাধিক দিন। নিরানন্দ আর অপমান লুকোনোর চেষ্টা করত হালকা হাসি-ঠাট্টায়, অকারণ কোনও উল্লাসে। কিন্তু পারত কি? বিশ্বেশ্বরের তীক্ষ্ণ চোখে ঠিক ধরা পড়ত, শরৎ আত্ম-অসম্মান ভুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিছু করতে না পারার পরাজয়ে ও বেদনায় শরৎ যে ভেঙে পড়েছে- --এই সত্যটা অনুভব করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। আসলে তখন থেকে প্রায় সব দোকানমালিকেরই একই রকম শ�োচনীয় অবস্থা। শুধু পোশাক ব্যবসায়ী নয়, যে পোর্সেলিনের জিনিসপত্র বিক্রি করে, যার কসমেটিকসের দোকান, কিংবা স্টেশনারি শপ---সবার এক পরিণাম। শরৎ একা থানা-পুলিশ-পুরসভা করেছিল, অন্যরা মৌখিক প্রতিবাদের বেশি আর এগোয়নি। একটু একটু করে মৃত্যু ঘটছে বুঝেও বিপণি-স্বত্ব বুকে আঁকড়ে পড়ে আছে কেউ কেউ। বিশ্বেশ্বরও তাদের মধ্যে একজন। অনেক দোকান ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে কিংবা হাতবদল। সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রবদলও। যেমন একটা বড় এবং লম্বাটে বাসনকোসনের দোকান রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়েছে। রেস্তরাঁর নামটা অদ্ভুত---ভাইসভার্সা। এটার মালিক দীপনারায়ণ গুজরাল নামে এক হিন্দু পাঞ্জাবি। কলকাতায় নাকি ওদের চারপুরুষের বাস। দীপনারায়ণের বয়স বেশি নয়। তিন-চার মাস ছোটগল্প সেই সব টিপিক্যাল উত্তর কলকাতার অভিজাত ক্রেতারা নিজেদের স্ট্যাটাস শিকেয় তুলে রেখে হকারদের খদ্দের হয়ে গেল ম্যাজিকের মতো। সস্তা জিনিস আর দরদামের ফালতু উত্তাপ যারা নিতে চায় তারা ‘একদর’ লেখা দোকানগুলোয় আর ঢুকবে কেন? বিশ্বেশ্বর স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, এক অসম লড়াই শুরু হয়েছে।
98 • June / July 2015 আগে শীতের মরসুমে একদিন হঠাৎ ওর দোকানে এসেছিল। একটা স্যান্ডো গেঞ্জি কেনার ছুতোয় হঠাৎ জানতে চেয়েছিল, এই দোকানটা বিক্রি কর দেওয়ার কোনও প্ল্যান কি আপনার আছে? বিশ্বেশ্বর চমকে গিয়ে বলেছিল, না! কেন বলুন তো! দীপনারায়ণ স্মিত হেসে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিয়েছিল, হঠাৎ মনে হল তাই জিজ্ঞেস করলাম। সরি, কিছু মনে করবেন না। তারপর দীপ নিজের পরিচয় আর ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিল, আমি কিন্তু এখন আপনার প্রতিবেশী। কোনও দরকার হলে কল করবেন। ডোন্ট হেজিটেট। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, রেস্তরাঁটার উলটো দিক থেকে অন্তত তিনজন হকারকে তুলে দিয়েছে দীপনারায়ণ! কীভাবে দিয়েছে তার একাধিক ব্যাখ্যা বাজারে ছড়িয়ে আছে। তবে হকার যে তুলে দেওয়া যায় তার বিরাট প্রমাণ ওই ফাঁকা জায়গাটুকু। বড় রাস্তা থেকেই ভাইসভার্সার আলোকিত সাইনবোর্ড, বাহারি দরজা আর উর্দি পরা গেটকিপারকে স্পষ্ট দেখা যায়। দু’হাজার তেরোর পর শরৎ আর দোকান খুলল না। বিশ্বেশ্বরকে ফোনে বলেছিল, হাতি পোষার খরচা হয়ে যাচ্ছে রে। তেমন আয় কই? আর আমিও বিজনেসে ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছি। তাই আর মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চাই না। আমার একটাই মেয়ে, তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে, স্বামী-স্ত্রীতে দিব্যি চলে যাবে। রাস্তার কেওড়াদের সঙ্গে লড়াই করে লাভ নেই। বরং ক্ষতি। খদ্দেরের ঠিকানাই এখন ফুটপাথ। সোনা-রুপোর গয়না যেদিন রাস্তায়, ফুটে বিক্রি হবে সেদিনই জানবি সব শেষ। আলতো স্বরে বিশ্বেশ্বর বলেছিল, দোকানটা শুধুমুধু করে ফেলে না রেখে বিক্রি…। শব্দ করে হেসেছিল শরৎ, সেটাই আলমেটলি করতে হবে। তবে যে দু’জন কর্মচারী আছে তাদের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে বিক্রির কথা ভাবব। তাহলে ভালো দর পাওয়া যাবে। আরও টুকটাক কথা বলেছিল শরৎ। ব্যবসার ভবিষ্যৎ, হকারদের দৌরাত্ম্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জিনিসপত্রের দাম ইত্যাদি। সেই ওর সঙ্গে বিশ্বেশ্বরের শেষ কথা-বিনিময়। এর দিন পাঁচেক পরেই শ�োভাবাজার-সুতানটি মেট্রো স্টেশনের রেললাইনে নেমে গেছিল শরৎ। আর উঠে আসেনি। বিধান সরণি-গ্রে স্ট্রিট ক্রসিং থেকে ফড়েপুকুর মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু-ধারে যত দোকান আছে, সবাই খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। খুব বিখ্যাত কেউ মারা গেলে যেভাবে শ�োকের ছায়া নেমে আসে, তেমন অবশ্য নয়। তবে দোকানিদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কোন নির্মম অসহ্য চাপ সহ্য করতে না পেরে শরৎ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। ওর স্মরণে কমলকৃষ্ণ একটা স্মরণসভার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কালীপদ বণিক ও আরও কয়েকজন মেম্বার রাজি হলেন না। কালীপদদার যুক্তি ছিল---এই সভা শেষ পর্যন্ত আর স্মরণসভা থাকবে না, হয়ে উঠবে হকারদের বিরুদ্ধে ফাঁকা আওয়াজ আর বিষোদগারের সভা। এতে শরৎ নন্দীর আত্মা আরও কষ্ট পাবে। স্মরণসভার কোনও দরকার নেই। বরং আমাদের অন্যভাবে আন্দোলনের কথা ভাবতে হবে। চলমান ছবির মতো বিশ্বেশ্বরের মনে পড়ছে সব কিছু। ওর নিজের দোকানের পুরোনো কর্মচারী অতুলবাবুকে গত বছরের শেষে বুঝিয়ে- সুঝিয়ে বিদায় করে দিতে হল। বৃদ্ধ লোকটি একটু ঢিলেঢালা, বোকাসোকা ধরনের। তবে খুব বিশ্বাসী ছিলেন। কখনও চুরিচামারি করেননি। অভাবী মানুষ। বেলেঘাটার খালপাড়ে একটা মাঠকোঠা বাড়িতে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী আর মেজো ও ছোট ছেলে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে বাইপাসের দিকে কোথায় যেন বাসা নিয়েছে। মেজোটা মাছের ভেড়িতে কাজ করে এবং মদ্যপ। ছোটটি স্কুল থেকে ড্রপ আউট। উঠতি মস্তান এবং দিশাহীন। অতুলবাবুকে ছাড়িয়ে দেওয়ার সময় বিশ্বেশ্বর নিজেই কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সাধ্যমতো মানুষটাকে এককালীন কিছু টাকা দিয়েছে বিশ্বেশ্বর। করুণ মুখ করে চলে যাওয়ার সময় অতুলবাবু বলেছিলেন, এবার ভাবছি আমিও হকারিতে নামব। এতেই মুক্তি, এতেই শক্তি বুঝলেন কিনা। তবে বিশুবাবু একটা কথা, দেখবেন দোকানটা যেন দখল না হয়ে যায়! দেখছি তো, আপনার শরীর দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় হঠাৎ করে ভেঙে গেছে। যদি মনের জোরে, শরীরের তাগদে চালিয়ে যেতে পারেন তো খুব ভালো। না হলে অন্য পথ দেখতে দেরি করবেন না। আপনারা কর্তা আর গিন্নি। আপনাদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই বলে দায়দায়িত্বও নেই। দোকানটা যদি শেষমেশ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ঝেড়ে দিতে আর সময় নেবেন না। বিক্রির টাকা ব্যাঙ্কে রেখে সুদ খাবেন। যদি শেষ পর্যন্ত বিক্রি করেন তাহলে এই কর্মচারীটাকে এক পার্সেন্টদু’পার্সেন্ট যা হয় দেবেন, বিশুবাবু। টাকা ক’টা পেলে বড় উপকার হবে। আমার বয়স বাহাত্তর, আপনার সবে ষাট। আর ক’দিনই বা বাঁচব! আশপাশে সবাই কি মৃত্যুর দিন গুনছে! কী অদ্ভুত! বেঁচে থাকাটাই কি ফাঁস হয়ে চেপে বসছে মানুষের গলায়? প্রশ্নটা ওর মাথার ভেতর সেই যে ঢুকে গিয়েছে, কিছুতেই আর তাড়াতে পারছে না বিশ্বেশ্বর। আজকের সান্ধ্য দৈনিকের খবরটা কি অতুলবাবুর আশঙ্কাকে আরও জোরদার করে তুলল? শুধু অতুলবাবু কেন, অরুণাও তো আর এই দোকান নামক যন্ত্রণাটাকে বাড়তে দিতে চাইছে না। বিশ্বেশ্বর স্পষ্ট জানে, পি কে গার্মেন্টস স্টোর্স অরুণার কাছে এখন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। যতক্ষণ বিশ্বেশ্বর বাড়ি থাকে, অরুণা ওর সঙ্গে দোকানটা নিয়ে কোনও কথা বলে না, কোনও প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না। হয়তো ভুলে থাকতে চায়। কিংবা ভেতরে ভেতরে ও অপেক্ষা করছে, কবে বিশ্বেশ্বর বাস্তবের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ফ্যানের হাওয়ায় ট্যাবলয়েডটা মেঝেতে লতপত করছে। একটু নিচু হয়ে কুড়িয়ে নেওয়ার জন্যে বিশ্বেশ্বর শরীরটা একটু সবে বাঁকিয়েছে, চব্বিশ-পঁচিশ বছরের লম্বা চেহারার এক যুবক দোকানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আঙ্কল, আপনার কাছে পকেটওয়ালা বিয়াল্লিশ সাইজের আলিগড়ি পাজামা হবে? কয়েক সেকেন্ড ভাবল বিশ্বেশ্বর। অতুলবাবু থাকলে এক্ষুনি বলে দিতে পারতেন। সম্ভবত নেই। হনহন করে চলে গেল ছেলেটি। শুধু চলে গেল না, বিশ্বেশ্বরের পাঁজরের হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। বুকের কাছে বাঁ হাতটা চেপে ধরে কাগজটা তুলে নিল বিশ্বেশ্বর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো বলল, ঠিক বলেছ ভাই। পুরোপুরি ঝাঁপ ফেলে দেওয়ার সময় হয়েছে। বিশ্বেশ্বর স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। একটু পরে বামপন্থীদের মতো হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, হকাররাজ দীর্ঘজীবী হোক। তারপর নিজের মনে হাসতে হাসতে ধীরে হাত নামিয়ে কাউন্টারের ক্যাশ ড্রয়ারের এপাশ-ওপাশ ঘেঁটে বের করে আনল দীপনারায়ণের ভিজিটিং কার্ডটা। কার্ডে ভাইসভার্সার ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কোনাকুনি ছাপানো দীপের মোবাইল নম্বর। নিজের মোবাইলে নম্বরটা সেভ করে বিশ্বেশ্বর ফোন করল, হ্যালো, দীপনারায়ণজি বলছেন? আমি বিশ্বেশ্বর দে বলছি। পি কে স্টোর্সের মালিক।… আরে আমারই সৌভাগ্য…। কী যে বলেন…। হ্যাঁ, হ্যাঁ…। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। কাল এগারোটা নাগাদ আমার দোকানে আসতে পারবেন? … সাড়ে বারোটায় আসবেন… ঠিক আছে তাই আসুন। তখনই কথা হবে। নমস্কার, নমস্কার। চৈত্রের শুরুতে ধুলো ঝেড়ে স্টক মেলানোর সময় ও যেন দেখেছিল পাজামা যা পড়ে আছে, তার বেশির ভাগ লখনউ চুড়িদার। আলিগড়ির খদ্দের তেমন নেই, তার ওপরে দোকানের বিক্রি তথৈবচ। বিশ্বেশ্বর ম্লান হেসে জবাব দিল, না ভাই, নেই। তরুণটি উত্তর শুনেই দপ করে জ্বলে উঠল, এ সব দোকান যে কেন এখনও আছে? স্টক নেই, অ্যাট্রাকশন নেই। টোটালি ডাইং কন্ডিশন। ডিসগাস্টিং…। আঙ্কল, ক্লোজ ইট নাউ।